প্রথমে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে সাত দফা, পরে তাদের জোট গণতন্ত্র মঞ্চ ১৪ দফা হচ্ছে ঘোষণা করে। তার মধ্যে ৩ নম্বরটি ছাড়া বাকিগুলো হচ্ছে দাবি ও ফলাফল। আর ৩ নম্বরটি হচ্ছে মূলত সংস্কার কর্মসূচি। এখানে তারা পরিষ্কার করেছে, বিজয়ী অভ্যুত্থানকারী হিসেবে তারা কী চায়। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে যে দফাটি তারা হুবহু ২৭ দফায় চেয়েছে, সেটি হচ্ছে:
৩. (ক) সংবিধান ‘স্বৈরতন্ত্রের উৎস প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক জবাবদিহিবিহীন স্বেচ্ছাচারী কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ব্যবস্থার’ বদল ঘটিয়ে সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা পৃথক্করণ ও যৌক্তিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ন্যায়পাল ও সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠনে আইন প্রণয়ন করা।
(খ) সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করে সরকার গঠনে আস্থা ভোট ও বাজেট পাস ব্যতিরেকে সকল বিলে স্বাধীন মতামত প্রদান ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার নিশ্চিত করা।
(গ) প্রত্যক্ষ নির্বাচনের পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি ও দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
(ঘ) প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ‘যৌক্তিক ভারসাম্য’ প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ কার্যকর স্বাধীনতার নিশ্চিত করাসহ গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠা করা।
বিএনপি ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখার ২৭ দফা হাজির করেছে। এর আগে গত ১৫ নভেম্বর এক বৈঠকে সরকারের বিরুদ্ধে ‘বৃহত্তর ঐক্যের’ ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছায় বিএনপি।
ভবিষ্যতেও কেউ যেন আইয়ুব খান না হয়ে উঠতে পারে, বারবার বুটের তলায় যেতে না হয়—এমন সংস্কার কর্মসূচির কথা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদও কদিন আগে বলেছিলেন। দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীও বলেছেন, ‘কেবল মৌলিক সংস্কারের মাধ্যমেই উঠে দাঁড়াতে পারবে দেশ। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব ঘোষণা করব।’ এবং এই কর্মসূচি নিয়ে তারা অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও যাবে?
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নামক সংগঠনের যে কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চ হয়ে বিএনপির কর্মসূচি হয়ে উঠেছে, তা জাতির কর্মসূচি কেমনে হবে? রাষ্ট্র গঠন তো কোনো একক যাত্রা নয়, বহু পথ ও মতের যৌথ যাত্রা। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমাও ছিল তেমনি ঘটনা।
২.
বিএনপি গত ১৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখার ২৭ দফা ঘোষণা করেছে। সেখানে তারা সংবিধান সংস্কার কমিশন, জাতীয় সমঝোতা কমিশন, জুডিশিয়াল কমিশন, প্রশাসনিক কমিশন, মিডিয়া কমিশন, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন করবে বলে ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন তাদের সাত দফায় যেমন, গণতন্ত্র মঞ্চ ১৪ দফায় যেমন কেমন সংস্কার করবে, এটা স্পষ্ট করেছে, বিএনপি সেখানে তা কমিশনের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ কমিশন কী করবে, তা স্পষ্ট নয়। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফায় যেমন তা ছিল।
কমিশন কাদের নিয়ে হবে? অভ্যুত্থানে বিজয়ী রাজনৈতিক শক্তিগুলো মিলে করবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। অভিজ্ঞতা বলছে, কমিশন কয়েকজন পণ্ডিতের ব্যাপার। এর চেয়ে তো ’৭২–এর গণপরিষদও ভালো ছিল। সেখানে অন্তত রাজনীতিবিদেরা ছিলেন। যে কাজ কমিশন দিয়ে করা হবে, তা রাজনৈতিক দলগুলো মিলে কেন করা হবে না? সংবিধান সংস্কার কি উকিল, বিশেষজ্ঞদের ব্যাপার? আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, নির্বাচিত হওয়ার পর (যদি কমিশন বানানো হয় আর কী) পছন্দের লোক দিয়ে কমিশনগুলো করা হবে। যেমন ’৭২ সালের গণপরিষদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর বদলে ’৭০ সালে নির্বাচিতদের নিয়ে করা হয়েছিল এবং গণপরিষদ অধ্যাদেশের মাধ্যমে সদস্যদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই তো সংবিধান সংস্কার ছাড়া হবে না। বিএনপি তো ঘোষণাই দিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো সংবিধান সংস্কারের প্রথম ধাপ। যদি নির্বাচনের বা কমিশনের আগেই তা করা যায়, তবে পুরো সংস্কার নয় কেন?
একটি সংস্কার করা গেলে বাকিগুলো নয় কেন? এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাস ভঙ্গ করার প্রচুর নজির আছে? অভিজ্ঞতা বলছে, যুদ্ধাপরাধীর বিচার যেমন আওয়ামী লীগকে আরও বেশি ১০ বছর ক্ষমতা দিয়েছে, রাষ্ট্র সংস্কারের কমিশনগুলোও বিএনপিকে একই সুযোগ দেবে।
ধরা যাক, ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি কমিশনগুলো করল। তারপর তদন্ত রিপোর্টের মতো কমিশনগুলোর রিপোর্ট আসতে আসতে পরের নির্বাচন এসে গেল। তখন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে, পরের ভোটে নির্বাচিত হলে তারা এটা করবে। এবং বর্তমানের যে ক্ষমতাকাঠামো সেটিকে ব্যবহার করে বিএনপিও ১০–১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
এ রকম ঘটতেও পারে। তিন জোটের রূপরেখা তার উদাহরণ।
৩.
ধরা যাক, কমিশন রিপোর্টও দিল এবং সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুসারে তা তোলাও হলো। তা কি বর্তমান সংবিধানের ৭(খ)–এর ‘সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য’ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো–সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।’—এই সংশোধন–অযোগ্য ধারাগুলো নিয়েই তো সমস্যা, অথচ এই অনুচ্ছেদগুলোই সংশোধন করা যাবে না। একজন সংসদ সদস্য তো সংবিধানের অধীন।
সংসদ যদি তা পাসও করে, সংবিধানের ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে আদালত তা বাতিল করতে পারবেন। তাহলে উপায়? বিএনপি তখন কোর্টের ওপর দায় চাপাবে। ব্যস!
আর বিএনপি যদি সত্যিই চায় রাষ্ট্র মেরামত, তাহলে তাকে ’৭০ সালের মতো লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের মধ্যে আসতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে গণপরিষদের মতো সংবিধান সংস্কার সভার নির্বাচনের চুক্তি করবে। এবং নির্বাচিত হওয়ার পর তারা নির্ধারিত দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কারে বাধ্য থাকবে। এবং সংবিধান সংস্কারকালীন শ্রমিক, কৃষক, নারী ও আদিবাসীদের আনুপাতিক হারে সংস্কারসভায় প্রতিনিধি গ্রহণ করবেন। এই সংবিধান সংস্কার শেষে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের কাছে সম্মতি গ্রহণের পর চূড়ান্ত হবে। তারপর সংস্কার সভার সদস্যরা সংসদ সদস্য হিসেবে গণ্য হবেন।
নইলে আবারও বাংলাদেশ সংস্কার কমিশন-কমিটির চোরাগলিতে পথ হারাবে, আবারও নির্বাচনে জিততে আন্দোলনে জিততে হবে, আবার ক্ষমতার দৈত্য, আবারও গুম-খুন-ক্রসফায়ার, আবারও…।
- নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
nahidknowledge1@gmail.com