এরিকো নাকানো একজন জাপানি নাগরিক। তার বাবা-মা এবং বোন জাপানে থাকেন। জাপানে একজন চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এরিকো এবং বাংলাদেশে তিনি কাউকে চেনেন না বললেই চলে। তবুও ২০২১ সাল থেকে ঢাকায় বসবাস করছেন এই নারী, শুধুমাত্র নিজের সন্তানদের জন্য।
সন্তানদের হেফাজত ও অভিভাবকত্ব নিয়ে এরিকো এবং তার বাংলাদেশি-আমেরিকান স্বামী ইমরান শরীফের আইনি লড়াই – ইতোমধ্যেই বহুবার গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হয়েছে।
এরিকো একটি ফেলোশিপের আওতায় যখন জাপানের ন্যাশনাল ক্যান্সার সেন্টারে কাজ করতেন, তখন ইমরান শরীফের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেসময় ইমরান নিজের একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন। ২০০৮ সালে তারা বিয়ে করেন এবং এরপর তাদের সংসারে একে একে তিন মেয়ে- জেসমিন, লায়লা এবং সোনিয়ার জন্ম হয়। বর্তমানে সোনিয়া জাপানে তার নানা-নানির সঙ্গে রয়েছে এবং অন্য দুই সন্তান ঢাকায় আছে।
ঢাকায় সন্তানদের হেফাজত নিয়ে আইনি লড়াই শুরু হওয়ার আগে টোকিও পারিবারিক আদালত এরিকো-ইমরানের সন্তানদের জিম্মা সম্পূর্ণ তাদের মায়ের হাতে থাকবে বলে রায় দেন। কিন্তু, জাপানের আদালতের রায় সত্ত্বেও এরিকোকে না জানিয়ে ইমরান তাদের দুই মেয়ে জেসমিন ও লায়লাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসায় স্বামীকে ‘ইন্টারন্যাশনাল প্যারেন্টাল চাইল্ড অ্যাবডাকশন’-এর অভিযোগে অভিযুক্ত করেন তিনি।
বাবা-মায়ের যেকোনো একজনের অজ্ঞাতে-অমতে, তার সন্তানের হেফাজতের অধিকার ভঙ্গ করে যখন বাবা বা মা সন্তানকে দেশের বাইরে সরিয়ে নেন বা নিজের কাছে রাখেন – তখন তালে ‘ইন্টারন্যাশনাল প্যারেন্টাল চাইল্ড অ্যাবডাকশন’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
গত দুই বছর ধরে আদালতের একাধিক রায়ের ফলে সন্তানদের হেফাজত কখনো মা, কখনো বাবার কাছে গিয়েছে (ইমরান এবং এরিকোকে গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে ১৫ দিন একসঙ্গে থাকারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল)। গত ১৬ জুলাই ঢাকা জেলা জজ কোর্ট পারিবারিক আদালতের রায় বহাল রাখেন এবং এর মাধ্যমে সন্তানদের জিম্মা তার হাতেই চলে আসে বলে দাবি এরিকোর।
কিন্তু, লায়লা এখনো তার বাবার সঙ্গেই রয়েছে এবং জেসমিন রয়েছে মায়ের সঙ্গে।
এত দীর্ঘ সময়ের জন্য নিজের বাড়ি থেকে দূরে এবং প্রতি মুহূর্ত অনিশ্চয়তায় কাটানো কারো পক্ষেই সহজ নয়; বিশেষ করে মা-বাবা বা অভিভাবকের পক্ষে, যার প্রধান চিন্তাই হলো সন্তানের কল্যাণ।
সম্প্রতি আমরা এরিকো নাকানোর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় সন্তানদের বাড়ি ফিরিয়ে নিতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করেছেন এরিকো। তাছাড়া, বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছেন না বলেও হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। এই সাক্ষাৎকারের সময় এরিকোর মেয়ে জেসমিন তার সঙ্গে ছিল।
