Site icon The Bangladesh Chronicle

এক নারী রাজনীতিককে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য


সম্প্রতি বিএনপির একজন নারী রাজনীতিককে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন তার বিরোধীপক্ষ। বিভিন্ন টকশোতে, বিভিন্ন জায়গায় সাংবাদিকদের কাছে, রাজনৈতিক মঞ্চে এমন অশালীন মন্তব্য করছেন অনেকে।

বিএনপির এই নারী রাজনীতিক একজন আইনজীবী ও লেখিকা হিসেবেও পরিচিত। তিনি কয়েক বছর যাবৎ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে টকশোতে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে প্রতিবাদী হয়ে কথা বলছেন। আইনের যুক্তি তুলে ধরছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক মঞ্চেও সরকারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে বক্তৃতা করছেন। তিনি বিশেষ সুযোগে সংসদের সংসদ সদস্য হিসেবে গিয়েছেন এবং দলের সিদ্ধান্তে সেই পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। সংসদে থাকাকালীনও সংসদে নাগরিকদের বিভিন্ন অধিকার নিয়ে তিনি কথা বলেছেন, নারী নির্যাতন নিয়ে কথা বলেছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে লুট করা হয়েছে সেসবও তুলে ধরেছেন।

কয়েক বছর দেশের বেশির ভাগ নাগরিক সংসদ অধিবেশন দেখেন না বা শোনেন না। কারণ গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতির অনুপস্থিতি। ঠিক সেই মুহূর্তে বিএনপির এই নারী রাজনীতিক সংসদ সদস্য হয়ে সংসদে বক্তব্য দিয়ে নাগরিক সমাজের দৃষ্টি কেড়েছেন। আমরা যদি দাবি করি আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক এবং আমরা সভ্য তাহলে মানুষকে রাজনীতি করার সুযোগ দিতে হবে। কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু রাজনীতি করলে, ন্যায়সঙ্গত কথা বললে তাকে অশালীন ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে এটা কোনো সভ্য দেশে ঘটতে পারে না। শুধু একটি গোষ্ঠীই একতরফা এক আদর্শের রাজনীতি চালিয়ে যাবে; অন্য কেউ রাজনীতি করতে পারবেন না, কথা বলতে পারবেন না এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হতে পারে না।

বাংলাদেশকে নারী অধিকারের দেশ বলা হয়। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে আমাদের দেশের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করছেন দু’জন নারী। বিশ্বে বাংলাদেশের বাইরে অন্য কোনো রাষ্ট্র পাওয়া মুশকিল, যেখানে নারীরা এত বড় বড় পদে সমাসীন আছেন। কিন্তু তার পরও এই রাষ্ট্রে নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত অপমানিত হচ্ছেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- রাষ্ট্রে নারীই নারীর বিরুদ্ধে। অথচ এখানে নারী অধিকারের জন্য নারীনেত্রীর অভাব নেই। এসব নারীনেত্রী কখনোই নারীদের প্রকৃত নারী অধিকারের পক্ষে কাজ করতে পারেননি। এক নারীনেত্রী আরেক নারীনেত্রীকে হিংসার চোখে দেখছেন। একই রাজনৈতিক দল করলেও এক নারীনেত্রী আরেক নারীনেত্রীকে সহ্য করতে পারেন না।

বিএনপির যে নারীনেত্রীকে নিয়ে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কয়েক জন অশালীন মন্তব্য করেছেন তাকে বিএনপির অন্যান্য অনেক নারীনেত্রীরাও সহ্য করতে পারেন না! সম্প্রতি বিএনপিরই এক নারীনেত্রীর মন্তব্য থেকে সেটা প্রমাণিত। বিএনপির সেই নেত্রী বলেছেন টকশো করলে নেত্রী হওয়া যায় না, কারো আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে এসেছেন, অলৌকিকভাবে এসেছেন, মাথার ওপরে মগজ হয়ে বসেছেন ইত্যাদি। তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন বিএনপির সেই তরুণ নেত্রী হঠাৎ দলে এসে বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। বিএনপি যে নেত্রী এই মন্তব্য করেছেন, তিনি অতীতে নিজে নারী সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। একজন সাহসী বক্তা হিসেবে সুনামও রয়েছে তার। একসময় সংসদে তিনি অত্যন্ত জোরালো ভাষায় প্রতিবাদী বক্তৃতা দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। অবশ্যই বিএনপির আরো কয়েকজন নারী নেত্রী সংসদ সদস্য হয়ে সংসদে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেছেন।

