ভূমিকা : কাক বা কাউয়ার কোনো স্বভাব বা খাসলত মানুষের মাঝে দেখা গেলে তাকে বলা হয় কাউয়া স্বভাব। এরা অল্প পানিতে পাখা ঝাপটিয়ে গোসল সারে। তাই অল্পপানিতে দ্রুত গোসল করলে বলা হয় কাকস্নান বা কাউয়া গোসল। তেমনি করে দেশের পুরো শরীরকে শুকনো বা বঞ্চিত রেখে লোক দেখানো গুটিকয় অবকাঠামোগত উন্নয়নকে বলা যেতে পারে ‘কাউয়া উন্নয়ন।’ দেশে যে গণতন্ত্র শুরু করা হয়েছে, তাকে কাউয়া গণতন্ত্র বলা যেতে পারে।
‘কাউয়া’ নিয়ে এই কথনটি শুরু করেছেন জনাব ওবায়দুল কাদের। ‘দলে কাউয়া ঢুকেছে’ বলে তিনি দলের নেতাকর্মীদের সাবধান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশবাসী টের পেয়েছে, পুরো দেশটিই কাউয়াদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এই কাউয়ারা গ্রিক দেবী থেমিসকে ‘থেমিস খাতুন’-এ রূপান্তরিত করে মনের মণিকোঠায় বসিয়ে ফেলেছে। আমাদের জাতীয় মানসে এই ‘থেমিস খাতুনে’র ভাবধারা আগমনের সাথে সাথে ন্যায়বিচার যতটুকু ছিল তাও উধাও হওয়র শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ন্যায়ের মূর্তি বা প্রতীকটি জাতীয় মানসে মারাত্মকভাবে গেড়ে বসেছে। কিন্তু ন্যায়ের বোধটি ((Sense of justice) অপসারিত হয়েছে। দেবী থেমিসের নকল বা বিকৃতি এই থেমিস খাতুনকে একবার সামনে বসানো হচ্ছে, আরেকবার পেছনে নেয়া হচ্ছে। অনেকের মতে, এ ধরনের শিল্পকর্ম যে কোনো গ্রামের একজন কুমার পাশের বাড়ির রাজমিস্ত্রিকে নিয়ে বানিয়ে ফেলতে পারে। কারণ এটা কোনো মৌলিক সৃষ্টি নয়, নকল বা অনুকরণ। বরং হাস্যকর এই ‘থেমিস খাতুন’ হাইকোর্ট ভবনের নান্দনিকতাকে বিনষ্ট করছে বলে অনেকে মতপ্রকাশ করেছেন।
এতে সার্বিক বিশ্বাসের দোদুল্যমানতা, মেধাহীনতা এবং সাংস্কৃতিক হীনম্মন্যতার কদর্য রূপটিই অত্যন্ত করুণভাবে ফুটে উঠছে। কিছু দিন আগে এই সুপ্রিম কোর্ট ভবনের গেট থেকে একজন সাক্ষীকে দিনদুপুরে অপহরণ করা হয়েছে। যে কাউয়ারা অপহরণ করেছে, তারা ভেবেছেÑ এটা কেউ দেখেনি। আমরাও ভান করেছি, ‘নাহ্ আমরা কিচ্ছু দেখি নাই, কিচ্ছু শুনি নাই।’
অবুঝ শিশুদের কাছ থেকে কোনো জিনিস আড়াল করতে বড়রা বলে থাকেন, ‘কাউয়া বা চিলে নিয়ে গেছে।’ ফলে শিশুকাল থেকেই কাউয়ার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়। শিশুটি আর একটু বড় হয়ে মূল ব্যাপারটি ঠাহর করতে পারে। শুধু ডানাওয়ালা কাউয়া নয়। শিশুটি তার চারপাশে ডানা ছাড়া অনেক কাউয়াও আবিষ্কার করে। জীবনের ঊষালগ্নেই তার মনে অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি হয়ে যায়। সেই প্রশ্নের সুরাহা সারা জীবনেও সে করতে পারে না।
এরপর যত চোখ খোলে তত নানা কিছিমের ও নানা বর্ণের কাউয়ার সাক্ষাৎ ঘটে। এরা কেউ রাজনীতিক কাউয়া, কেউ প্রশাসনিক কাউয়া, কেউ সাংস্কৃতিক কাউয়া, কেউ চেতনার কাউয়া। এই কাউয়াদের সবার দৃষ্টি মূলত এক জায়গায়- কিভাবে বিভিন্ন কৌশলে জনগণের সম্পদ ও সম্মানকে ছোঁ মেরে নেয়া যায়। এই কাউয়াদের নিয়েই মূলত আজকের এই কাউয়া কথনটি সাজানো হয়েছে।
১. শুধু দলে নয়, মনেও ‘কাউয়া’ ঢুকে পড়েছে
আজকের এই কাউয়া কথনের বড় অংশে জনাব ওবায়দুল কাদেরের বিভিন্ন মন্তব্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কারণ এ দেশে কাউয়া কথনের ইতিহাস তাকে বাদ দিয়ে রচনা করা অসম্ভব। ‘কথার জাদুকর’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া এই নেতা এক সমাবেশে সরাসরি বলেছেন, ‘ক্ষমতা বেশি দিন থাকে না। তাই ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে টাকা-পয়সা নিয়ে পালাতে হবে। সেটা কি ভাবেন না? এখন যে টাকা-পয়সা রোজগার করছেন, এই টাকা নিয়ে তখন পালিয়ে বেড়াতে হবে।’
