কিন্তু মান-সম্মান ও ভয়ের কারণে অনেকে মুখ খুলেন না। ওই নারীর স্বামী সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে মামলা করায় তাকে বাহবা দিচ্ছেন অনেকে।গণধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীর স্বামী আশুলিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। ওই মামলায় তিনি ছয়জনকে আসামি করেন। সাভার মডেল থানা পুলিশ ও আশুলিয়া থানা পুলিশ যৌথভাবে এ ঘটনায় অভিযান চালিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাসহ চারজনকে ঘটনার রাতেই গ্রেপ্তার করেছে। এ ঘটনায় এখনো ২ জন পলাতক। গ্রেপ্তার চারজন হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, একই বিভাগের সাগর সিদ্দিকী ও হাসানুজ্জামান এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান। পলাতক আছেন ভুক্তভোগীর পূর্বপরিচিত মো. মামুনুর রশিদ এবং স্বামীকে আটকে রাখায় সহায়তা ও মারধর করা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মুরাদ। ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ মোস্তাফিজকে সাময়িক বহিষ্কার এবং পরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তাকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে।
যা ঘটেছিল: পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, ভুক্তভোগী নারী ও তার স্বামী আশুলিয়ায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে একই বাসায় পাশাপাশি কক্ষে ভাড়া থাকতেন মামুনুর রশিদ ওরফে মামুন। শনিবার ভুক্তভোগী নারীর স্বামীকে মোবাইল ফোনে মামুন জানান, তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে কিছুদিন তার পরিচিত মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে থাকবেন। তাই ক্যাম্পাসে এসে তার সঙ্গে দেখা করার কথা বলেন মামুন। মোবাইলে কথা বলার কিছু সময় পর ভুক্তভোগীর স্বামী ক্যাম্পাসে আসেন। তখন মীর মশাররফ হোসেন হলের একটি কক্ষে মুস্তাফিজ ও মুরাদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
মামুন তখন তাকে বলেন, সাভারের একটি ইলেকট্রনিকসের দোকানে তারা কিছু টাকা পাবেন। তবে দোকানদার টাকা দিতে চাচ্ছে না। ওই টাকার বিনিময়ে ভুক্তভোগীর স্বামীকে বাসার জন্য টিভি, ফ্রিজসহ অন্যান্য আসবাবপত্র নিয়ে সমপরিমাণ টাকা মামুন তাকে দেয়ার প্রস্তাব দেন। ভুক্তভোগী ও তার স্বামী আগে থেকেই পরিবারের জন্য কিছু আসবাবপত্র কিনতে চেয়েছিলেন। ওই সময় মামুন ভুক্তভোগীর স্বামীকে বলেন, যেহেতু আমি কিছুদিন হলে থাকবো তাই আমার ব্যবহারের কাপড়গুলো আপনার স্ত্রীকে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসতে বলেন। তখন স্ত্রীকে ফোন করে কাপড় নিয়ে ক্যাম্পাসে আসার জন্য বলেন। রাত আনুমানিক ৯টার দিকে ভুক্তভোগী নারী ক্যাম্পাসে আসেন। ক্যাম্পাসে আসার পর তাকে মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে আসার জন্য বলা হয়। সেখানে আগে থেকেই মামুন, মুস্তাফিজ, মুরাদ ও ভুক্তভোগীর স্বামী হলের সামনে অবস্থান করছিলেন। একপর্যায়ে মুরাদ ভুক্তভোগীর স্বামীকে হলের এ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে নিয়ে মারধর করে বেঁধে ফেলেন। আর মুস্তাফিজ ও মামুন নারীকে নিয়ে হলের পাশের বোটানিক্যাল গার্ডেনের জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে। দেড় ঘণ্টা পর ভুক্তভোগী নারী ও তার স্বামীকে ছেড়ে দেয় তারা। ঘটনার বিচারের দাবিতে প্রথমে তারা আশুলিয়া থানায় এবং পরে সাভার মডেল থানায় যান।
জাবি সূত্র বলছে, ভুক্তভোগীর স্বামী ক্যাম্পাসে মামুনের সঙ্গে দেখা করতে আসার পরপরই ৩১৭ নম্বর কক্ষে নিয়ে মারধর করে আটকে রাখা হয়। পরে সেখান থেকেই ভয়ভীতি দেখিয়ে তাকে দিয়েই স্ত্রীকে কাপড় নিয়ে আসার অজুহাতে ফোন দেওয়ানো হয়। ভুক্তভোগী যখন হলের সামনে আসেন তখন মামুন ও মুস্তাফিজ তাকে বলেন, তার স্বামী জঙ্গলের দিকেই আছে। তাই সেদিকে যেতে হবে। মামুন পূর্বপরিচিত থাকায় তাকে বিশ্বাস করে তিনি জঙ্গলের দিকে যান। পরে তাকে ধর্ষণ করা হয়।
