Site icon The Bangladesh Chronicle

কারাগারে বিএনপি নেতাকর্মীর মৃত্যু, হয়রানির শিকার হচ্ছেন স্বজনরা

কারাগারে বিএনপি নেতাকর্মীর মৃত্যু, হয়রানির শিকার হচ্ছে স্বজনরা

সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেছেন। অনেকেই কারাভোগ করে মুক্তি পেয়েছেন। কেউ কেউ ফিরেছেন লাশ হয়ে। কেউ এখনো বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। তবে কারা হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না তাদের স্বজনরা।

স্বজনদের দাবি- রাজনৈতিক কারণেই কারা মৃত্যু হয়েছে তাদের। এদিকে, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নিঃস্ব, অসহায় ও মানবেতর দিনযাপন করছে পরিবারগুলো। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে স্ত্রী, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ। দল থেকে খোঁজ নিলেও স্বজন হারানোর আর্তনাদ যেন শেষই হচ্ছে না। গত ৬ মাসে কারা হেফাজতে ১৩ নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। বিএনপির দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, এই সময়ে কারা হেফাজতে ১৫ নেতার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণে এ মৃত্যু বলে অভিযোগ দলটির।

বিএনপির একদফার আন্দোলনের মধ্যেই ১১ নভেম্বর গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান খুলনা বাটিয়াঘাটার যুবদল নেতা কামাল হোসেন মিজান। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি কারা হেফাজতে মৃত্যু হয় তার। ৩ ছেলেমেয়ে নিয়ে বর্তমানে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন তার অসুস্থ স্ত্রী। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা তিনি। ঘিরে ধরেছে অভাব-অনটন। চিকিৎসা নিয়েও হিমশিম খাচ্ছেন। আর্থিক সংকটে ছেড়ে দিয়েছেন ভাড়া বাসাও। উঠেছেন মেয়ের সংসারে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ৬ বছর বয়সি একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ।

আহাজারি করতে করতে মিজানের বড় মেয়ে মিতু যুগান্তরকে বলেন, বাবাকে নির্যাতন করে মারা হয়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ, মারা যাওয়ার দিন সকালেও তার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। গ্রাম থেকে মায়ের চিকিৎসার কাগজপত্র আনতে গিয়ে গ্রেফতার হন তিনি। এখন মায়ের চিকিৎসার ব্যাঘাত ঘটছে। পরিবারে উপার্জনকারী কেউ নেই। ছোট ভাই মাদ্রাসায় পড়ে। আমার মা-ভাইকে কে দেখবে? কিভাবে মায়ের চিকিৎসা করব? নানা চিন্তায় পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বিএনপি থেকে নানা সময়ে পাশে দাঁড়ালেও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। নেতারা খোঁজ নিচ্ছেন।

এভাবে আর কত দিন অনিশ্চিত জীবন কাটাব। বাবার কথা মনে পড়লে কান্নায় ভেঙে পড়েন নওগাঁর মতিবুল মণ্ডলের মেয়ে পুতুল। যুগান্তরকে বলেন, বাবার কিভাবে মৃত্যু হলো জানতে পারলাম না। মৃত্যুর সময় পানি খেতে পেরেছেন কিনা তাও জানি না? এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। আর কারও জীবনে যেন এমন ঘটনা না ঘটে। বাবা ছাড়া চার ভাইবোন ও মায়ের জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে। দিন-রাত কান্নাকাটি করছেন মা ও ভাইবোনেরা। চোখের সামনে এমন চিত্র মেনে নেওয়া কষ্টকর। গত বছরের ২৫ নভেম্বর কারা হেফাজতে মৃত্যু হয় চট্টগ্রামে মোহড়া ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা গোলাপুর রহমানের। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন গ্রেফতার হন তিনি। স্বজনদের অভিযোগ, গোলাপুর রহমান গ্রেফতারের আগে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। তাকে বিএনপির রাজনীতি করার জন্য নির্যাতন করে মারা হয়েছে। তার ছেলে মিজান কান্নাজড়িত কণ্ঠে যুগান্তরকে বলেন, অনেকদিন হলো বাবা নেই। তার শূন্যতা কোনো ভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারছি না। মা প্রায় বাবার জন্য বিলাপ করেন। অভিভাবক হারিয়ে এখন অনেকটাই দিশেহারা। বিএনপি থেকে প্রায়ই খোঁজ নেওয়া হয়। তারপরেও সব সময় দুশ্চিন্তা তাড়া করে বেড়ায়।