সন্তানদের হেফাজত নিয়ে আইনি লড়াইয়ে যে এত দীর্ঘ সময় লেগে যাবে- তা ভাবতেও পারেননি এরিকো; এবং এই সময়ে তিনি জাপানের একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে মেডিক্যাল অনকোলজি বিভাগে সহযোগী পরিচালক হিসেবে তার চাকরিটি হারিয়েছেন। জাপানে তার মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেও তিনি তাকে দেখতে যেতে পারেননি (বিমানবন্দর থেকে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কারণ সন্তানদের বাংলাদেশ ত্যাগের অনুমতি ছিল না)।
এরিকো বলেন, “একজন পেশাদার ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবে এই চাকরিটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার মোটামুটি ভালো আয় ছিল, জীবনে স্থিতিশীলতা ছিল। কিন্তু, এখন আমার কিছুই নেই। আমরা এখানে আটকা পড়ে গেছি, কতদিন এভাবে থাকতে হবে জানি না।”
সমস্যার সূত্রপাত
“প্রতিটি বিবাহিত দম্পতির জীবনে কোনো না কোনো বিষয়ে মতের অমিল থাকেই এবং আমি সবসময় ভেবেছি যে আমরা (ইমরান এবং আমি) আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করবো। ইমরান বরাবরই খুব রাগী ছিল। যখন সে রেগে যেত তখন আমরা সবাই খুব ভয়ে থাকতাম, আবার সে আনন্দে থাকলে পরিবারের সবাই আনন্দে থাকতাম। কিন্তু, বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রায়ই এমনটা বলা হয়, মেয়েদের একটু ‘মানিয়ে নিতে’ হয়। তাই আমিও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম”, বলেন এরিকো।
জেসমিন তার বাবার একদিন রেগে যাওয়ার ঘটনা জানায়, সেদিন সে তার বাবার আচরণে খুবই ভয় পেয়ে যায়, তার ছোটবোনও কাঁদতে শুরু করেছিল।
“পেছনে ফিরে তাকালে দেখি, আমাদের মধ্যে খুব একটা মতপার্থক্য (আর্থিক বিষয়ে) ছিলই না, কারণ আমি আর্থিকভাবে শতভাগ সচ্ছল এবং স্বাধীন ছিলাম। আমি চাকরিটাকে ভালোবাসতাম এবং রোগীদের দেখাশোনা করতে আমার ভালো লাগতো”, বলেন এরিকো।
এরিকোর ভাষ্যমতে, তার বাবাও একজন চিকিৎসক এবং তিনি ইমরানের হয়ে টোকিওর অভিজাত এলাকায় একটি নতুন অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন, যেহেতু ‘ব্যাংকের শর্ত পূরণ করার মতো আর্থিক সঙ্গতি তখন তার ছিল না’।
কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন ইমরান ঋণের কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে দেন এবং বাধ্য হয়ে তার শ্বশুরকে তার টাকা দিয়ে দিতে হয়।
“আমার বাবা তাকে অনেকবার কল দিয়েছে, ইমেইল করেছে, সরাসরি দেখা করে আলোচনা করার জন্য বলেছে। শেষপর্যন্ত তিনি একজন আইনজীবী নিয়োগ করেন, কারণ পারিবারিকভাবে আমাদের আলোচনার আর সুযোগ ছিল না। তখন ইমরান বলে, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা তার বড় ভাই আমার বাবার সাথে কথা বলবে, কারণ বাঙালি রীতিতে এমনটাই নিয়ম”, বলেন এরিকো।
ঋণ পরিশোধের বিষয়টি ইমরানকে ক্ষুব্ধ করে তোলে, বলেন এরিকো, “তখন থেকেই তিনি জেসমিনকে আমার বিরুদ্ধে ব্রেইন-ওয়াশ করতে থাকেন।”
“অনেকেই হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবে না, কিন্তু যখন আমি স্কুল থেকে ফিরতাম, বাবা আমাকে ঘরে ডেকে নিয়ে আমার মায়ের সম্পর্কে বাজে কথা বলতো। যেহেতু তিনি আমার বাবা, তার তার কথাগুলো আমি বিশ্বাসও করেছিলাম তখন; কিন্তু আদালতে সেসবের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি”, বলেন জেসমিন।