ঘটনার পরপরই ভুক্তভোগী নারী সাংবাদিকদের জানান, মামুন আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতো। পূর্ব পরিচিত হওয়ায় তিনি প্রথমে আমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে যান। এরপর তার রেখে যাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে যেতে বললে, আমি ক্যাম্পাসে যাই। তার সঙ্গে মুস্তাফিজ ছিল। তখন তারা আমার স্বামী অন্যদিক থেকে আসবে বলে আমাকে হলের পাশের জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে তারা আমাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, ঘটনার পর বিষয়টিকে অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই নেন মুস্তাফিজ, মামুন ও অন্যরা। তারা নির্ভয়ে হলেই অবস্থান করছিলেন। কিন্তু ভুক্তভোগী নারীকে জঙ্গল ও তার স্বামীকে হল থেকে ছেড়ে দেয়ার পর তাদের দুজনের মধ্যে দেখা হয়। ঘটনার সময় তাদের দুজনের মোবাইল ফোন ধর্ষকদের কাছে ছিল। কিন্তু তাদেরকে ছাড়ার সময় মোবাইল দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে সোজা বাসায় যাওয়ার কথা বলে। ভুক্তভোগীর সঙ্গে তার স্বামীর দেখা হওয়ার পর তিনি গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানান। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে ঘটনা শেয়ার করেন তারা। পরে শিক্ষার্থীরা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিলে বিষয়টি পুরো ক্যাম্পাসে জানাজানি হয়। শিক্ষার্থীরাই তখন ভুক্তভোগী ও তার স্বামীকে আশুলিয়া থানায় গিয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলেন। তারা থানায় গিয়ে পুলিশকে সবকিছু খুলে বলেন। ততক্ষণে ক্যাম্পাসে এ খবর চাউর হয়ে যায়। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা হল ঘেরাও করতে আসেন। খবর চলে যায় শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে। পুলিশকেও খবর দেয়া হয়। কিন্তু স্পট আশুলিয়া থানা ও হল সাভার থানায় হওয়াতে পুলিশের মধ্যে বুঝাপড়ার ঝামেলা সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ ক্যাম্পাসে হাজির হয়। শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলের সামনে এসে গেইট আটকে দেন। সামনের দিকে বের হওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় তখন মামুন ও মুস্তাফিজকে মীর মশাররফ হোসেন হলের রান্নাঘরের গেইট ভেঙে পালাতে সহযোগিতা করে হলের কয়েকজন শিক্ষার্থী।
ফুঁসে উঠেছেন শিক্ষার্থীরা: ক্যাম্পাসে গণধর্ষণের ঘটনা প্রচার হওয়ার পর থেকেই ফুঁসে উঠেছে জাবি’র সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল থেকেই ভিসি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ ও দাবি জানাচ্ছে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ‘আগুন জ্বালো একসাথে, ধর্ষকের গদিতে’, ‘ধর্ষকদের পাহারাদার হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘অছাত্র ধর্ষণ করে প্রশাসন কি করে’, ‘ব্যর্থ প্রশাসন মুখ লুকাও মুখ লুকাও’, ‘আমাদের ক্যাম্পাসে নিপীড়ন থাকবে না’, ‘বাহ প্রশাসন চমৎকার ধর্ষকদের পাহারাদার’- এমন স্লোগান আর বক্তব্য দিয়ে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ধর্ষকদের কঠিন শাস্তি, বহিরাগতদের হল থেকে বিতাড়িত, প্রশাসনের ব্যর্থতা, ক্যাম্পাসে সুস্থ পরিবেশ, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয় সামনে নিয়ে আসছেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে শিক্ষকরাও একাত্মতা পোষণ করেছেন।
প্রত্নতত্ত্ব ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলী মানবজমিনকে বলেন, একজন বহিরাগত ও আরেকজন ছাত্রলীগ নেতা মিলে এক নারীকে গণধর্ষণ করে। আর এই দুই ধর্ষককে পালিয়ে যেতে আরও ৩ জন সহযোগিতা করেছে। এসব ঘটনার প্রতিবাদে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখানে আন্দোলন করছি তিন দফা দাবি নিয়ে। আমরা চাই রাষ্ট্রীয় আইনে ধর্ষণের বিচার, বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে মামলা করতে হবে। আরেকটা হলো ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে বহিরাগতরা জড়িত। তাই প্রতিটা হল থেকে বহিরাগতদের বিদায় করতে হবে। কারণ ১২ বছর আগের সাবেক শিক্ষার্থীরাও এখনো হলে অবস্থান করছে। তিনি বলেন, প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু কেউ ভয়ে মুখ খুলে না। প্রশাসনের দুর্বলতার কারণেই এমনটা ঘটছে।
ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক মাসুম শাহরিয়ার মানবজমিনকে বলেন, অহরহ এই ঘটনাগুলো ঘটছে। অনেকেই এখানে বেড়াতে আসলে তাদের মোবাইল, টাকা, ব্যাগ রেখে দেয়া হয়। নারীদের লাঞ্ছিত করা হয়। নিরাপত্তাকর্মীরা এসব জানে। শনিবারের ঘটনা প্রচার হয়েছে বলে সবাই জানছে। যারা এগুলো করছে তারা প্রশাসনের ছত্রছায়ায় আছে।
ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে রোববার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন চার শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী। পরে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তিন দিনের মধ্যে অছাত্রদের হল থেকে বের করাসহ তিন দফা দাবি জানান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাদের অন্য দাবিগুলো হলো- বিশ্ববিদ্যালয় বাদী হয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করা ও জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।
মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, ‘একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে হলে জিম্মি করে তার স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গজব নাজিল হওয়া উচিত, আমাদের সবার ধ্বংস হয়ে যাওয়া উচিত। এই ধর্ষণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যতদিন প্রশাসনের মদতে এই ক্যাম্পাসে অছাত্র, অবৈধ ছাত্র অবস্থান করবে, ছাত্রলীগ নামধারী অছাত্ররা নিয়োগ বাণিজ্য করবে, চাঁদাবাজি করবে ততদিন এই ক্যাম্পাস থেকে অপরাধ দূর করা সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৯৯৮ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধর্ষকদের বিতাড়িত করেছি। সন্ত্রাসীদের বিতাড়িত করেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরকে খুনিদের মদত দেয়ায় তাকে বিতাড়িত করেছি। কিন্তু আজকে আবার দেখতে পেয়েছি আমাদের এই ক্যাম্পাসে একদল নষ্ট মানুষ যারা ক্ষমতায় বসে আছে, যারা নির্লজ্জ, অসভ্য যাদের কোনো বোধ নেই, বুদ্ধি নেই তারা ওই চেয়ার দখল করে বসে আছে।’
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সোহেল আহমেদ, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আনিছা পারভীন জলি প্রমুখ। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সঙ্গে দেখা করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তখন দ্রুত সময়ের মধ্যে দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য উপাচার্যকে আল্টিমেটাম দেন তারা। পরে দুপুর দুইটায় ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিকাল ৪টায় একই দাবিতে মানববন্ধন করেন বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ও তার অনুসারী এবং সাধারণ সম্পাদকের অংশের বিদ্রোহী নেতাকর্মীরা অংশ নেন। ধর্ষণের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ’। এ ছাড়া ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবি এবং দায়িত্বে অবহেলার কারণে প্রক্টর ও হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ চার দফা দাবিতে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় মশাল মিছিল করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান মানবজমিনকে বলেন, ভুক্তভোগীর স্বামী মামলা করেছেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আরেকটি মামলা করা হবে। যারাই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাক না কেন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয় আইনে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করবো। বহিরাগতদের হোস্টেলে অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, এটা দীর্ঘদিনের একটা সংকট। সিট আছে ৮ হাজারের মতো আর শিক্ষার্থী ১৪ হাজারের মতো। এই সংকটের সুযোগ নিয়ে বহিরাগতরা হোস্টেলে অবস্থান করছে। যখন এই সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছি তখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আমরা বহিরাগতদের যেকোনোভাবে বের করবো। ছিনতাই, হ্যারাসমেন্ট নিয়ে তিনি বলেন, অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেই। তথ্য প্রমাণ থাকলে ব্যবস্থা নেয়া যায়। অনেককে বহিষ্কার করা হয়েছে। তথ্য প্রমাণ না থাকলে কঠোর শাস্তি দিতে সমস্যা হয়। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী নিয়ে তিনি বলেন, ক্ষুব্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি নিজেও ক্ষুব্ধ। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকেই ক্ষুব্ধ। তাই সময়ের তাগিদেই জরুরি সিন্ডিকেট সভা বসেছে। এই সভায় কঠোর কিছু সিদ্ধান্ত আসবে যেটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাব্বির আলম বলেন, ‘ঘটনা শুনে হলে যাই। জড়িতদের মধ্যে যারা হলে ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তাদের পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, ঘটনা শুনেই আমরা মোস্তাফিজের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছি। এ ছাড়া আমাদের সুপারিশের প্রেক্ষিতে তাকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকেও স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই।
