পরপর তিন দিন কয়েকটি হামলা, ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ, গোলাগুলি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর বান্দরবানে সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আজ শনিবার সেখানে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নিজেদের শক্তিমত্তা জানান দিতে এবং অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে পরপর এসব হামলা চালিয়েছে বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, কেএনএফের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান। আজ সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে সমন্বিত অভিযান শুরু হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সশস্ত্র তৎপরতা নিয়ে সরকার অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, সেখানে যৌথ অভিযান চলছে। অচিরেই পরিস্থিতি শান্ত হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে থানচি থানা লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীদের হামলা ও গোলাগুলির ঘটনার পর গতকাল দুপুরে সেখানে পরিদর্শনে যান পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক সঞ্জয় সরকার। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, গত কয়েকদিনের ঘটনায় রুমা ও থানচি থানায় ছয়টি মামলা হয়েছে।
অন্যদিকে বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংকে হামলা ও ডাকাতির ঘটনার পর গতকাল সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। পাশাপাশি তল্লাশিচৌকি ও টহল জোরদারেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
কেএনএফ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান
গত মঙ্গলবার রাতে রুমায় সোনালী ব্যাংকে হামলার সময় ব্যাংকের অপহৃত ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দীনকে উদ্ধারের পর গতকাল পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছে র্যাব। এ বিষয়ে জানাতে গতকাল বেলা ১১টায় বান্দরবানের জেলা পরিষদ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে কেএনএফের সাম্প্রতিক হামলার পেছনে দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে বলে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক খন্দকার আল মঈন। প্রথমত, টাকার প্রয়োজনে লুটপাট ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, সক্ষমতা প্রদর্শন করা। তাঁর মতে, কেএনএফ তাদের সমর্থক ও প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দেখাতে চাইছে, তারা যথেষ্ট শক্তিশালী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী।
এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত সাঁড়াশি অভিযানে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানান র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি ও পুলিশের যৌথ এই অভিযান কেএনএফ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত চলবে। সন্ত্রাসীদের দমনে পাহাড়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মতো সব ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হবে।
এর আগে ২০২২ সালের অক্টোবরে বান্দরবানের পাহাড়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে কেএনএফের একাধিক আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল র্যাব। সেখান থেকে ধর্মভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের পাশাপাশি কেএনএফের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তী সময়ে স্থানীয়ভাবে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ গঠন করে আলোচনাও চলছিল।
এরই মধ্যে মঙ্গলবার রাতে এবং বুধবার দুপুরে বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র লোকজন। তারা টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে, একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পুলিশ ও আনসারের ১৪টি অস্ত্র ও গুলি লুট করে নিয়ে যায়। এসব ঘটনায় কেএনএফ জড়িত বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ নিয়ে দুই উপজেলার মানুষের ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এরপর দুই পক্ষে ব্যাপক গোলাগুলি হয়।
গতকাল র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কেএনএফের সন্ত্রাসীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এই লক্ষ্যে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি কাজ করছিল। কিন্তু সেই সুযোগে কেএনএফের সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ, অস্ত্র লুট, পুলিশ ক্যাম্পে গুলিবর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম চালিয়েছে।
পরিবারের কাছে ফিরলেন ব্যাংক ব্যবস্থাপক
মঙ্গলবার রাতে রুমা থেকে অপহৃত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দীন প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সন্ত্রাসীদের কবল থেকে মুক্ত হন। তাঁকে উদ্ধার করে র্যাবের বান্দরবান ক্যাম্পে আনা হয়। গতকাল দুপুরে নেজাম উদ্দীনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে র্যাব। এরপর তিনি বান্দরবান জেলা সদরের বাসায় ফেরেন।
নেজাম উদ্দীন সাংবাদিকদের জানান, সবার সহযোগিতা ও দোয়া-আশীর্বাদে তিনি ফিরে এসেছেন। এ জন্য সবার কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। এ সময় পাশে তাঁর স্ত্রী মাইসুমা ইসলামও ছিলেন।
অপহরণের পর বারবার স্থান বদল
অপহরণের পর নেজাম উদ্দীনকে নিয়ে কেএনএফের অস্ত্রধারীরা বেশ কয়েকবার স্থান বদল করেছিল বলে র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এ সময় তাঁকে খেতে দেওয়া হয় কলার পাতায় মোড়ানো গরম ভাত, ডাল ও ডিম ভাজি।
কেএনএফের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর নেজাম উদ্দীন র্যাবের কাছে তাঁর বন্দিদশার বিবরণ দিয়েছেন।
র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে কেএনএফের শতাধিক অস্ত্রধারী সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখায় অতর্কিতে হামলা চালায়। তারা ব্যাংকের নিরাপত্তায় দায়িত্বরত পুলিশ ও আনসার সদস্য এবং অন্য লোকজনকে জিম্মি করে। পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কাছ থেকে দুটি সাব-মেশিনগানসহ (এসএমজি) ১৪টি অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে টাকা লুটের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দীনকে অপহরণ করে।
র্যাবের বর্ণনা অনুযায়ী, অস্ত্রের মুখে ধরে নেওয়ার পর সন্ত্রাসীরা নেজাম উদ্দীনকে চোখ বেঁধে বেথেলপাড়ার পাশ দিয়ে ঝিরির পথে নিয়ে যায়। কিছু দূর নিয়ে চোখ খুলে দিয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা হেঁটে এক নির্জন জঙ্গলে নিয়ে তাঁকে ঘুমাতে দেওয়া হয়। পরদিন বুধবার সকাল সাড়ে সাতটায় নাশতা খাইয়ে পাহাড়ি ঝিরি ধরে এবং পাহাড় অতিক্রম করে আরেকটি ঝিরিতে নেওয়া হয়। গভীর খাদে ওই ঝিরিতে ৩০-৩৫ জন অস্ত্রধারীর সামনে তাঁকে কলাপাতায় মোড়ানো গরম ভাত, ডাল ও ডিম ভাজি খাওয়ানো হয়। খাওয়া শেষে আবার হাঁটা শুরু। আরেকটি জায়গায় নিয়ে বিশ্রাম করার জন্য ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় দেয় তারা। সেখান থেকে বুধবার রাত আটটার দিকে তাঁকে টংঘরে (মাচাং ঘর) নিয়ে নুডলস খেতে দিলে তিনি খাননি। ওই টংঘরে পাঁচজন অস্ত্রধারীর সঙ্গে রাতে তাঁকে ঘুমাতে দেওয়া হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে সেখান থেকে এক ঘণ্টা হেঁটে আরেক জায়গায় নিয়ে রাখা হয়। সেখানে এক ঘণ্টা বিশ্রাম। তারপর মোটরসাইকেলে করে আরেকটি নতুন জায়গায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁকে উদ্ধার করে র্যাব।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, কেএনএফের সন্ত্রাসীরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দীনকে পরিবারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করার সুযোগ দিয়েছে। তারা এ বিষয়ে প্রশাসনের কাউকে না জানানোর জন্য সতর্ক করে। ওই সূত্র ধরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় রুমা বাজার ও বেথেলপাড়ার মধ্যবর্তী স্থান থেকে নেজাম উদ্দীনকে উদ্ধার করা হয়।
তবে সন্ত্রাসীরা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কাছ থেকে যেসব অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে গেছে, সেগুলো এখনো উদ্ধার করা যায়নি। খন্দকার আল মঈন বলেন, অস্ত্রগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। অপরাধীদের শনাক্ত করতে সিসিটিভি ফুটেজ ও বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
prothom alo