এরিকো বলেন, “এমনকি আমাদের ফিলিপিনো গৃহপরিচারিকাও এরকম মন্ত্রণা দেওয়া দেখে ভীত হয়ে পড়ে। কিন্তু, আমি তখন ভাবতাম, বাবা-মেয়ে হয়তো এমনিই স্বাভাবিক কথাবার্তা বলছে। এমনকি আমার মেয়েদের স্কুলের কাউন্সিলরও বুঝতে পারে যে কিছু একটা সমস্যা আছে এবং আমাদের সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং ডাকে”, বলেন এরিকো।
এরিকো জানান, তার সন্তানদের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে- জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের; তাদের পাসপোর্টও তার কাছে। তিনি দাবি করেন, ইমরান জাল কাগজপত্র তৈরি করে সন্তানদের জন্য বাংলাদেশি পাসপোর্ট করিয়েছেন (ইমরানও এরিকোকে একই অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন)।
এরিকোর ভাষ্যে, বাংলাদেশ হেগ কনভেনশনের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং সেজন্যেই ইমরান যুক্তরাষ্ট্রের বদলে সন্তানদের বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে গেলে সাথেসাথেই তাকে গ্রেপ্তার করা হতো।
সন্তানরা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তখন কেমন অনুভূতি হয়েছিল? – এ প্রশ্ন রাখলে তিনি বলেন, “আমি খুবই নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম, সোনিয়াও ওর বোনদের মিস করে। হুট করে একদিন তার বোনেরা চলে গেল- এটা তার জন্য অস্বাভাবিক ঘটনা। আমার খুবই চিন্তা হচ্ছিল, ওদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভীত ছিলাম, বিশেষ করে যেহেতু ওদের বয়স খুবই কম। আর ‘প্যারেন্টাল অ্যাবডাকশন’ তো নির্যাতনের মধ্যেই পড়ে।”
বাবার অধিকার
আমরা ইমরান শরীফকে তার ফেসবুক পেজে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম, কিন্তু এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত তিনি কোনো উত্তর দেননি। তবে তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাসিমা আক্তার লাভলী বলেন, “একদম শুরু থেকেই আমরা তাদেরকে (এরিকো এবং তার আইনজীবী) অনুরোধ করেছি আইনের প্রেক্ষিতে কথা বলতে। শুরু থেকেই এই মামলার ব্যাপারে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। রায়ে (১৬ জুলাইয়ের) এটা বলা হয়নি যে সন্তানরা মায়ের কাছেই থাকবে, বরং মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।
ইমরানের আইনজীবী আরও বলেন, “বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, সন্তানদের অভিভাবক হলেন বাবা এবং মা হলেন জিম্মাদার (কাস্টডিয়ান)। তাই মা সন্তানদের নিয়ে এত দূরে কোথাও যেতে পারবে না- যেখানে বাবা তার সন্তানদের দেখাশোনা করার সুযোগ পাবেন না, আইনত যেটা বাবাকে করতেই হবে। আর তাদের (এরিকো ও ইমরান) এখনো বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি।”
এই আইনজীবী জানান, তাদের পক্ষে আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ নেই। “অভিভাবকত্ব এবং সন্তানদের হেফাজত নিয়ে আমাদের পরিষ্কার আইন আছে। আমরা বিশ্বাস করি, বাবা-মা একে-অপরের পরিপূরক; তাই পিতামাতার যেকোনো একজনকে কোনোভাবেই তার আইনি অধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা যাবে না। তারা এই সন্তানদের বাবার অস্তিত্ব পুরোপুরি মুছে দিতে চান, সেটা কি সম্ভব?”
