Site icon The Bangladesh Chronicle

এলএনজি শুধু অর্থের চাপ নয়, সরবরাহেও ভোগান্তি তৈরি করছে

দেশের বিদ্যমান গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় এলএনজি-নির্ভরতা এরই মধ্যে ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ ঘাটতি পূরণে প্রধানত এলএনজি আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যটির মূল্য অস্থিতিশীল হলে বা ডলার সংকটের মুখে আমদানি করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। আবার যেকোনো কারণে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সংকট তৈরি হলে বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে আবাসিক, সিএনজিচালিত পরিবহন ও শিল্প খাতে তৈরি হচ্ছে অচলাবস্থা। এলএনজির সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটলে ভুগতে হচ্ছে দেশের সব খাতকেই।

বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা ৩১০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ভাসমান দুটি টার্মিনালে রিগ্যাসিফিকেশনের মাধ্যমে দৈনিক এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা ১১০ কোটি ঘনফুট। এ অনুযায়ী জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের মোট সরবরাহ সক্ষমতায় এলএনজির অংশ ৩০ শতাংশের বেশি। উচ্চ মূল্য, টার্মিনাল বিকল বা বন্ধ হয়ে পড়া, পাইপলাইনে ত্রুটি অথবা দুর্যোগের সময় এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হলে দেশে গ্যাসের বড় ধরনের সরবরাহ সংকট দেখা দিচ্ছে। গত দুই-আড়াই বছরে বেশ কয়েকবার এমন বড় ধরনের সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল ও বেসরকারি সার-কারখানা কাফকোর মধ্যবর্তী স্থানে ৯ জুলাই গ্যাসের ৪২ ইঞ্চি পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে সঞ্চালন ব্যাহত হয়ে জাতীয় গ্রিডে এলএনজির সরবরাহ নেমে আসে ২৪ কোটি ঘনফুটে। গ্যাস সংকটে আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ৩১ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সংকটের তীব্রতা বাড়ে আবাসিক ও শিল্প খাতে। সিএনজি স্টেশনগুলোর সামনে দীর্ঘায়িত হয় গ্যাসের জন্য অপেক্ষমাণ যানবাহনের লাইন। পাইপলাইন মেরামত করে চালু করা হলেও এ গ্যাস সংকট এখনো অব্যাহত রয়েছে।

এর আগে গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামিটের এলএনজি টার্মিনাল। ক্ষতিগ্রস্ত টার্মিনালটিকে সংস্কারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় বিদেশে। এতে জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ হ্রাস পায় অন্তত ৬০ কোটি ঘনফুট। আবাসিকে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দেয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও শিল্প-কারখানায় ব্যাহত হয় উৎপাদন। এখনো সামিটের টার্মিনালটি থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু করা যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আনোয়ারা-ফৌজদারহাট পাইপলাইন মেরামত শেষ হয়েছে। একটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। এছাড়া সামিটের এলএনজি টার্মিনাল দিয়ে আগামী সপ্তাহে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে। তখন গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ আরো বেড়ে যাবে।’

এর আগে গত বছরের নভেম্বরে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এক্সিলারেট এনার্জির ভাসমান টার্মিনালটি বন্ধ রাখতে হয়। ওই সময় জাতীয় গ্রিডে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পায় ৫০ কোটি ঘনফুট। ঢাকাসহ শিল্প এলাকাগুলোয় দেখা দেয় গ্যাসের তীব্র সংকট। বন্ধ রাখতে হয় অন্তত এক হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে গত বছরের জানুয়ারিতে ভাসমান টার্মিনালের নিরাপত্তায় এলএনজি সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয়। এতে ওই সময় কয়েকদিন চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় তীব্র গ্যাস সংকট তীব্র হয়। আংশিক বন্ধ রাখতে হয় মেঘনাঘাট, হরিপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

উচ্চ মূল্যের কারণে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখতে হয়। এর মধ্যে ২০২২ সালের আগস্টে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম উঠেছিল ৭০ ডলার ৫০ সেন্টে।

দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আগামীর সরবরাহ পরিকল্পনা নিয়ে ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টারপ্ল্যান (আইইপিএমপি)-২০২৩ প্রণয়ন করেছে সরকার। সমন্বিত এ মহাপরিকল্পনায় দেশের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় আমদানীকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে এটি বাস্তবায়ন শুরু হলে সামনের দিনগুলোয় সংশ্লিষ্ট সব খাতে ভোগান্তি এখনকার চেয়ে বহুলাংশে বাড়বে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকদের। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে গ্যাসের চাহিদা তৈরি হবে দৈনিক ৬২৪ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে স্থানীয় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে পাওয়া যাবে প্রায় ২০০ কোটি ঘনফুট। বাকি ৪২৪ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে হবে। আইইপিএমপিতে প্রাক্কলিত এসব হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের গ্যাস খাতে চাহিদা পূরণে এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীলতার হার বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬৮ শতাংশে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হলে তা দেশের জ্বালানি খাতের জন্য বড় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। কোনো কারণে আমদানি বন্ধ হলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। অর্থ সংকটে পণ্যটি কেনা না গেলে বা অবকাঠামোর ত্রুটির কারণে সরবরাহ সংকট তৈরি হলে তা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্যই বড় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সমন্বিত মহাপরিকল্পনায় গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনার বড় অংশই এলএনজিকে ঘিরে। এখানে দুই ধরনের আশঙ্কা রয়েছে, প্রথমত, বিশ্ববাজারে পণ্যটির দামে অস্থিতিশীলতা। আবার দেশে গ্যাসের স্থানীয় সরবরাহের পরিবর্তে এলএনজিতে নির্ভরশীলতা বাড়ানো হয়েছে। কোনো কারণে আবারো এলএনজির বৈশ্বিক সংকট দেখা দিলে তা দেশের গোটা গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনাকে বড় ঝুঁকিতে ফেলবে। এমনকি পুরো অর্থনীতির ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

দেশে বিদ্যমান এলএনজি টার্মিনাল দুটির সক্ষমতা বাড়িয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ ১২৬ কোটি ঘনফুটে উন্নীত করতে চায় সরকার। এছাড়া মহেশখালী ও পায়রায় আরো দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ দুটির সক্ষমতা হবে ১৭০ কোটি ঘনফুট। মাতারবাড়ীতে ভূমিতে স্থাপিত (ল্যান্ডবেইজ) ১০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণের কার্যক্রমও এগিয়ে চলছে। জ্বালানি বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ২০২৬ থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ এসব টার্মিনাল উৎপাদনে আসতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলএনজি টার্মিনাল অচল হলে বা পাইপলাইন দিয়ে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হলে দ্রুত এর বিকল্প চালু করার মতো আর্থিক বা অবকাঠামোগত সক্ষমতা পেট্রোবাংলা বা জ্বালানি বিভাগের নেই। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস সরবরাহে বর্তমানে যে ঝামেলা চলছে সেটি মূলত এলএনজিকে ঘিরে। সেটি এলএনজির অবকাঠামো হোক কিংবা সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ত্রুটিজনিত কারণেই হোক, এটা হবে। কারণ জ্বালানি বিভাগের হাতে এমন কোনো বিকল্প অবকাঠামো নেই যে একটি লাইন কিংবা একটি ভাসমান টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যটি দিয়ে গ্যাসের সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখবে। এটা করতে গেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ দরকার। বর্তমানে জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে ব্যবস্থাপনা সচল রাখা হয়েছে। সরবরাহ চেইনও এভাবেই ঠিক রাখতে হচ্ছে। অনেকগুলো পাইপলাইন পুরনো হয়ে গেছে। সেগুলো সংস্কারের জন্য অনেক অর্থ দরকার।’

দেশে এলএনজি আমদানি ও গ্যাস সঞ্চালনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে পেট্রোবাংলার সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটি গ্যাস সরবরাহের জন্য সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করছে। এছাড়া ভবিষ্যতে আমদানীকৃত এলএনজি সরবরাহের জন্য দুটি পাইপলাইন নির্মাণেরও কাজ করছে।

জিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী ২০২৬ সাল নাগাদ দেশে বড় আকারে এলএনজি আমদানি শুরু হবে। এজন্য টার্মিনাল নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। জিটিসিএলের সঞ্চালন ব্যবস্থাপনায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় সমান্তরাল পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য জিটিসিএলের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এলএনজি কার্যক্রমে জিটিসিএল অংশে যে প্রকল্পগুলো রয়েছে, সেগুলো নির্ধারিত সময় অনুযায়ী শেষ করা আমাদের লক্ষ্য, যাতে পণ্যটি আমদানির পর সঞ্চালনে কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি না হয়।’

Bonik Barta

Exit mobile version