আমাদের দেশে বড় একটা সমস্যা হচ্ছে একজন নারী আরেক জন নারীকে সাধারণত সহ্য করতে পারেন না। যত উচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্তই হোন না কেন, আমাদের দেশে নারী রাজনীতিকসহ করপোরেট জগতের এবং প্রায় সব ক্ষেত্রের উচ্চপদে সমাসীন নারীদের মধ্যে তীব্র মাত্রায় দলাদলি লক্ষ করা যায়। নারীর বহু ধরনের সমস্যা রয়েছে এ দেশে। সেসব সমস্যা সমাধানে যোগ্য নারীরাজনীতিকও প্রয়োজন। দেশে এত নারীনেত্রী থাকলেও নারী নির্যাতন কমছে না। বরং দিন দিন আরো বাড়ছে। দৈনিক প্রথম আলো ২৭ ডিসেম্বর ২০২২ প্রধান শিরোনাম করেছে ‘নারী নির্যাতন বাড়লেও সরকারি পদক্ষেপ কম।

বিএনপি-আওয়ামী লীগ আমাদের দেশে বড় দুটি রাজনৈতিক দল। এখানে নারী-পুরুষ একত্রে রাজনীতি করেন। একই মঞ্চে বসেন। মিছিল করেন একসাথে। এতে অনেক সময় কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম হতেও দেখা গেছে। কয়েক দিন আগে ইডেন কলেজ থেকে সেটি আবার প্রমাণিত হয়েছে। যেহেতু বিএনপি আওয়ামী লীগ একই সিস্টেমে নারী-পুরুষের রাজনীতি চালাচ্ছেন সে ক্ষেত্রে তরুণ সেই বিএনপি নেত্রীর দোষ কী? তাকে নিয়ে কেন আপত্তিকর মন্তব্য করা হচ্ছে? বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-নেত্রী বিএনপির সেই তরুণ নেত্রীকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেছেন। পঞ্চাশের কম বয়স হওয়া নিয়েও তাকে কটূক্তি করা হয়েছে। অথচ তার থেকে কম বয়সে বিশ্বের বহু রাষ্ট্রে অনেকে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, রাজা হয়েছেন, রানী হয়েছেন, সুলতান হয়েছেন, বাদশা হয়েছেন, আমির হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বাংলাদেশের আইনে পঁচিশ বছরে এমপি পদে বসতে পারেন। পঁয়ত্রিশ বছরে রাষ্ট্রপতি। কেন বয়স নিয়ে এত আপত্তি?

ইউটিউবে নানান অশালীন কথাবার্তা ভাসছে, যা আপত্তিকর। এসবের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম কী শিখবে? এসব অশালীন মন্তব্য কথাবার্তা বন্ধ না করলে পুরো জাতি এমন সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য প্রবেশ করবে। বড় একটি সমস্যা হচ্ছে- বিএনপি-আওয়ামী লীগ উভয় দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা খুব দুর্বল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইওয়াশ হিসেবে নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য কাউন্সিল হয়। দুর্নীতি উভয়ের মধ্যে বিদ্যমান। উভয় দল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বের হতে পারছে না দল দুটি। এমপি যে একবার হয়েছেন তার ছেলে বা স্ত্রীকেও এমপি হতে হবে! মেয়র যে একবার হয়েছেন তার স্ত্রী-ছেলেকেও সেটি হতে হবে! এমন কালচার উভয়ে দলে তৈরি হয়েছে।

তরুণ বিএনপি নেত্রীর বাবা ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ছিলেন একজন সৎ শিক্ষিত রাজনীতিবিদ। তার মা একজন উচ্চপর্যায়ের শিক্ষাবিদ। তিনি নিজেও ব্রিটেন থেকে আইনে ভালো ডিগ্রি নিয়েছেন। মার্জিত ভাষায় নাগরিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন। এতে সমস্যা কী? তাই আমরা চাই, দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ধারার চর্চা শক্তিশালী হোক।

Exit mobile version