Site icon The Bangladesh Chronicle

ওপারে আবার মুহুর্মুহু গুলি, এপারে কষ্টে খেটে খাওয়া মানুষ

বাংলাদেশ–মিয়ানমার মৈত্রী সড়কে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে যান চলাচল। সতর্ক পাহারায় রয়েছেন বিজিবি সদস্যরা। গতকাল সকালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায়
বাংলাদেশ–মিয়ানমার মৈত্রী সড়কে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে যান চলাচল। সতর্ক পাহারায় রয়েছেন বিজিবি সদস্যরা। গতকাল সকালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায় ছবি: জুয়েল শীল

 

কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর থেকে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শোনা গেছে। কখনো টানা এক ঘণ্টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলে। গোলাগুলির ফাঁকে কয়েকটি স্থানে দেখা গেছে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এভাবে চলে বেলা তিনটা পর্যন্ত। আর গোলাগুলি বেড়ে যাওয়ায় এপারের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে আবারও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

আতঙ্কের পাশাপাশি টেকনাফ-উখিয়ার সীমান্তবর্তী অন্তত ৩০টি গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের বড় দুশ্চিন্তা আয়–রোজগার নিয়ে। কাজকর্ম নেই ১০ দিনের বেশি সময় ধরে। আয় না থাকায় ক্ষুদ্র সঞ্চয় ভেঙেও কুলাচ্ছে না। সংসার চালাতে বিপাকে পড়েছেন তাঁরা। তার ওপর অনেকে পড়েছেন ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপে। এসব এলাকায় অন্তত এক লাখ মানুষের বসবাস বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। বাসিন্দাদের কেউ জেলে, মাছের আড়তের শ্রমিক, কেউ–বা দিনমজুর, চা-বিক্রেতা।

ওপারে গোলাগুলি বেড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছেন সীমান্ত এলাকার লোকজন। তবে সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) সতর্ক পাহারা দেখা গেছে। টেকনাফ-উখিয়ায় গুলির শব্দ শোনা গেলেও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত। দুই দিন ধরে সেখানে গুলির শব্দ শোনা যায়নি।

এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তের জিরো পয়েন্টে নাফ নদীসংলগ্ন খালে কয়েক দিন ধরে একটি লাশ ভাসছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ। ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মাহফুজ ইমতিয়াজ ভুঁইয়া গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, লাশটি ভাসতে দেখে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দেন। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে এটি উদ্ধার করা যাচ্ছে না।

এর আগে গত শুক্রবার উখিয়ার রহমতের বিল সীমান্ত এলাকা এবং গত রোববার বালুখালী তেলীপাড়া সেতুর নিচ থেকে মাথায় হেলমেট গ্লাভস পরা আরও দুটি লাশ উদ্ধার করা হয়।

২ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি, টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সংঘর্ষ চলছে।

মুহুর্মুহু গুলির শব্দ

কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল সীমান্তের ওপারে ঢেঁকিবনিয়া ও চাকমাকাটা এলাকায় গতকাল সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত থেমে থেমে গোলাগুলি হয়। পরে গোলাগুলি বাড়ে। তবে ভারী গোলাবর্ষণ ও মর্টার শেলের শব্দ শোনা যায়নি। অন্যদিকে একই সময়ে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উত্তরপাড়া সীমান্তের ওপারে কুমিরখালী এলাকা থেকেও ছিল একটানা গুলির শব্দ।

গতকাল দুপুরে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উত্তরপাড়া ও উনচিপ্রাং সীমান্ত এলাকায় বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টা অবস্থান করে দেখা গেছে, একটানা গোলাগুলি শুরু হলে বিজিবি সতর্ক অবস্থান নেয়। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নদীতে পাহারা দিতে প্রস্তুত রাখা হয় স্পিডবোট। সীমান্ত চৌকিগুলোও নজরদারি বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে আশপাশে থাকা লোকজনকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার তাগাদা দেন বিজিবি সদস্যরা।

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্ত এলাকায় সকাল থেকে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শোনা গেছে। কয়েক দিন আগে গুলি মানুষের দোকানপাট ও বসতবাড়িতে পড়েছে। গতকাল গুলি না পড়লেও কখন কী ঘটে যায়, এ নিয়ে লোকজন আতঙ্কে রয়েছেন।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ কমে গেলেও সেখানকার জনজীবন এখনো স্বাভাবিক হয়নি বলে জানালেন জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দারা। ঘুমধুম সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা এনামুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, গোলাগুলি আপাতত বন্ধ হলেও আতঙ্ক কাটছে না।

