মূলত ভোটের মাঠে লড়াই হচ্ছে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আর দলটির নেতাদের মধ্যে থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়াদের মধ্যে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলীয় ডামি প্রার্থী দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। আর এই ডামি প্রার্থীই এবারের নির্বাচনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে সরকারের ওপর দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে প্রবল চাপ ছিল। বন্ধু রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মহল এমন একটি নির্বাচন আয়োজনের জন্য আহ্বান এবং পরামর্শ দিয়ে আসছিল অব্যাহত ভাবে। বাংলাদেশে একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে জোরালো অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশের জন্য স্বতন্ত্র ভিসা নীতি ঘোষণা করে দেশটি এমন বার্তা দিয়েছিল আগে থেকে। সব পক্ষের আহ্বান থাকা সত্ত্বেও অনেকটা একপেশে নির্বাচন হতে যাচ্ছে দেশে। এমন একটি নির্বাচন হওয়ার পর সামনে কেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। নির্বাচন হওয়ার পর সেই সরকার কীভাবে সামনে এগোবে এসব বিষয়ই এখন নতুন বছরের আলোচনার বিষয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন করে কর্মসূচি পালন করে আসছে। সামনের দিনে তাদের আন্দোলনের গতি প্রকৃতি কেমন হয় সেটিও দেখার বিষয়। এ ছাড়া নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলোর ভূমিকা, সরকার পরিচালনার কৌশলের পাশাপাশি বিরোধীদের মোকাবিলার বিষয়টিও আছে আলোচনায়। বলা হচ্ছে চলমান পরিস্থিতিতে সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে অর্থনীতি গতিশীল রাখা। রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণ শোধ আর চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের গতি ধরে রাখা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে নতুন বছরে। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে ধুঁকতে থাকা মানুষের জন্য নতুন বছরে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়টিও বড় এক চ্যালেঞ্জ হবে সরকারের সামনে। এ ছাড়া দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক শিল্প নিয়েও আছে নানা শঙ্কা। নির্বাচন ঘিরে যে অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা থেকে পোশাক শিল্পের ওপর কোনো আঘাত আসতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। বিদায়ী বছরের পুরোটা সময় আলোচনায় ছিল ব্যাংক খাত। নানা অনিয়ম, অব্যবস্থা আর লুটপাটের কারণে আস্থাহীনতায় ভুগছেন গ্রাহকরা। এ খাতে সুশাসন নিশ্চিত করাও নতুন চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জন্য।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নতুন বছরে রাজনীতি ও অর্থনীতির কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে। এক্ষেত্রে আসন্ন নির্বাচনও বাংলাদেশের অনেক ক্ষেত্রে ভাগ্য নির্ধারণ করবে। কারণ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈশ্বিক সম্পর্কের বিষয়টি। তাই জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচন ও পরবর্তীতে সরকার পরিচালনার ধরন কেমন হবে তার ওপর নজর দেশের এবং দেশের বাইরের পর্যবেক্ষকদের।
২০২৩ সালের শুরু থেকেই রাজনীতিতে নানা অনিশ্চিয়তা দেখা দেয়। যেটি এখনো চলমান। নির্বাচন পূর্ববর্তী বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর চলছে ধরপাকড়, রায় দেয়া হচ্ছে রাজনৈতিক মামলার। অন্যদিকে নির্বাচন ঠেকাতে মাঠে তৎপর বিএনপিসহ বিরোধীরা। ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদের আন্দোলনকে আমলে না নিয়ে নির্বাচনের মাঠে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। তাই নির্বাচন পরবর্তী দেশের রাজনীতিতে সংকট আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের টালমাটাল পরিস্থিতি ভোগাতে পারে সাধারণ মানুষকেও।
কিছুটা বৈশ্বিক প্রভাব আর দেশে লাগামহীন সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপণ্যের দামে নাভিশ্বাস অবস্থা সাধারণ মানুষের। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলছে না। এমন অবস্থায় সামনের দিনে স্বস্তি ফিরবে এমন আশায় আছে মানুষ।