সুন্দর স্বীকারোক্তি ও চমৎকার সাবধান বাণী! এক ধরনের নিরাপদ নির্গমনের রাস্তা ((safe escape rout) বাতলে দেয়াও বলা যেতে পারে এটাকে। জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে যারা এভাবে টাকা-পয়সা রোজগার করে, ইতিহাস বলে এই কাউয়ারা কখনই কোনো দলের জন্য অ্যাসেট হয় না। সময়ে এরা সবাই উড়াল দেয়। নৈতিকভাবে দুর্বল এই কাউয়ারা কখনই জনরোষের সামনে দাঁড়ানোর সাহস পায় না।
দলের নেতাকর্মীদের প্রতি উপদেশ বর্ষণের এই তরিকাটি বেশ মজার, কৌতূহলোদ্দীপকও বটে। নেতাদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি পরামর্শ দেন, তিরস্কার করেন। ‘চাটার দল সব চেটে খেয়ে ফেলছে’- এ কিছিমের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু চাটা কর্মটি বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
কথায় ও কাজে মিল নেই দেখে জনাব কাদের ছাত্রলীগ নেতাদের যারপরনাই তিরস্কার করেছেন। মন্ত্রী মহোদয়ের নিজের কথা ও কাজে কতটুকু মিল রয়েছে- সেদিকেও অনেক গবেষকের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে।
সড়ক ও সেতু তৈরি বাবদ খরচ বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশেই। রাস্তার কাউয়া না ধরে মন্ত্রী যদি নিজের মন্ত্রণালয়ের এই বড় কাউয়াদের পাকড়াও করতে পারতেন, তবে জাতির অনেক উপকার হতো।
মূল ধারার মিডিয়া এসব হিসাব-নিকাশ থেকে একটু দূরে অবস্থান করলেও অন লাইন অ্যাক্টিভিস্ট বা সিটিজেন সাংবাদিকদের অনেকেই সোচ্চার হয়েছেন। রংপুর মেডিক্যালের সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি এবং শাহবাগের ‘শিশুপীর’ হিসেবে বিবেচিত ডা: ইমরান এইচ সরকার নিচের পোস্টটি দিয়েছেন।
‘লুটপাটের একটি সরল হিসাব, পড়–ন… জানার দরকার আছে, অবকাঠামো খাতে নাকি দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। সামগ্রিক চিত্র দেখলে যা মনে হয়, জোয়ার বইছে ঠিকই তবে উন্নয়নের না, লুটপাটের। সড়কপথ, রেলপথ, ফ্লাইওভার, সেতু; এই চারটি খাতে আমাদের দেশে খরচের সাথে অন্যান্য দেশে খরচের একটি তুলনা করি :
# সড়কপথ : চার লেন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় : বাংলাদেশ- ৫৯ কোটি টাকা; ইউরোপ- ২৮ কোটি টাকা; চীন- ১৩ কোটি টাকা; ভারত- ১০ কোটি টাকা।
# রেলপথ : সাধারণ রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় : বাংলাদেশ- ২৫০ কোটি টাকা (ঢাকা-পায়রা বন্দর), ভারত- ১২ কোটি টাকা, চীন- ১২.৫ কোটি টাকা, পাকিস্তান- ১৫ কোটি টাকা।
# ফ্লাইওভার : ফ্লাইওভার নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় : বাংলাদেশ- ১৮০ কোটি টাকা (মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার), কলকাতা- ৪৮ কোটি ১৫ লাখ (পরমা ফ্লাইওভার), চীন- ৫০ কোটি টাকা, মালয়েশিয়া- ৫৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
# সেতু নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় : বাংলাদেশ- ৪৬৮২ কোটি টাকা (পদ্মা সেতু), ভারত- ১২৯ কোটি টাকা (ব্রহ্মপুত্র সেতু)।
একটি সরল প্রশ্ন, এর নাম উন্নয়ন নাকি লুণ্ঠন?