এদিকে জাপানি আইন অনুযায়ী, ডিভোর্স হওয়া পিতামাতা দুজনেই একইসঙ্গে সন্তানদের জিম্মায় থাকতে পারবেন না এবং অভিভাবকের এই কর্তৃত্বের অধিকারের মধ্যে আইনগত এবং ফিজিক্যাল কাস্টডি (সন্তানদের সরাসরি দেখাশোনা করার বাধ্যবাধকতা) দুটিই অন্তর্ভুক্ত। ইমরানের আইনজীবী নাসিমা আরও বলেন, “জাপানের আইনে শুধুমাত্র একজন অভিভাবক এবং একজন জিম্মাদার থাকতে পারবে। তাই সন্তানদের মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হলে- বাবার আর তাদের ওপর কোনো অধিকার থাকবে না। আমরা চাই এমন একটা ভারসাম্য তৈরি করতে, যাতে বাবা-মা দুজনেই সন্তানদের দেখাশোনা করতে পারেন।”
তাছাড়া, লায়লা নিজেই তার বাবার সঙ্গে থাকতে চেয়েছে। আর কোনো আইন-ই একজন শিশুকে জোর করে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য কোনো অভিভাবকের হাতে তুলে দিতে পারে না। “এমনকি তাকে জোর করে মায়ের কাছে পাঠানো হলে সে আত্মহত্যা করবে বলেও হুমকি দিয়েছিল, গুলশান থানা পুলিশের কাছে লেখা রিপোর্টেই এটা উল্লেখ আছে”, যোগ করেন তিনি।
বিভিন্ন টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লায়লা বলেছে, “আমি বাংলাদেশে থাকতে চাই, কারণ আমি আব্বুর সঙ্গে থাকতে চাই।” ইমরানকেও বলতে শোনা গেছে, “তারা সবসময় তাদের বাবার সঙ্গে থাকতে চেয়েছে, তারা যদি বলতো মায়ের সঙ্গে জাপানে গিয়ে থাকবে, তাহলে আমি বলতাম ‘কোনো সমস্যা নেই’।”
এসব সাক্ষাৎকারে ইমরান উল্লেখ করেন, তার শ্বশুর তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন এবং অভিযোগ করেন এরিকো বাসায় সন্তানদের বাংলা বলতে দিতেন না, তাই তার সন্তানরা লুকিয়ে লুকিয়ে বাংলা বই পড়তো। তার ভাষ্যমতে, “লায়লা এখন অনেক ভালো আছে, এখন সে ‘পুরোপুরি বাংলাদেশি’। জাপানে থাকতে তাকে ‘হাফ-জাপানিজ’ বলে বিদ্রূপ করতো অনেকে।”
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের শুরু
ঢাকা পৌছানোর পর ইমরান শরীফ ঢাকা পারিবারিক আদালতে একটি মামলা করেন, যার ফলে এরিকো কিংবা তার পরিবারের কারো সাথে সন্তানদের বাংলাদেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এরিকো এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না এবং তাকে কোনো নোটিশও দেওয়া হয়নি। তিনি ২০২১ সালের মে মাসে একটি লিখিত রায় হাতে পান এবং তখন কোভিড-১৯ পরিস্থিতিও ছিল খারাপ। তিনি জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করেন এবং বাংলাদেশে এসে জানতে পারেন, ঢাকার পারিবারিক আদালত ইমরানকে সন্তানদের পূর্ণ হেফাজত দিয়েছেন। “যদিও তখনই আমার দুইবার ভ্যাকসিন নেওয়া হয়ে গেছে, তবুও সন্তানদের দেখার জন্য আমি পাঁচবার কোভিড পরীক্ষা করিয়েছি”, বলেন এরিকো।
তিনি জানান, ইমরান তাকে হোটেল থেকে গাড়িতে তোলেন, এর আগে তার ফোনের জিপিএস বন্ধ করেন এবং তাকে চোখ বেঁধে সন্তানদের সাথে দেখা করাতে একটা জায়গায় নিয়ে যান।
সন্তানদের সঙ্গে দেখা করে, এরিকো বুঝতে পারেন তাদের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। “আমি ওদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথাও বলতে পারছিলাম না, ওরা আমাকে এতটাই ঘৃণা করছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, ওদেরকে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে। আমি তখন ভাবলাম, আমি নিজে যদি সন্তানদের রক্ষা করতে না পারি, তাহলে কে করবে? এটা এক অর্থে শিশু নির্যাতন, মানসিকভাবে এবং আবেগীয় দিক থেকেও”, বলেন এরিকো।
