Site icon The Bangladesh Chronicle

করোনা পরিস্থিতি সামলাতে পারছে না সরকার : বিএনপি

আজ শনিবার সকালে নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন রিজভী। – ছবি : নয়া দিগন্ত

বিএনপি অভিযোগ করে বলেছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে মনে হয় পথ হারিয়ে ফেলেছে সরকার। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্তহীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে এ কথা বলেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

আজ শনিবার সকালে নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে এক ভিডিও কনফারেন্সে তিনি বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমান পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে শুক্রবার লন্ডন থেকে জাতির উদ্দেশে ভিডিও লাইভে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা প্রদান করেছেন। তিনি একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। আমি মনে করি, দেশের স্বার্থেই গুরুত্ব সহকারে সেটি ভাবা উচিত। কেননা সরকার নিজেরাও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না, অপরদিকে কেউ সহযোগিতা করতে চাইলে তারা নিজেদের হীন দলীয় স্বার্থে সেটি গ্রহণ করার মতো মানসিকতাও তাদের নেই। সবকিছুটাই ‘আমিত্ব’ জাহির করতে গিয়ে জনগণকে অসহায় করে ফেলা হয়েছে।

রিজভী জানান, এখনকার করুণ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তুলে ধরে দেশনায়ক তারেক রহমান বলেছেন, দেশবাসী এবার এক অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পবিত্র সিয়াম পালন করেছে। অনেকের ঘরেই থাকছে না এবারের ঈদ উৎসবের আমেজ। মরণঘাতী করোনাভাইরাসের হানায় অনেকেই স্বজন হারিয়েছেন। নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। হারিয়েছেন অল্প আয়ের চাকরি কিংবা স্বল্প পুঁজির ব্যবসা-বাণিজ্য। অপরদিকে ক্ষমতাসীন অপশক্তি কর্তৃক গুম, খুন, অপহরণ আর জেল-জুলুমে অনেক পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে।

একদিকে করোনাভাইরাস আতঙ্ক অন্যদিকে খাদ্যাভাবে ঘরবন্দি অসংখ্য অগণিত মানুষের হাহাকার। এরইমধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে ঘূর্ণিঝড় আমফানের আঘাত জনজীবনে নতুন করে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এমন অমানবিক পরিস্থিতি মোকাবেলায়, সময়ের দাবি হলো, দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দলমত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রদর্শন। সতর্কতা-সহায়তা-মানবিকতার চেতনায় অসহায় মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। সারাদেশে অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদেরকে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান এবং ত্রাণের চাল ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেয়ার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে আহবান জানানো হলেও সেনাবাহিনীকে না দিয়ে সে দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের হাতে। ফলে গরিব মানুষের জন্যে দেয়া ত্রাণের চাল এখন পাওয়া যাচ্ছে আওয়ামী নেতাদের গুদামে, পুকুরে কিংবা খাটের নিচে। ‘ত্রাণ চোর’ থেকে ‘চাল চোর’, সেই একই চক্র, একই দল, একই কাহিনী, একই বাহিনী।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহামারি করোনাকালে দেশের অবস্থা, করোনা মোকাবেলায় সরকারের করণীয়, মানুষের অসহায়ত্ব, ঘূর্ণিঝড় আমফানে তাণ্ডব এবং সারাদেশে অসহায় মানুষের জন্য বিএনপির অব্যাহত মানবিক সহায়তা কর্মসূচিসহ সার্বিক বিষয় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, বর্তমানে দেশের কোটি কোটি পরিবারের অসংখ্য মানুষের দিন কাটছে অর্ধাহার-অনাহারে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভীতি উপেক্ষা করে একমুঠো খাবারের দাবিতে অসহায় মানুষ নেমে আসছে রাজপথে। বাড়ছে বুভুক্ষ মানুষের হাহাকার। দেশে চলছে নীরব দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি। এমন পরিস্থিতিতেও সারাদেশে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ত্রাণের চাল চুরি, নানা কৌশলে অসহায় মানুষদের জন্য বরাদ্দ সরকারি টাকা আত্মসাৎ, সরকারিভাবে গরিব কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের জন্য করা তালিকাতেও চলছে জালিয়াতি। মানুষের এমন ঘোর বিপদকালেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের চুরি-দুর্নীতি প্রমাণ করে, এই দল এবং সরকার এখন সম্পূর্ণভাবে লুটেরা পরিবেষ্টিত।