কষ্টে খেটে খাওয়া মানুষ

কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং বাজার থেকে আধা কিলোমিটার পূর্বে উত্তরপাড়া। সেখানে মাছের ঘের, লবণমাঠ ও ধানখেত রয়েছে। বেশির ভাগ খেটে খাওয়া মানুষ। মাছ ধরে, বিক্রি করে বা দিনমজুরি করে সংসার চালান তাঁরা। গতকাল দুপুরে উত্তরপাড়া ঘুরে অন্তত ১৫ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৪ থেকে ৬।

তাঁদের একজন জেলে মোহাম্মদ শাহজাহান (৩৫)। তিনি বলেন, ‘এভাবে আর কত দিন। আগের জমানো টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন করে ঋণ করতে হয়েছে। মাছ না ধরলে কিংবা কাজ করতে না পারলে কী খাব।’

উত্তরপাড়া মাছের ঘের থেকে একটু উত্তরে আসতেই ছোট্ট খালে নৌকা ও জালের পরিচর্যা করছেন আরেক জেলে নূর হোসেন (৩০)। এর আশপাশে খালি পড়ে আছে ৮ থেকে ১০টি নৌকা। নূর হোসেন বলেন, ‘ভাই, আমাদের জন্য কিছু করেন।’

উত্তরপাড়ায় কথা হয় গৃহবধূ নুরনাহার বেগমের (৪৫) সঙ্গে। তাঁর স্বামী মো. সিরাজও মাছ ধরেন। নুরনাহার প্রথম আলোকে বলেন, ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন একটি সংস্থা থেকে। সপ্তাহে ১ হাজার ৮০০ টাকা করে কিস্তি দিতে হয় তাঁকে। কিন্তু স্বামীর আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিস্তি দিতে পারছেন না। কিস্তির জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।

মিয়ানমার সীমান্তে চলছে সংঘাত। নিরাপত্তার স্বার্থে মাছ ধরা বন্ধ নাফ নদীতে। এতে অনেকটা অলস সময় পার করছেন সেখানকার জেলেরা। গতকাল দুপুরে হোয়াইক্যং সীমান্তেছবি: জুয়েল শীল

একই অবস্থা জেলে নুরুল আলমেরও (৪৫)। তাঁর দাবি, সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলির কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যাতে তাঁদের কিস্তিগুলো পরিশোধের জন্য বাড়তি সময় দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে প্রত্যাশা নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পালংখালী শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা রাজীব ঘোষ বলেন, ‘ঋণের কিস্তির টাকার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে, বিষয়টি জানা ছিল না। কেউ আমাদের জানায়নি। বিষয়টি এখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।’

উত্তরপাড়ায় প্রায় ৪ হাজার মানুষের বসবাস বলে জানালেন স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কষ্টে থাকা মানুষের সাহায্যের জন্য চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সরকারকে জানিয়েছি।’

একই অবস্থা উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা আঞ্জুমানপাড়া, রহমতের বিল, ধামনখালী ও খারাংখালী এলাকার। এখানকার বাসিন্দারাও মাছ ধরার পাশাপাশি খেতখামারে কাজ করেন।

ধামনখালীর বাসিন্দা নুরুল ইসলাম (৫৬) বলেন, ‘সীমান্তে চার কানি জমিতে ধানের চারা রোপণ করেছি। কিন্তু সার দিতে যেতে পারছি না। আয় না থাকায় নিজে চলতেও কষ্ট হচ্ছে।’

একই কথা বলেন খারাংখালীর বাসিন্দা রশিদ আহমদের (২৮)। এই এলাকার পূর্ব অংশে তাঁর একটি চায়ের দোকান আছে। সীমান্তে গোলাগুলির কারণে দোকানটি খুলতে পারছেন না। মাঝেমধ্যে খুললেও দোকানে কেউ আসছে না। পরিবার চালাতে কষ্ট হচ্ছে।

সীমান্ত এলাকায় খেটে খাওয়া লোকজন যাঁরা কাজে যেতে পারছেন না, তাঁদের সহযোগিতা করা হবে বলে জানান কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। তিনি গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

prothom alo

Exit mobile version