প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে কয়েকটি পরিবারের সদস্য জানান, কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। নানাভাবে পরিবারগুলোকে চাপে রাখা হচ্ছে। এমনকি তাদের স্বজনদের রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিনযাপন করছেন তারা।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, সরকারের নির্যাতনের কারণে আমাদের অনেক নেতাকর্মীর কারাগারে মৃত্যু হয়েছে। এগুলো অস্বাভাবিক মৃত্যু। জেল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় পরিকল্পিতভাবে এদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। নির্যাতনে অসুস্থ হলেও কোনো ওষুধ, চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। অবিচার করেছে সরকার। এই নির্মমতার জন্য জনগণের মধ্যে একটা ক্ষোভ ও ক্রোধ দেখছি। প্রত্যেকেই চায় আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এ সরকারের পতন হোক।

তিনি বলেন, কারা হেফাজতে নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো আমাদের একটি চলমান প্রক্রিয়া। সব সিনিয়র নেতারা টিম অনুযায়ী প্রতিদিন তাদের বাড়ি যাচ্ছে। সার্বিক খোঁজখবর নিচ্ছেন। যতটুকু সম্ভব বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করছেন।

জানা যায়, বিএনপির একদফা আন্দোলন ঘোষণার পরবর্তী সময়ে প্রায় ৩০ হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। ২১ আগস্ট থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে অন্তত ১৩ বিএনপি নেতা কারাগারে মারা যান। এর মধ্যে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যু হয়। যাদের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

ছয় মাসে মৃত্যুবরণকারী নেতাদের মধ্যে ২১ আগস্ট কেরানীগঞ্জ কারাগারে মারা যান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির মালিবাগ ইউনিটের নেতা আবুল বাশার। ২৯ জুলাই ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে যাত্রাবাড়ী এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় ওইদিন মহানগর দক্ষিণের ৫৩ নাম্বার ওয়ার্ড বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক ইদ্রিস আলীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১০ আগস্ট কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। সাতক্ষীরা শ্যামনগরের বিএনপির নেতা সুরাত আলী গাজীর মৃত্যু হয় ১৭ সেপ্টেম্বর। ২৮ অক্টোবরের ঘটনা পরবর্তী কারাগারে মারা যাওয়া নেতাদের মধ্যে রয়েছেন, চট্টগ্রামের চানগাঁও থানার ওয়ার্ড বিএনপির নেতা গোলাপুর রহমান। মহানগর দক্ষিণের ওয়ারি বিএনপির নেতা ইমতিয়াজ হাসান বুলবুলকে গ্রেফতার করা হয় ২৪ নভেম্বর। কাশিমপুর কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে ৩০ নভেম্বর তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ১১ ডিসেম্বর কাশিমপুর কারাগারে মৃত্যু হয় গাজীপুরের শ্রীপুরের ইউনিয়ন বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামানের। ৭ ডিসেম্বর কারা হেফাজতে মৃত্যু হয় নাটোরের বিএনপি নেতা আবুল কালাম আজাদের। ৭ নভেম্বর রাজশাহীর মুনিরল ইসলাম, ২০ ডিসেম্বর নওগাঁর মতিবুল মণ্ডল, ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা মুগদার ফজলুল রহমান কাজল, ৩ জানুয়ারি খুলনার কামাল হোসেন মিজান, ২৯ জানুয়ারি সাতক্ষীরার আব্দুস সাত্তার, ৮ ফেব্রুয়ারি রংপুরের মনোয়ারুল ইসলামের কারা হেফাজতে মৃত্যু হয়।

 যুগান্তর

Exit mobile version