এই ফ্রেন্ডলি ফায়ার বা সুইসাইড গোলটি তিনি কেন করছেন, সেটা নিয়েও অনেকেই ভাবনায় পড়ে গেছেন! এই শিশুপীর অথবা ডাক্তার জাতির রোগটি ধরতে পারলেও আসল চিকিৎসায় উৎসাহী নন। তারা সেই একই বাকশাল নামক ক্লিনিক থেকে চিকিৎসাটি করাতে চান। ওই হাসপাতালে রোগ সারুক আর না সারুক, তাতে এই ডাক্তার সাবদের কিছু যায় আসে না।
এক দিকে মহামান্য শ্বশুর মহাশয়রা নিজেদের মতো করে মজা লুটতে থাকবেন। অন্য দিকে মহামান্য জামাইরা শ্বশুরের সমালোচনা করে জনগণকে কৃতার্থ করবেন, টাশকি খাওয়াবেন। শ্বশুর মহাশয়গণের ক্ষমতার ভাণ্ডার থেকে রিভার্স ওসমোসিস প্রক্রিয়ায় মিষ্টি পানি পান করবেন। রিভার্স ওসমোসিস হলো এমন প্রক্রিয়া যেখানে তিতা লবণ শ্বশুরের দিকেই থেকে যায়, সুপেয় পানি চিন্তাবিলাসী জামাই বা বন্ধুবান্ধবীদের দিকে ধাবিত হয়।
ডাক্তার ইমরান ভালোভাবেই জানেন, তার এসব সমালোচনায় মহামান্য শ্বশুর মহাশয়দের টনক একটুও নড়বে না। কারণ তাদের এই টনক নড়ার কব্জাটিকে (নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থা) ঠিকভাবেই জব্দ করে ফেলা হয়েছে। দেশে নির্বাচনব্যবস্থা ঠিক থাকলে এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল থাকলে এই ডাক্তার ইমরানরা কাদেরিয়া স্টাইলে নিজের সরকারের সমালোচনা না করে ঘরে গিয়ে নিজ শ্বশুরকে বোঝাতেন।
এ জামাইদের খরচ হবে শুধু মুখের একটুস খানি ইস্। আর জাতির যাবে চৌদ্দ আনার কবুতর।
কাজেই জামাই বাবার কথা থেকে বিচলিত হবেন না। এদের জামাতাগিরির কোনো ক্ষতি হবে না। এই জামাই কিংবা বান্ধবীরা জনগণের জন্য কথা বলে না; বরং জনরোষ থেকে শ্বশুর মহাশয় ও বান্ধবীকে রক্ষা করতেই কৌশলে কথা বলে। তারা একটা সত্য বলেন জাতিকে অন্য একটা মিথ্যা কথা গেলানোর উদ্দেশ্যে। সেই মিথ্যা বা ভেলকিটির নাম ‘কাউয়া উন্নয়ন’।
২ . ‘কাউয়া’ যেভাবে জিনিস লুকায়
কাউয়ারা নিজেদের অত্যন্ত জ্ঞানী ভাবে। একটি পাথরের পাশে দু-একটি খড় দিয়ে ঢেকে মনে করে তার জিনিসটা আর কেউ দেখতে পায়নি। এই কাউয়া উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে দেশের অর্থনীতি থেকে গত দশ বছরে ৭৫ বিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে ! সবাই ধরে নিয়েছে এগুলো কাউয়া নিয়ে গেছে। আশ্চর্য! দেশের মানুষও ভাণ করছে যে, তারা কিছু দেখেনি।
এতগুলো টাকা কোথায় গেছে- তা দেশের মানুষ জানে না। জানার চেষ্টাও করে না। এ ধরনের ভয়াবহ লুটপাটের সংবাদটি শুনে আমাদের অনেকের ভেতরে তেমন রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া হয় না। আমরা সবাই যেন একেকজন আবুল মাল বা সম্পদশালী হয়ে গেছি। লুটপাটের যেকোনো ফিগারকেই এখন ‘পি-নাট’ বলে মনে হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকেও ৮০০ কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে! ব্যাংকের এমন সুরক্ষিত জায়গা থেকে কে এতগুলো টাকা উধাও করেছে, কিভাবে করেছে, আমরা কেউ তা জানি না। জানার চেষ্টাও করি না। এখানেও শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে যে, কাউয়া নিয়ে গেছে।
একটি দল ক্ষমতায় এলেই বারবার শেয়ারবাজার লুট হয়। এগুলো কে লুট করে, কিভাবে করে, তাও জানি না। সেটা জানার চেষ্টাও করি না। ফলে শেয়ারবাজারের কাউয়ারাও কখনোই ধরা পড়বে না।
