মুদ্রিত সংস্করণ
দেশের ১০টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এস আলম নামে পরিচিত সাইফুল আলম মাসুদের প্রায় ২,২৫,০০০ কোটি টাকা লোপাটে দেশের ব্যাংক চরম সঙ্কটে পড়েছে। এই পরিমাণ অর্থ দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বার্ষিক বাজেটের এক- চতুর্থাংশের সমান। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে এটিকে সবচেয়ে বড় অর্থকেলেঙ্কারি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এস আলমের এই ব্যাংক লুটের কারণে বর্তমানে ব্যাংকগুলো তীব্র অর্থসঙ্কটে পড়েছে। গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে না পারার কারণে কিছু ব্যাংক এখন অস্তিত্বসঙ্কটে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যেই পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
ঋণের ধরন ও অর্থপাচার
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (ইঋওট) অনুসন্ধানে দেখা গেছে : এস আলম গ্রুপের নামে নেয়া ঋণ রয়েছে ৯২,৬৭৭ কোটি টাকা। বেনামী প্রতিষ্ঠানের নামে তার নেয়া ঋণের অঙ্ক হলো : ৯৭,৪৮৬ কোটি টাকা। তার ভুয়া প্রতিষ্ঠান ও পরোক্ষ সুবিধা নেবার পরিমাণ হলো : ৩৪,৮৬৭ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে প্রমাণ মিলেছে এই বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
জানা গেছে, অধিকাংশ ঋণ কোনো যথাযথ জামানতের ভিত্তিতে নেয়া হয়নি। প্রভাব খাটিয়ে এবং ব্যাংকিং নিয়মনীতি উপেক্ষা করে এসব ঋণ অনুমোদিত হয়েছে।
আকিজ উদ্দিনের সংশ্লিষ্টতা
এস আলমের প্রাক্তন ব্যক্তিগত সহকারী পিএস আকিজ উদ্দিন এই কেলেঙ্কারির সাথে সরাসরি জড়িত।
ইসলামী ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) পদে বসার পর তার ও পরিবারের নামে শতাধিক বেনামী অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। এই অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ১,২৬৬ কোটি টাকা অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি ও এনবিআরের যৌথ অনুসন্ধানে এর প্রথম সূত্র পাওয়া যায় সোনালী ব্যাংকের এক শাখার অস্বাভাবিক লেনদেন থেকে।
সুবিধাভোগীরা এখনো বহাল তবিয়তে
এস আলমের সুবিধাভোগী ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন ও জেকিউএম হাবিবুল্লাহ ইতোমধ্যেই দেশ ত্যাগ করেছেন। কিছু কর্মকর্তাকে নির্দোষ ধরে দুদক তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে, যারা শুধু ব্যাংকের অর্থ বের করতে সহযোগিতা করেছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা সরাসরি এস আলমের সুবিধাভোগী ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিসহায়তার মাধ্যমে এস আলম সহজেই অর্থ বের করে নিতে পেরেছেন। তারা এস আলমের দখলে থাকা ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ লোকাতে সহযোগিতা করেছেন। অর্থপাচারের ক্ষেত্রেও সরাসরি সহযোগিতা করেছিলেন কিছু কর্মকর্তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওইসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। উপরন্তু তাদের কেউ পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন, কেউবা ডেপুটি গভর্নর হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। নানাভাবে তারা এস আলমের মানিলন্ডারিংয়ে এখনো সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের বৃহত্তম এই ঋণকেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন: ‘এস আলম কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা এবং জনগণের আস্থা বিপন্ন করেছে। এই ধরনের লুট ও অর্থপাচারের কারণে সাধারণ আমানতকারীরা ঝুঁকির মুখে পড়েছেন।’
ইসলামী ব্যাংক সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত
ইসলামী ব্যাংক একসময় দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক ছিল। ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা দ্রুত অবনতি হয়েছে। এখন ব্যাংকটি মহাপ্রলয়মূলক মূলধন ঘাটতির মুখে এবং প্রথমবারের মতো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এস আলম কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে পদ্ধতিগত ঝুঁকি তৈরি করেছে। ব্যাংকগুলোর তহবিল শূন্য হয়ে গেছে। ইসলামী ব্যাংকের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানও মারাত্মক অর্থসঙ্কটে। ব্যাংকিং খাতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনগণের আস্থা ফেরাতে স্বচ্ছ ও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এত বিপুল অর্থ লোপাট ও বিদেশে পাচারের কারণে ব্যাংক খাত মারাত্মক সঙ্কটে পড়েছে। সাধারণ আমানতকারীরা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। তারল্য সঙ্কটের কারণে অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতেও হিমশিম খাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতির পতন দেশের ব্যাংক খাতে পদ্ধতিগত ঝুঁকি তৈরি করেছে। এস আলম কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থিক নিরাপত্তা, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ও জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এ বিষয়ে স্বচ্ছ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও লুটের পরিমাণ
ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান – লোপাটকৃত অর্থ কোটি টাকা)
ইসলামী ব্যাংক- ১,০৫,৪৮৩
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক- ৪৫,৬৩৬
ইউনিয়ন ব্যাংক- ২৩,৫২৬
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক- ১৩,২৫০
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক- ১২,৮৭৬
জনতা ব্যাংক- ১২,৩৩২
এক্সিম ব্যাংক- ৬,৩৪৬
ন্যাশনাল ব্যাংক- ২,৩৪৬
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক- ৫০
আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক – ৩৭৬
আভিভা ফাইন্যান্স- ১,৮৫৭