বিদায়ী বছরে নিয়মিতভাবে কমেছে রিজার্ভ। যেটি সরকারকে আরও চিন্তায় ফেলেছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহও কমছে। কারণ দেশের অর্থনীতিতে বড় ভরসার জায়গায় রেমিট্যান্স। অবৈধ পন্থায় রেমিট্যান্স আসছে দেশে, বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। সংকটে আছে দেশের গার্মেন্ট সেক্টরও। ব্যবসায়ীরা নির্বাচন পরবর্তী নিষেধাজ্ঞার আতঙ্কে রয়েছেন। পোশাক খাতের অস্থিরতা তৈরি হলে তা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব রাখবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. শাহাদাত হোসাইন সিদ্দিকী বলেন, অর্থনীতিতে ইতিমধ্যে আমরা বেশকিছু জায়গায় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছি। বিশেষ করে রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, আমদানি পেমেন্টের মধ্যে সংকট বিরাজ করছে। আগামী বছরগুলোতে এটি কেমন হবে তা নির্ভর করছে আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর। এ ছাড়াও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা ও বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হবে তার ওপরও এসব নির্ভর করে। তাই নির্বাচন পরবর্তীতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর ব্যাপকভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে, কেন রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে তা খুঁজে বের করতে হবে। এটি কি অন্য কোনো চ্যানেলে আসছে কিনা, মানিলন্ডারিং হচ্ছে কিনা- এগুলো গুরুত্ব সহকারে খুঁজতে হবে এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে ভোটের হার কেমন হবে, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচনে না এলেও নির্বাচনে যদি সাধারণ ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। ভোটার উপস্থিতি কম হলে এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। কারণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কেমন ভোট পড়েছে বিদেশিরা কিন্তু তা দেখবে। সংসদ নির্বাচনে ভোটের পরিমাণ বাড়লে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ কমতে পারে। অন্যথায় এটি ভালো প্রভাব রাখবে। তাই ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ কমবে আবার বিএনপিসহ বিরোধীরাও আগামীতে ভোটে আসতে পারে। তাই এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে নতুন বছর সরকারকে কাজ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা অনিশ্চয়তা আছে। সেটা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মনে হয় নির্বাচনের পরে দেশের জনগণ যাদের ম্যান্ডেট দেবে তারা সরকার গঠন করে সেই অনিশ্চয়তা দূরে ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে। তখন এমন অনিশ্চয়তা আর থাকবে না। তিনি বলেন, আমি আশা করি ২০২৪ সালটা নতুন উদ্দীপনা নিয়ে আসবে। ৭ই জানুয়ারি নতুন সরকার গঠন হলে তারা সবাইকে নিয়ে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে দেশ পরিচালনা করবে সেটাই প্রত্যাশা থাকবে। কারণ ২০২৩ সালটা শুধু বাংলাদেশ নয় সারা পৃথিবীতেই ব্যাপক অশান্তির মধ্যদিয়ে কেটেছে। তাই একটি শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা সকলের জন্যই বাঞ্ছনীয়। আমরাও সেটাই চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, আমাদের মতো দেশে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হয়। চ্যালেঞ্জ আসবে। জনগণ সেটি মোকাবিলা করলে শক্তিশালী পক্ষ দুর্বল হবে। কারণ আজকে দেশের মানুষ সচেতন, তারা জাগ্রত হয়েছে। এ সরকারের প্রতি তাদের একটা অনীহা রয়েছে। যেটি বিদ্রোহে রূপ নিতে পারে। তাই আসছে বছর সরকারের জন্য শুধু চ্যালেঞ্জ না মহা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কারণ দেশি-বিদেশি শক্তিগুলো এদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে জাগ্রত করতে সোচ্চার রয়েছে। তিনি বলেন, ২০২৪ সালটা হবে দেশের রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের বছর। এ বছরের শুরুতেই ১৫ বছরের হতাশার রাজনীতির অবনমন হবে। নতুনভাবে শুরু হবে রাজনীতি। কারণ অশুভ শক্তি বেশি দিন রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারে না। এখানে শুভর জয় হবে। বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো বিশেষ করে পশ্চিমারা এদেশের গণতন্ত্রকে অগ্রসর করতে কাজ করছে। তাই শুভ দিক দেখতে পাবো বলে মনে করি।
বিশ্লেষকদের এমন আশা আর প্রত্যাশার সঙ্গে সারা দেশের মানুষও শঙ্কা আর সম্ভাবনার দোলাচলে নতুন বছর শুরু করবেন। রাজনীতি আর অর্থনীতির গতি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক জীবনে স্বস্তি ফিরবে নাকি সংঘাত-সংকটে আরও জর্জরিত হবে তা এখনই কেউ হলফ করে বলতে পারছেন না।