রিজভী বলেন, দেশবাসীকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়ে তারেক রহমান বলেছেন, উৎসবের পরিবর্তে এবারের ঈদ উদযাপিত হতে যাচ্ছে এক বেদনাবিধূর পরিবেশে। একদিকে করোনাভাইরাস কিংবা আম্ফানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ অপরদিকে ত্রাণ চুরি, গরিব ও অসহায়দের জন্য বরাদ্দ করা সরকারি অর্থ নিয়ে জোচ্চুরি, মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত একদশক ধরে জনগণ ক্ষমতাসীনদের মুখে একটাই ‘বুলি’ শুনে আসছে ‘এটার প্রতি জিরো টলারেন্স-ওটার প্রতি জিরো টলারেন্স’। তবে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্ষমতাসীনরা শুধু বিরোধী দল ও মতের প্রতিই ‘জিরো টলারেন্স’। আর বরাবরই তাদেরকে দেখা যাচ্ছে দুর্নীতি, ঋণখেলাপি, লুটপাট, টাকা পাচার আর ব্যাংক লুটেরাদের প্রতি উদার। লুটেরাদের কবলে পড়ে দেশটা এখন রসাতলে যাওয়ার উপক্রম। এ কারণেই বর্তমান সংকটে, দেশে অসহায়-অবহেলিত-ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার বাড়তে থাকলেও সরকার দরিদ্র মানুষের পাশে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে দাঁড়াতে পারছে না।

তিনি জানান, গত একদশকে দেশ থেকে ৯ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ড থেকে ৮১০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। দেশে এই মুহূর্তে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা, সরকারের প্রশ্রয়ে কয়েকটি ব্যাংকের মূলধন পর্যন্ত হজম করে ফেলা হয়েছে। লুটেরা দল এভাবে দেশের লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার, লোপাট আর লুটপাট করার সুযোগ না পেলে জনগণকে হয়তো এখন অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটাতে হতো না।

বিএনপির অন্যতম শীর্ষ এই নেতা জানান, প্রতিটি দেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। করোনা চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বীকৃত কোনো মেডিসিন আবিষ্কার হয়নি। এই অবস্থায় সকল দেশই করোনা মোকাবেলায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। প্রতিদিন বেশিসংখ্যক মানুষকে টেস্টের আওতায় এনে করোনা উপসর্গ থাকলে আগেভাগেই আইসোলেশনে নেয়া কিংবা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণকেই অন্যতম সাফল্য বলে মনে করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে উল্টো চিত্র। মানুষ নিজ উদ্যোগে করোনা পরীক্ষা এবং চিকিৎসা করাতে গিয়েও নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। অনেকেই বলছেন, বেশি সংখ্যক মানুষকে টেস্ট করলে বেশি রোগী শনাক্ত হওয়ার কারণেই হয়তো অধিক সংখ্যক মানুষকে টেস্টের আওতায় আনা হচ্ছে না। এজন্য আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, এটা এখন সরকারকেই স্পষ্ট করতে হবে, তারা কি সক্ষমতা না থাকায় অধিকহারে করোনা টেস্ট করছে না নাকি এর পেছনে সরকারের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে?

