- মুহা: আব্দুল আউয়াল, রাজশাহী ব্যুরো
- ১৬ মে ২০২২, ০৮:১০, আপডেট: ১৬ মে ২০২২, ১১:০৭
আজ ১৬ মে, সোমবার। ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস। ৪৬ বছর আগে ১৯৭৬ সালের এই দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে ‘মরণ ফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ’ অভিমুখে লাখো জনতার লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ওইদিন বাংলার সর্বস্তরের মানুষের বজ্রকণ্ঠ দিল্লির মসনদ পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী সেদিন ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব ও এর বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে যে প্রতিবাদ করেছিলেন, তার সেই সাহসী উচ্চারণ বাংলাদেশের মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে আজও।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গঙ্গার উৎস থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত বহু বাঁধ আর কৃত্রিম খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে চলেছে ভারত। শুধু ফারাক্কা বাঁধ নয়, কানপুরের গঙ্গা ব্যারাজ ও হরিদুয়ারে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারে নির্মিত কৃত্রিম খালসহ অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে তারা। এছাড়া উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় চারশ’ পয়েণ্ট থেকে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এতে করে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নদী গবেষক ও লেখক মাহবুব সিদ্দিকী নয়া দিগন্তকে বলেন, বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত ভারত কর্তৃক গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের সার্বিক ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৫ শ’ কোটি টাকা। তখন থেকে আজ পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে চলেছে।
তিনি বলেন, এবার শুকনো মৌসুম শুরুর আগেই গঙ্গায় পানি সংকটের প্রভাবে বাংলাদেশের পদ্মা শুকিয়ে মরা গাঙ্গে পরিণত হতে শুরু করেছে।
উপমহাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী ভূপেন হাজারিকার একটি গান আজও ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষকে আন্দোলিত করে, অনুপ্রেরণা জোগায়। তিনি গেয়েছেন :
বিস্তীর্ণ দু’পারের, অসংখ্য মানুষের
হাহাকার শুনেও, নিঃশব্দে নীরবে–
ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন?…
জানা যায়, ১৯৭৬ সালের ১৬ মে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে সেই লংমার্চ শুরু হয়েছিল আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে তা শেষ হয়।
দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে রাজশাহীর রাজপথে। ভারত বিরোধী নানা শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে গোটা এলাকা। দুপুর দুইটায় হাজার হাজার মানুষের স্রোত জেলার গোদাগাড়ীর প্রেমতলী গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ছয়টায় লংমার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে রাত যাপনের জন্য সে দিনের মত শেষ হয়। মাঠেই রাত যাপন করার পরদিন সোমবার সকাল আটটায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে।
ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন এই লংমার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন।
মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। তিনি বলেন, আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যখন বক্তৃতা করছিলেন তখন এক নয়া জাগরণ সৃষ্টি হয়। মাঠের আশেপাশে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। প্রতিবাদী জনতার মধ্য থেকে হাজারো কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে ‘লও লও লও সালাম – মওলানা ভাসানী; সিকিম নয়, ভুটান নয় – এদেশ মোদের বাংলাদেশ।’
আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এরকম নানাবিধ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা। মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লংমার্চ সমাপ্ত হলেও সেদিন জনতার ভয়ে ভীত ভারতীয়রা সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে।
ওই লংমার্চ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে। ফলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতেও স্থান পায়। এতে মওলানা ভাসানী এশিয়ার অন্যতম ও অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
প্রতিবেশী দেশ হয়েও ভারতের একতরফা ও আগ্রাসী মনোভাবের কারণে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের বৃহৎ একটি অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চল ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। দেশের বৃহত্তম নদী পদ্মা আজ পানির অভাবে শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ৩০টি নদী আজ বিলুপ্তির পথে।
