গত কয়েক মাস ধরে নানা অপকর্মের কারণে বারবার আলোচনায় আসছে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠনের নাম। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই সংগঠনের ব্যানারে কর্মসূচি, সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলার মতো একাধিক ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক ও তাঁর সঙ্গে থাকা কর্মীদের ওপর চড়াও হয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ আবার সামনে এসেছে। মঞ্চের হামলায় ভিপি নুরুলসহ অন্তত ২৪ জন আহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে গুরুতর আহত হন অন্তত চারজন।
এ ঘটনার পর ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। এরা কারা, কেন বারবার হামলা করা সত্ত্বেও এদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? ক্ষমতাসীন দল বা তাদের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক আছে কি না?
চলতি বছরে এই মঞ্চে ভাঙন হয়েছে, দুটি পক্ষ একে অপরকে বহিষ্কার করেছে, মধুর ক্যানটিনে ছাত্রদলের ওপর হামলা করেছে, ভিপি নুরুলের ওপর একাধিক বার হামলা করেছে। একটি অংশ ছাত্রলীগ থেকে পদচ্যুত নেতা গোলাম রাব্বানীর পক্ষে অবস্থানও নেয়। এসব কারণে বারবার আলোচনাও হয়।
এমন অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল তা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। সংগঠনটি গঠনের পরপরই এতে ভাঙন হয়। মূল সংগঠন থেকে আলাদা হয়ে যায় সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। এতে দুই অংশই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নাম ব্যবহার করে উগ্র আচরণ করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের মূল অংশটি কথা বার্তায় ‘সক্রিয়’ ও উগ্রতা ছাড়ালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখাটি নিজেদের মূল মঞ্চ দাবি করে মারমুখী সব কর্মসূচি পালন করতে থাকে।
মূলত সেই সময় থেকে এই মঞ্চের ব্যানারে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা দেশের বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করছিলেন। চলতি বছরের ১০ অক্টোবর গণমাধ্যমে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমিনুল ইসলাম ও আল আমিনকে সংগঠন বিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেন মঞ্চের আহ্বায়ক ও মুখপাত্র জামাল উদ্দিন।
এই ঘটনার পর জামাল উদ্দিন ও আসিফ ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চে’র কেউ নন বলে দাবি করে বক্তব্য দেন আমিনুল ও আল মামুন এবং নিজেদের প্রকৃত ‘সংগঠন’ বলে দাবি করতে থাকে।
গতকাল রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চে’র ব্যানারে যে মিছিলটি হয় এবং মিছিল শেষে ভিপি নুরুলসহ অন্যদের ওপর হামলা চালায় সেই মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন আমিনুল ইসলাম ও আল মামুনের সমর্থক অংশটি। এই অংশটিকে দুর্নীতির অভিযোগে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ হারানো গোলাম রাব্বানী মদদ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি কোনো সংগঠনের সঙ্গে নেই। ডাকসুর নির্বাচিত জিএস তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে একটি অংশ অনেক দিন ধরেই অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ. ক. ম জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছরের মার্চ এপ্রিলের দিকে তাঁরা কাজ শুরু করেন। ডাকসু নির্বাচনের পরে এই কার্যক্রম জোরালো হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের স্বার্থ রক্ষা তাঁদের কাজের উদ্দেশ্য। জামাল উদ্দিন বলেন, আমিনুল ইসলাম ও আল মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতৃত্বে ছিলেন। কিন্তু তাঁদের নানা অপকর্ম, একে ওকে মারধরের কারণে গত অক্টোবরে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁর দাবি, ছাত্রলীগের বিদ্রোহী যে অংশটি আছে, যারা বহিষ্কার হয়েছে তাদের মদদে এরা নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে।
আমিনুল ইসলাম আজ প্রথম আলোকে বলেন, হামলা তাঁরা করেননি। নুরুল বহিরাগতদের নিয়ে নানা উসকানিমূলক আচরণ করেছে। হামলার সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আ ক ম জামাল উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের কেউ নন। তিনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানও নন। তাঁকে আহ্বায়ক করা হয়েছে সম্মানের জায়গা থেকে। তিনি আর কমিটিতে নেই। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ তাঁকে বাদ দিয়েছে। অবশ্য আমিনুল বলেন, এখন আর আহ্বায়ক বা অন্য কোনো কমিটি নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ টিএসসি ভিত্তিক কোনো সংগঠন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার্ড কোনো সংগঠনও এটা নয়। তিনি বলেন, আগে এবং এখন যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলোর তদন্ত চলছে। যারাই এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন।
গতকাল রাতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মুনতাসীর মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কারা করেছে তা জানি না। আর এমন নাম দিয়ে কেউ এ ধরনের কাজ করবে তা সমর্থনযোগ্য নয়।’