Site icon The Bangladesh Chronicle

কেন গাইবান্ধা টার্নিং পয়েন্ট?

স্টাফ রিপোর্টার

১৪ অক্টোবর ২০২২, শুক্রবার

শনিবার থেকে বুধবার। শেরেবাংলা নগরে কতো কিছুই না ঘটে গেল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া সংবিধান ভোটের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের ঘোষণা স্পষ্ট, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হবে।’ অথচ সেই নির্বাচন কমিশনে বসে প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা একজন নির্বাচন  কমিশনারের সঙ্গে কী আচরণটাই না করলেন! প্রকাশ্যে, পুরো নির্বাচন কমিশনের সামনে। ডিসি-এসপিদের মেসেজ ছিল লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। আগামী ভোটে তাদের ভূমিকা কেমন হবে তা তারা অনেকটাই স্পষ্ট করে দেন। নাটকীয়তার তখনো বাকি ছিল। উত্তাপ ছিল না, ছিল না তেমন কোনো আলোচনা। বুধবার যে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন ছিল তাও হয়তো বেশির ভাগ লোকই জানতেন না। কিন্তু দিনের শুরুতেই  প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল যখন বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

বিজ্ঞাপন

তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে নানা মন্তব্য আসতে থাকে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত প্রশ্ন ছিল, একটি আসনে উপনির্বাচনেই এই পরিস্থিতি। তাহলে তিন শ’ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কী হবে! তবে মাঝবেলায় কমিশন বেশ শক্ত অবস্থানই নেয়। নজিরবিহীনভাবে পুরো আসনের নির্বাচন স্থগিত করে দেয়। এটাও ইতিমধ্যে সবার জানা, সিসি ক্যামেরায় অনিয়মের দৃশ্য দেখেই কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা চলছে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে।

বিক্ষোভ দেখিয়েছে গাইবান্ধার স্থানীয় আওয়ামী লীগ। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল অবশ্য গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে পুরো পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, এটা তার একক সিদ্ধান্ত নয়। এটা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত। প্রসঙ্গত, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টেরও রায় রয়েছে, নির্বাচন কমিশন বলতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য কমিশনারদের বুঝায়। এটা পরিষ্কার যে, গায়েবি ভোটের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সাম্প্রতিক অতীতে শেরেবাংলা নগরকে কখনোই এমন অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। ‘সবার উপরে সংবিধান সত্য, তাহার উপরে কেউ নাই’ কমিশন যেন সেটাই বলতে চেয়েছে। যদিও তা নিয়ে সংশয়বাদীদের নানা ব্যাখ্যা রয়েছে। এটা অনেকটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। ইভিএম ডাকাত এবং রাতের কারসাজি- যেভাবেই হোক ভোট হয়ে যাবে। বিকাল বেলা নির্বাচন কমিশনাররা বলবেন, সামান্য কিছু গোলযোগ ছাড়া নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। বিরোধীরা এ নিয়ে নানা কথা বলবেন। নির্দিষ্ট সময়ে প্রজ্ঞাপন হয়ে যাবে। কথিত জয়ীদের আর কিছুই হবে না। কিন্তু এ ধারায় কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন বাদ সাধলেন। নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করছেন অনেকেই। তবে এটিও আলোচিত হচ্ছে, ভবিষ্যতে কী এ ধারা অব্যাহত থাকবে? অনেকেই বলতেন, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা অসীম। গাইবান্ধায় কমিশন কিছুটা হলেও তা দেখাতে পেরেছে। এ প্রশ্ন বেশ আলোচিত হচ্ছে, গাইবান্ধা কী জাতীয় রাজনীতিতে টার্নিং পয়েন্ট হতে চলেছে। শনি এবং বুধবারের ঘটনা এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছে, নির্দলীয় সরকার ছাড়া এ ভূমে স্বাধীন নির্বাচন কতোটা কঠিন! কারণ নির্বাচনে প্রধান ভূমিকা থাকে স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। দলীয় সরকারের অধীনে তারা নিরপেক্ষতা বজায় রাখবেন সে আশা বাতুলতা মাত্র। দ্বিতীয়, ইভিএম নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।

নির্বাচন কমিশনসহ অনেক পক্ষই বলছিল, ইভিএমে কারচুপির সুযোগ নেই। কিন্তু গাইবান্ধা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, মেশিন কারচুপি বন্ধ করতে পারে না। কমিশন কেন এমন কঠোর অবস্থান নিলো। এই নিয়ে নানা মত রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এ জন্য সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগে কমিশন পিছপা হবে না। অনেকে অবশ্য সংশয় প্রকাশ করেছেন। বলছেন, গাইবান্ধায় ক্ষমতা বদলের প্রশ্ন ছিল না। নিজেদের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির জন্যই এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ক্ষমতার প্রশ্ন আসলে ব্যতিক্রম কিছু হবে না। যদিও এটা নতুন একটি অধ্যায়ের শুরু-এমন মতের মানুষের সংখ্যাও কম নয়। ঢাকার রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন এমন অনেক বিশ্লেষক এটা মনে করেন, সামনের দিনগুলোতে এমন ঘটনা আরও ঘটবে।   গাইবান্ধা প্রশ্নে কমিশনের কঠোর অবস্থানের পরও অবশ্য কিছু প্রশ্ন উঠেছে? গাইবান্ধাতে যে কারণেই হোক প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি। তাদের বিরুদ্ধে কী কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে? প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখন নিজেই বলছেন, নির্দেশের পরও দায়িত্বরত কর্মকর্তারা যথাযথ পদক্ষেপ নেননি। এমনকি এটাও বলা হয়েছে, নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কেউ কেউ অনিয়ম করেছেন।

ইভিএম ডাকাতদের কারণে কমিশন অ্যাকশন নিয়েছে। কিন্তু স্যুট পরা অদৃশ্য ডাকাতদের কথাও সামনে এনেছেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তাদের কী হবে!