অন্যদিকে, ফারাক্কার বিরুপ প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নীচে নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন পানির স্তর স্থান ভেদে ১৫০ থেকে ১৬০ ফুট পর্যন্ত নীচে নেমে গেছে। আর নগরীতে অন্তত ৭০ থেকে ৮০ ফুট পর্যন্ত নীচে নেমে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইতোপূর্বে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি বার বার উত্থাপন করা হলেও কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। দীর্ঘদিন ধরে শুধু আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়। এ ব্যাপারে ভারতের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান করছে না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজশাহীর পদ্মা নদীর সেই অপরূপ যৌবন ও সৌন্দর্য্য আর নেই। এছাড়া জেলার বাঘা, চারঘাট ও গোদাগাড়ীতে পদ্মার শাখা নদীতেও একই চিত্র বিদ্যমান। রাজশাহীর পদ্মা নদীর বুকে বিশাল বিশাল বালুচর সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে ঘুড়ি উড়ানো হচ্ছে, গরুর গাড়ী চলছে। ফল ও ফসলের আবাদ হচ্ছে। পায়ে হেঁটেই এখন নদী পার হওয়া যায়। পদ্মার মূল নদী রাজশাহী শহর থেকে অনেক দূরে (সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার) সরে গেছে। বছরের পর বছর ধরে পদ্মার একই চিত্র অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যে দেশের বৃহৎ এ অঞ্চলটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। মরুকরণ দেখা দেবে। অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবার আঙ্কাকা রয়েছে।
জানা যায়, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কা লংমার্চের প্রস্তুতির সময় বিশ্ব নেতাদের এ সম্পর্কে অবহিত করে বার্তা পাঠান। তিনি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড, চীনের নেতা মাও সেতুং, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন প্রমুখের কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে ভারতের ওপর তাদের প্রভাব খাটিয়ে গঙ্গার পানি বণ্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির ব্যাপারে সহযোগিতা কামনা করেন।
এছাড়া মওলানা ভাসানী জনসভা থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ফারাক্কার ফলে বাংলাদেশে এরই মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা সরেজমিনে দেখতে আসার আহ্বান জানান।
স্থানীয়রা জানান, ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বৃহৎ একটি অংশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। আগ্রাসী ভারতের একগুঁয়েমী ও অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের কারণে বাংলাদেশ আজ চরম ক্ষতির শিকার। এর ফলে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ জিইয়ে রয়েছে। বছর দশেক আগে থেকে দাবি উঠেছে, ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণ ভারতের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে সেই ক্ষতিপূরণ আদায়ে ভারত সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন বিজ্ঞজনেরা।
জানা গেছে, ফারাক্কা বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প কারখানাসহ সবকিছুতেই মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। এসব ক্ষতির বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান এখনো নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রে এ সংক্রান্ত কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়।
২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ‘নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বাংলাদেশ’ আয়োজিত সাধারণ সভায় একটি ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়। ওই ঘোষণাপত্রের একটি অংশে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি সমীক্ষার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ফারাক্কায় বাঁধ দেয়ার কারণে বাংলাদেশের প্রায় ৯৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবছর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তবে এ ক্ষতির পরিমাণ বর্তমানে আরো বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বাংলাদেশের সভাপতি অ্যাডভোকেট এনামুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, ফারাক্কার প্রতিক্রিয়া ও প্রভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গঙ্গা-পদ্মা ছাড়াও অন্যান্য ছোট ও মাঝারি ধরনের নদ-নদীও শুকিয়ে গেছে। নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা এখন অনেকটাই মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে এক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় অতি আসন্ন। ভয়াবহ এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
এনামুল হক বলেন, ভারত সরকার চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে পানি দেবে না, এটা এখন অনেকটা স্পষ্ট। কারণ এতোদিনেও তারা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে পানির প্রাপ্যতা বুঝিয়ে দেয়নি। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণ ভারতের কাছ থেকে আদায়ে বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, জাতিসংঘের পানি প্রবাহ আইন ১৯৯৭-এর বিধান অনুযায়ী এবং জাতিসংঘের মাধ্যমেই বিষয়টির সুরাহা করতে হবে।
রাজশাহীতে কর্মসূচি
এদিকে ফারাক্কা লংমার্চ দিবস উপলক্ষে রাজশাহীতে জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টায় নগরীর পাঠানপাড়ায় পদ্মা নদীর পাড়ে লালন মুক্তমঞ্চে এ জনসভা অনুষ্ঠিত হবে। নদী ও পরিবেশ আন্দোলন বাংলাদেশ এ কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
এতে উপস্থিত থাকবেন ভাসানী অনুসারী পরিষদের চেয়ারম্যান ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাতীয় পাটির চেয়ারম্যান (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী প্রমুখ।