যদিও আদালত সন্তানদের জিম্মা এরিকোকেই দিয়েছেন, কিন্তু লায়লা এখনও তার বাবার সঙ্গেই আছে। “আমরা জানি না সে এখন কোথায় আছে। এটা কিভাবে সম্ভব? (আদালতের আদেশ অমান্য করা)”, বলেন তার মা। তিনি জানান, লায়লাকে যখন তিনি শেষবার বিমানবন্দরে দেখেছেন, তখন তার বাবা তাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছিল।
জেসমিন বলে, “আমি আমার বোনকে মিস করি; তাকে শেষবার দেখেছি ৫ মাস হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে আমার চিন্তা হয়।” এদিকে নিজের ফেসবুক পেজে ইমরান লিখেছেন যে, এরিকোই জেসমিনকে ৮ মাস ধরে তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে দেয় না, যদিও তাদের বাসা খুব কাছেই।
প্রশ্ন করা হয়, মা যখন দূরে ছিল তখন তাকে এবং জাপানের জীবনকে কি মিস করেছো? সে উত্তর দেয়, “আমাকে ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছিল, ফলে একপর্যায়ে আমি মাকে ঘৃণা করতে থাকি। জাপানের জীবনের সঙ্গে জড়িত সবকিছুই আমার খারাপ ছিল, আমার বাবা আমাকেই এমনটাই ভাবতে শেখান।”
আদালতের রায় নিয়ে নিয়মিত ভিডিও ও নানারকম বার্তা নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট করেন ইমরান শরীফ। কখনো কখনো তিনি মেয়ের সাথে তার আলাপচারিতা নিয়েও ভিডিও দেন। তার পেজে ২ লাখ ৬৮ হাজার ফলোয়ার্স আছে, অনেকেই তাকে জানান যে তারা তার পাশে আছেন।
লায়লাকে নিয়ে এসব ভিডিও নিয়েও উদ্বিগ্ন এরিকো। “আমি দেখেছি অনেকে কমেন্ট করে, ‘চিন্তা করবেন না, আমি লায়লাকে বিয়ে করবো, ‘সে যেন একজন আদর্শ মুসলিম স্ত্রী হয় তা নিশ্চিত করব’ ইত্যাদি। অথচ লায়লার বয়স মাত্র ১১ বছর”, বলেন এরিকো।
কিন্তু আইনজীবী নাসিমা বলেছেন, একই যুক্তি এরিকোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, কারণ তিনিও একই ধরনের একটি পেজ চালাচ্ছেন।
সাক্ষাৎকারের সময় এরিকো আমাদেরকে ছোট একটি কার্ড দেখান, যেখানে জেসমিনের ফেসবুকের নাম ‘জেসমিন ফ্লাওয়ার’ ছাপানো রয়েছে। সেখানে আরও লেখা আছে ‘স্টপ প্যারেন্টাল চাইল্ড অ্যাবডাকশন’, স্টপ প্যারেন্টাল এলিয়েনেশন; যার অর্থ দাঁড়ায়- ‘শিশুকে তার বাবা/মায়ের যেকোনো একজনের থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া বন্ধ করুন’, ‘পিতা/মাতার যেকোনো একজনের সম্পর্কে শিশুর কাছে নেতিবাচকতা ছড়ানো বন্ধ করুন’, এটা নির্যাতনের সবচেয়ে খারাপ রূপ।’
ইমরান শরীফকে ইন্টারন্যাশনাল প্যারেন্টাল চাইল্ড অ্যাবডাকশন-এর অপরাধে অভিযুক্ত করার বিষয়ে আইনজীবী নাসিমা বলেন, এরিকোর উচিত সঠিক ফোরামের মাধ্যমে এ বিষয়ে কথা বলা। “যেহেতু তিনি এটা অনানুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমি এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারবো না। আইনের চোখে এ ধরনের বক্তব্যের কোনো অর্থ নেই, যদি না তা সঠিক জায়গায় বলা হয়।”
নতুন শুরুর জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা
এরিকো যে হাসপাতালে কাজ করতেন, তারা প্রায় দেড় বছর তার চাকরি বহাল রেখেছিল, ভেবেছিল তিনি ফিরে যাবেন জাপানে। “জাপানে প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কর্মীদের জন্য ট্যাক্স, সামাজিক কল্যাণমূলক ইত্যাদি নানা খাতে ব্যয় করতে হয়, আর সেটা একটা বড় অংকের টাকা। আর কতদিন তারা এমন একজনের জন্য টাকা খরচ করে যাবে যে কিনা কাজ করছে না?” কথাগুলো বলার সময় এরিকোর চোখেমুখে বেদনার ছাপ ছিল স্পষ্ট।