সিইসি নয়, গাইবান্ধার ভোট বন্ধের সিদ্ধান্ত ইসি: গাইবান্ধার উপনির্বাচনের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, আমরা হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি। এই সিদ্ধান্ত সিইসি গ্রহণ করেননি, কমিশন গ্রহণ করেছে। সিইসি কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে গ্রহণ করেন না; করতেও পারেন না।  ঢাকা থেকে সিসিটিভিতে ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি দেখার পর ভোটকক্ষে নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনতে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তারপরও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ‘কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি’ বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান সিইসি। ওই পরিস্থিতিতে ‘সর্বসম্মত’ সিদ্ধান্তে ভোট বন্ধ করার কথা জানিয়ে হাবিবুল আউয়াল বলেন, কমিশন সদস্যরা বসে আলাপ-আলোচনা করে চিন্তা-ভাবনা করে যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে সিইসি’র সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা ও মো. আলমগীর উপস্থিত ছিলেন। উপনির্বাচনে কেমন অনিয়ম হয়েছিল, ইসি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে, কোন পরিস্থিতিতে, কীভাবে ভোট বন্ধ করা হয়েছে- তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন সিইসি।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়তো জনমনে কিছু বিভ্রান্তি থাকতে পারে। আমরা টকশোতে শুনেছি কেউ আনন্দিত হয়েছে, কেউ ব্যথিত হয়েছে, কেউ প্রতিবাদ করেছেন, কেউ সমবেদনা জানিয়েছেন। আমাদের মনে হয়েছে। এতে করে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। সেই বিভ্রান্তি অপলোপনের জন্য কিছু ব্যাখ্যা আমাদের দেয়া দরকার। তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন সমার্থক নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও একজন কমিশনার। একাধিক সদস্য নিয়ে এই কমিশন গঠিত হয়, একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার হন এবং তিনি এ সংস্থার চেয়ারম্যান হন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কোনো সিদ্ধান্তে এককভাবে গ্রহণ করেন না বা করতে পারেন না।  এ জন্যই আপনাদের মাধ্যমে, আমরা বলতে চাই যে, আমরা কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেইনি। সকলকে বুঝতে হবে, এটা কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা নিগূঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তারপরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

ঢাকায় বসে নির্বাচন বন্ধ কতোটা যৌক্তিক, প্রশ্ন ওবায়দুল কাদেরের: বন্ধ হওয়া গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঢাকায় বসে সেখানকার ছবি, ভিডিও দেখে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া কতোটা যৌক্তিক-বাস্তবসম্মত, কতোটা আইনসম্মত তা বিনয়ের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে ভেবে দেখতে বলবো।

বৃহস্পতিবার মোহাম্মদপুর থেকে ঢাকা নগর পরিবহনের নতুন দুটি রুটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, তারা বলেছেন প্রিজাইডিং অফিসারদের লিখিত অভিযোগ আছে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন, নিরপেক্ষ, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে অতীতে এরকম নজিরবিহীন কিছু ঘটেছে বলে মনে হয় না। কী কারণে ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হলো সেটা আমাদের প্রশ্ন। আমরা আশা করি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশন তার আইন, বিধি-বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে গণতন্ত্র ও জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নেবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

ভোটের ফলাফল ঘোষণা সিইসি পদত্যাগের দাবিতে সড়ক অবরোধ, উপজেলা পরিষদের গেটে তালা  

উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি জানানগাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচনের ভোটের ফলাফল ঘোষণার দাবিতে গতকাল সকালে ফুলছড়ি সড়ক অবরোধ করে ও উপজেলা পরিষদের গেটে তালা লাগিয়ে প্রতিবাদ জানান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। উপজেলা পরিষদের গেটের সামনে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে অবস্থান নেয় তারা। এদিকে জাল ভোট দেয়ার মামলায় বুধবার রাতেই সুজন নামে এক ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ।

সকালে নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদ চত্বরে জমায়েত হন। খণ্ড খণ্ড মিছিলে তারা বিক্ষোভ করতে থাকেন। বিক্ষোভ মিছিল বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদ ও নির্বাচন অফিস ঘেরাও করে প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেন। এ সময় বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ নেতা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম পারভেজ, শহিদুল ইসলাম, এডভোকেট নুরুল আমিন, ফজলুল হকসহ অন্যরা। তারা দীর্ঘ সময় ফুলছড়ি-গাইবান্ধা সড়ক অবরোধ করে রাখেন।  এদিকে গাইবান্ধা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল মোত্তালিব জানান, ১২ই অক্টোবরে গাইবান্ধা-৫ আসনে ভোট জালিয়াতি ও অনিয়মের কারণে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। নির্বাচনে অনিয়মের কারণে প্রিজাইডিং অফিসার মাজেদুল ইসলাম বাদী হয়ে সাঘাটা থানায় সুজন নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. অলিউর রহমান বলেন, নির্বাচনে অনিয়মের কারণে একটি মামলা করা হয়েছে।

Exit mobile version