রিজভী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তারেক রহমান বলেছেন, নানা অজুহাতে করোনা টেস্ট না করে কিংবা টেস্ট করতে গড়িমসি করে সরকার হয়তো করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃতের সংখ্যা কম দেখিয়ে মেকি সাফল্য লাভ করতে চায়। কিন্তু এর পরিণতি হতে পারে হিতে বিপরীত। দেশ এবং জনগণের স্বার্থে সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে তারেক রহমান বলেন, করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখিয়ে নিজেদের কাগুজে সাফল্য দেখানোর চেয়ে সরকারের জন্য বেশি জরুরি করোনা টেস্ট নিয়ে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন। কারণ, গ্লোবাল ভিলেজের এই সময়ে করোনা টেস্টের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশ বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে ভবিষ্যতে নাগরিকদেরকে অত্যন্ত চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। নাগরিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দেশে ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিদেশের শ্রমবাজারে থাকা না থাকার বিষয়টিও অনেকটাই নির্ভর করবে সরকার কিভাবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে তার ওপর। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের করোনা পরিস্থিতির সাথে তুলনা করে সরকার যতই নিজেদের সাফল্য জাহির করুক, কিন্তু দলে দলে কূটনীতিকরা কেনো ঢাকা ছাড়লো এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, গত এক যুগ ধরে সারাদেশে বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনের অসংখ্য নেতাকর্মী ক্ষমতাসীন অপশক্তির গুম-খুন-অপহরণ-জেল-জুলুম-মিথ্যা মামলা-হামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। মিথ্যা মামলার খরচ বহন করতে করতে হাজার হাজার পরিবার অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েছে। তবে নেতাকর্মীরা মনোবল হারাননি, নিজেরা নির্মম অমানবিকতার শিকার হয়েও মানবতা হারাননি। এর প্রমাণ তুলে ধরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, এই করোনা সঙ্কটকালে সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীরা বিশেষ করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা অসহায় জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেউ কেউ শখের মোবাইল কিংবা মোটরসাইকেল বিক্রি করে অথবা স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে সেই অর্থ দিয়ে অসহায় মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছেন। ‘সতর্কতা-সহায়তা-মানবিকতা’ এই চেতনায় সারাদেশে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশে অসহায় মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে। অব্যাহত রেখেছে ‘মানবিক সহায়তা’ কর্মসূচি। বিএনপি মার্চ মাস থেকেই করোনা সম্পর্কে লিফলেট বিতরণ শুরু করেছিল। এ পর্যন্ত বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা এক কোটিরও বেশি মানুষের কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন।

রিজভী বলেন, দলের নেতাকর্মীদের প্রশংসা করে তারেক রহমান বলেছেন, সারাদেশে অনেক অসহায় গরিব কৃষক, বর্গাচাষিদের ক্ষেতের ধান কেটে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে ছাত্রদল, যুবদল ও কৃষক দলের নেতাকর্মীরা। একইসাথে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাবের মতো পেশাজীবী সংগঠনগুলোও হাসপাতালগুলোতে পিপিই, সার্জিক্যাল মাস্ক, তৈরী খাবার সরবরাহ, অনলাইন চিকিৎসা পরামর্শ দেয়া, হাত ধোয়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে বেসিন স্থাপনসহ সম্ভব সবধরণের সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন। গত একযুগ ধরে ক্ষমতাসীন অপশক্তির রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক নিপীড়ণের শিকার হওয়ার পরও দেশের এই সংকটকালে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা যেভাবে সম্পূর্ণ নিজেদের আর্থিক সামর্থ্যে নিজ উদ্যোগে সারাদেশে বিপদাপন্ন মানুষের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন। এজন্য সত্যিই আনন্দিত, গর্বিত। করোনা উপসর্গ নিয়ে কিংবা করোনা আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে যখন কেউ ভয়ে দাফন পর্যন্ত করতে যেতে চান না এমন অন্তিমযাত্রায়ও বিএনপির কোনো কোনো নেতাকর্মী সাহসের সাথে দায়িত্ব নিয়ে মৃতের দাফনকার্য সমাধা করছেন। সুতরাং যে দলে এমন মানবিকবোধ সম্পন্ন নেতাকর্মী রয়েছে সেই দলটিকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না।

অসহায় মানুষের সহযোগিতায় বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা যেভাবে ভূমিকা রেখে চলেছেন এ জন্য তারেক রহমান দল ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বলে জানান রিজভী।

Exit mobile version