গার্মেন্টের এক সাধারণ কর্মচারী হলমার্ক নামে এক কোম্পানি করে সোনালী ব্যাংক থেকে চার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। কিভাবে এটা সম্ভব হলো, তা আমরা কেউ জানি না। সেই সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা থেকে এ যাবৎ কত টাকা উদ্ধার হয়েছে- সেই খবরও অজানা। যে কাউয়া এবং কাউয়িরা সোনালী ব্যাংকের হর্তাকর্তা সেজে এই মহা লুটপাটে অংশ গ্রহণ করেছে, তারাও লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে গেছে। আমরাও এখন আর তাদের খুঁজি না। দু-একজন আবার টকশোতে এসে জাতিকে উপদেশ বিলান। হায়রে সেলুকাস ! কি বিচিত্র এই কাউয়ামুলুক!
এই কাউয়ারা একে একে সবগুলো সরকারি ব্যাংক ফতুর করে ফেলেছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী নয়টি ব্যাংক ফান্ডের সঙ্কটে পড়েছে। এই ব্যাংকগুলো কে ফতুর করছে, কিভাবে ফতুর করেছে- আমরা তা জানি না। যেটুকু খালি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আমরা শুধু তা ভরে দিচ্ছি। এগুলো কোথায় ড্রেন হচ্ছে, তা জানি না। সেটা জানার চেষ্টাও করি না।৩ . পৃথিবীর সেরা ধনী মি: কাউয়া
ছোট্ট বেলার মতো আমরা ধরে নিয়েছি, আমাদের এত্তগুলো টাকা কাউয়া নিয়ে গেছে; সেই হিসাবে এই মি: কাউয়াকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী হিসেবে ঘোষণা করা যায়।
গত বছরের একটি হিসাব অনুযায়ী (২০১৬), বিল গেইটসের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৮২ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে এই মি: কাউয়ার ঘোষিত সম্পদই ৭৫ বিলিয়ন ডলার। যে গবেষণা সংস্থা এই হিসাবটি বের করেছে, তারা সেটা করেছে সাপোর্টিং ডকুমেন্ট বা পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। যেসব পাচার করা টাকার তথ্য তাদের কাছে পৌঁছেনি, সেগুলো এই হিসাবের বাইরে রয়েছে। ধারণা করা হয়, হিসাবের বাইরে রয়েছে কমপক্ষে আরো সমপরিমাণ টাকা।
সে বিবেচনায় মি: কাউয়ার অঘোষিত সম্পদ কমপক্ষে আরো ৭৫ বিলিয়ন ডলার। ফলে নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ বিল গেইটস কিংবা ওয়ারেন বাফে নন। সবচেয়ে ধনী লোকটি হলেন মি: কাউয়া, যিনি ইংরেজিতে নয় বাংলায় কথা বলেন।
এই সংবাদটি বিএনপি-জামায়াতপন্থী কোনো সংস্থা প্রকাশ করেনি। এই তথ্যটি জানিয়েছে যারা এই ব্যাপারে গবেষণা করে বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন। আমেরিকান এই সংস্থাটির নাম Global Financial Integrity। সংস্থাটি সম্ভবত ২০০৪ সাল থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। কাজেই গত জোট সরকারের সময় এই টাকা পাচার কেমন ছিল, সেই তুলনামূলক আলোচনা করা সম্ভব। দৈনিক প্রথম আলো ২০১৬ সালের জুন মাসে টাকা পাচার সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। ২০০৪ সালে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৩.৩৪ বিলিয়ন ডলার, ২০০৫ সালে ৪.২৬ বিলিয়ন ডলার, ২০০৬ সালে ৩.৩৭ বিলিয়ন ডলার, ২০০৭ সালে ৪.০৯ বিলিয়ন ডলার, ২০০৮ সালে ৬.৪৪ বিলিয়ন ডলার, ২০০৯ সালে ৬.১২ বিলিয়ন ডলার, ২০১০ সালে ৫.৪০ বিলিয়ন ডলার, ২০১১ সালে ৫.৯২ বিলিয়ন ডলার, ২০১২ সালে ৭.২২ বিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালে ৯.৬৬ বিলিয়ন ডলার। আবার ২০১৪ সালে পাচার হয়েছে ৯.১০ বিলিয়ন ডলার।