সদ্য পদোন্নতি পাওয়া পুলিশ সুপার ও বর্তমানে কর্মরত ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস ও ট্রাফিক উত্তর বিভাগ) মো. আবদুল্লাহিল কাফী বলেন, সাভার মডেল থানা ও আশুলিয়া থানা পুলিশ যৌথভাবে তদন্ত করছে। আসামিদের পালিয়ে যাওয়ায় সহায়তা করার অভিযোগে তিন জনকে ক্যাম্পাস থেকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া সাভার থানা এলাকা থেকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত মুস্তাফিজুর রহমানকে আটক করা হয়। পলাতক আসামি মুরাদ ও মামুনকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। আসামিদের সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ভুক্তভোগীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঠানো হয়েছে।
জাবিতে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের সনদ স্থগিত, তদন্ত কমিটি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বহিরাগত এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের সনদ স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অভিযুক্তদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান ও শাহ পরানের সনদ স্থগিত এবং মো. মুরাদ হোসেন, সাগর সিদ্দিকী, সাব্বির হাসান সাগর ও হাসানুজ্জামানের সনদ স্থগিত এবং সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত করা হয়েছে।
এ ছাড়া ধর্ষণের ঘটনা তদন্তে সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদারকে সভাপতি করে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- লোক-প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ছায়েদুর রহমান, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আফসানা হক ও সদস্য সচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার (আইন) মাহতাব-উজ-জাহিদ। সভা শেষে ভিসি অধ্যাপক মো. নূরুল আলম বলেন, ‘অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের সনদ স্থগিতের পাশাপাশি তাদেরকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত করা হয়েছে। ক্যাম্পাস বহিরাগতদের প্রবেশ ও অস্থায়ী দোকানপাট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া অছাত্র ও পোষ্যদের আবাসিক হল থেকে বের হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হবে। তারা বের না হলে বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ গ্রেপ্তারকৃত চার জনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল পুলিশ আসামিদের আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করলে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাবেয়া বেগম এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে, গত শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের পাশে জঙ্গলে বহিরাগত ওই নারীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/০৩) এর ৯(৩) ধারায় একটি মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী নারীর স্বামী মো. জাহিদ মিয়া। তার প্রেক্ষিতে মূল অভিযুক্তসহ চার জনকে আটক করেছে পুলিশ। আটক মূল অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এবং শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এ ঘটনার পর অভিযুক্ত মোস্তাফিজকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়।
এ ছাড়া হল থেকে অভিযুক্তদের পালাতে সহযোগিতা করেছেন এমন অভিযোগে অন্য তিন জনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের সাগর সিদ্দিকী, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসানুজ্জামান। তাদের মধ্যে হাসানুজ্জামান বাদে বাকি সবাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। তবে আরেক অভিযুক্ত বহিরাগত যুবক মামুন (৪৫) পলাতক রয়েছেন। পাশাপাশি অভিযুক্তদের পালাতে সহায়তা করায় অভিযুক্ত মুরাদ ও শাহ পরান নামে আরও দু’জন পলাতক রয়েছেন। ভুক্তভোগীর ভাষ্য, পূর্ব পরিচিত হওয়ায় ওই দম্পতিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে আনে মামুন। পরে তার স্বামীকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে আটকে রাখেন অভিযুক্তরা। পরে স্বামীর কাছে নেয়ার কথা বলে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী।
এদিকে ধর্ষণের ঘটনা জানাজানির পর গত শনিবার রাতে মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ‘ক্যাম্পাসে ধর্ষক কেন, প্রশাসন জবাব চাই’; ‘ধর্ষণমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’; ‘ধর্ষকদের পাহারাদার, হুঁশিয়ার সাবধান’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
সূত্র : মানবজমিন