এরিকো জানান, বর্তমানে তিনি নিজের জমানো টাকা এবং তার পরিবারের সহায়তায় বাংলাদেশে থাকছেন। “এটা আমার জন্য খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আমার আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড দিয়ে টাকা উঠাতে পারি না। এর জন্য আমাকে জাপানি বন্ধুদের সাহায্য নিতে হবে।”
সন্তানদের হেফাজত ও অভিভাবকত্ব নিয়ে আইনি লড়াই কিভাবে বাংলাদেশ-জাপানের মধ্যকার সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে সে বিষয়ে এরিকো বলেন, “আমার মনে হয় এটা একটা গভীর প্রভাব ফেলছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল প্যারেন্টাল চাইল্ড অ্যাবডাকশন’ এর আলাদা একটা সংজ্ঞাই আছে। সারা বিশ্ব জানে এতে ভুক্তভোগী হয় শিশুরাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় জাপান সরকার আনুষ্ঠানিক এজেন্ডায় এ বিষয়টিও তুলে ধরেছে তাদেরই দেশের নাগরিক যেন শিশু নির্যাতনের শিকার না হয়, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে।”
তিনি বলেছেন তারা কোনো অন্যায় করেনি, তবুও ‘আমাদের মনে হয় আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই’। গত বছর ঈদের সময়য় তারা কোনো এক জায়গায় গিয়েছিলেন এবং দাবি করেন যে, ইমরান সেখানে নোটিশ নিয়ে হাজির হন যে তার মেয়েরা সেখানে যেতে পারবে না।
দিনের পর দিন এই আইনি লড়াইয়ে এরিকো নিজেও ক্লান্ত। তবু হাল ছাড়তে নারাজ তিনি। “আমি হাল ছাড়বো না। নিজের মেয়েদের কিভাবে আমি এখানে ছেড়ে যাই? কিন্তু, আমাদের তো ফিরে যাওয়ার স্বাধীনতাও নেই”, বলেন তিনি।
এরিকো জানান, ইমরান তার সন্তানদের পিতা একথা তিনি অস্বীকার করেন না। কিন্তু তার ভাষ্যমতে, ‘একজন বাবা যে কিনা নিজের সন্তানকে তার মায়ের অজান্তে অন্য দেশে নিয়ে যেতে পারে, সেটা খুবই বিপজ্জনক এবং এটা আমার আবেগ নয়, বরং যুক্তিসঙ্গত চিন্তা।”
জেসমিন বলে, “পেছনে ফিরে তাকালে দেখি, যখন এইসব জটিলতা তৈরি হয়নি- আমরা বাবাকে ভালোবাসতাম, এখনও হয়তো কোনো না কোনোভাবে ভালোবাসি; কিন্তু আমরা তার নানান আচরণ দেখেছি, আমরা জানি না তার কাছ থেকে আর কি প্রত্যাশা করার আছে।”
এরিকো কি স্বামীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? এর জবাবে তিনি বলেন, “এটা আসলে জটিল প্রক্রিয়া (তাদের বিবাহবিচ্ছেদ)। জাপানে ডিভোর্স সম্পন্ন হতে হলে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই স্বাক্ষর করতে হবে, কিন্তু ইমরান স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানায়। এটা একটা হেনস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়।”
সন্তানরা কি ভবিষ্যতে তাদের বাবাকে দেখতে পারবে? “ইন্টারন্যাশনাল চাইল্ড অ্যাবডাকশন-এর প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে, কখনো কখনো অভিভাবককে জেলেও পাঠানো হয়; অথবা তারা সমাজকর্মী বা মনোবিজ্ঞানীদের নজরদারিতে প্রতি মাসে আধাঘণ্টার জন্য দেখা করতে পারে সন্তানদের সাথে। টোকিও পারিবারিক আদালতের আদেশ অনুযায়ী, এটা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে ইমরান তার সন্তানদের সাথে দেখা করতে পারবে, কিন্তু তবুও সে এসব করেছে”, বলেন এরিকো।