এই রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, মুদ্রা পাচারে আমরা বিশ্বে এক নম্বর অবস্থানে রয়েছি। দেশ থেকে টাকা পাচারের মূল কারণ দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতা। এটা আইন বা শক্তি প্রয়োগ করে বন্ধ করা যাবে না।
এখানে দু’টি বিষয় লক্ষ করার মতো। গত চার দলীয় জোট সরকারের আমলে প্রতি বছর দেশ থেকে যত টাকা পাচার হয়েছে- বর্তমান সরকারের আমলে সেটা বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়ে পড়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলের দুর্নীতির বিরুদ্ধেই টিআইবি এবং সিপিডির নেতৃত্বে সুশীলসমাজ সোচ্চার হয়েছিল। মূলত এই ঘরানার সুশীলদের প্ররোচনাতেই তথাকথিত ‘এক-এগারো’র মাধ্যমে সিভিলিয়ন সরকারের অবয়বে এক অদ্ভুত কিছিমের সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। এক ধরনের ফোবিয়ায় আক্রান্ত এই কথিত সুশীলরাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিকৃত করেছিলেন। দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছেন তারা, তারই ফল হিসেবে মুদ্রা পাচারের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। তখন আমরা বলেছিলাম, দেশটিকে বিশ বছর পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, দেশটিকে কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে।
এটা পরে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, তাদের সাথে এক গোপন সমঝোতার মাধ্যমেই ২০০৮ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় বসে। জরুরি সরকার সৃষ্ট আতঙ্ক এবং বর্তমান সরকারের মহালুটপাটের কারণেই ২০০৭ সাল থেকে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার ঊর্ধ্বমুখী এবং তা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
কাউয়ারা কয়েকটি রাস্তাঘাট দেখিয়ে এই মহাবিপর্যয় থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখতে চায়।
দুর্নীতি হলেও আগে যে টাকা কোনো না কোনোভাবে দেশে বিনিয়োগ হতো, দেশের কাজে লাগত, সেই টাকা এখন অজানা কাউয়া ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা অসহায় হয়ে এর পানে তাকিয়ে থাকি।
মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন,The hottest place in Hell is reserved for those who remain neutral in times of great moral . অর্থাৎ কোনো বড় নৈতিক সংগ্রামের সময় যারা নিরপেক্ষ থাকে, তাদের স্থান হবে দোজখের সবচেয়ে গরম অংশে। আমাদের ধর্মেও এ জাতীয় অনেক কথা রয়েছে। জানি না এই বোধগুলো আমাদের মাঝে কখন ফিরবে?
মন বেশি খারাপ হলে চলুন, এক ফিলিপিনো নাবিকের গল্প শুনি। ফিলিপিনো নাবিকদের সুনাম বা দুর্নাম ছিল- এরা একবার দেশ থেকে বের হলে সহজে দেশে ফিরে যেতে চাইতো না। তেমনি এক নাবিক আঠারো-উনিশ মাস এক নাগাড়ে জাহাজে সেইল করছে। হঠাৎ একদিন খবর আসে, তার স্ত্রী পুত্র সন্তান প্রসব করেছে। উনিশ মাস স্ত্রীর সাথে দেখা না হলেও সে অটোমেটিক্যালি পিতা হয়ে পড়েছে। কাজেই নিজ স্ত্রীর সন্তান প্রসবকে অপরাপর নাবিকদের সাথে সেলিব্রেট করেছে।
আমরাও চলুন মন খারাপ না করে এই নাবিককে অনুসরণ করি। মি: কাউয়ার শ্রেষ্ঠ ধনী হওয়া উপলক্ষে সারা জাতি মিষ্টি মুখ করি। মি: কাউয়াকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী হিসেবে ঘোষণার জন্য জাতিসঙ্ঘ বরাবর আবেদন করি।