Site icon The Bangladesh Chronicle

একদিন আগেই জড়ো হচ্ছেন নেতাকর্মীরা, প্রস্তুত হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

logo

মোস্তাফিজুর রহমান
জাতীয় সমাবেশের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার |নয়া দিগন্ত

সাত দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আগামীকাল (১৯ জুলাই) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতাকর্মীরা ঢাকায় এসে সমাবেশস্থলে জড়ো হচ্ছেন।

শুক্রবার (১৮ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও এর আশপাশে নেতাকর্মীদের উপস্থিত দেখা গেছে। উদ্যানের মাঠে নেতাকর্মীরা মাগরিবের নামাজ আদায় করেছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো এককভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশের ডাক দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এর আগে বিএনপির সাথে যৌথভাবে কিছু সমাবেশে অংশ নিলেও এককভাবে এটিই তাদের প্রথম সমাবেশ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করবেন জামায়াতের আমির ডা: শফিকুর রহমান।

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন রাজধানীতে বড় বড় সমাবেশ করেছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ওলামা-মাশায়েখ বাংলাদেশ এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ বিভিন্ন ইস্যুতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করেছে। বিএনপি নয়াপল্টনে কয়েক দফা সমাবেশ করলেও জামায়াতে ইসলামী কেবল কারাবন্দি নেতা (বর্তমানে মুক্ত) এ টি এম আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবিতে পুরানা পল্টন মোড়ে একটি সমাবেশ করেছিল।

সাত দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সমাবেশের ডাক দিলেও এর অন্তরালে কৌশলগত নানা হিসাব-নিকাশ রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে:

অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, সকল গণহত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, ‘জুলাই সনদ’ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন ও এক কোটিরও বেশি প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে আমরা নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছি, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার হারিয়েছি। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাকস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা যতটুকু ভোগ করছি, তারই ধারাবাহিকতায় আজ জাতীয় সমাবেশ করার সুযোগ পাচ্ছি।

৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর এটি হবে জামায়াতের সবচেয়ে বড় জনসমাবেশ। রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। কেউ কেউ এটিকে নির্বাচনপূর্ব কৌশলগত অবস্থান হিসেবেও দেখছেন। জামায়াত বলছে, এটি শুধু দলীয় সমাবেশ নয়, বরং দেশের সাধারণ মানুষের ন্যায্য দাবির প্রতিচ্ছবি।

দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ সমাবেশ হবে তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জমায়েত। এজন্য ট্রেন ও লঞ্চ ছাড়াও ভাড়া করা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার বাস। সমাবেশে ১০ লাখের বেশি নেতাকর্মী উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে। নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে থাকবেন ৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক।

সমাবেশস্থলে থাকবে ১৫টি মেডিক্যাল বুথ, ১৫টি পার্কিং স্পট এবং সমাবেশ বাস্তবায়নে গঠিত হয়েছে ৮টি উপ-কমিটি।

শনিবার বেলা ২টায় মূল সমাবেশ শুরু হবে। তবে সকাল ১০টা থেকে জামায়াতের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে। সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন বিভিন্ন ইসলামী দল ও রাজনৈতিক দলের নেতা, জুলাই শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিরা।

সমাবেশকে ঘিরে রাজধানীতে সম্ভাব্য যানজট বা ভোগান্তির জন্য নগরবাসীর কাছে আগাম দুঃখপ্রকাশ করেছে জামায়াত এবং এটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ জানিয়েছে।

জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা ঐতিহাসিক জমায়েত করতে চাই সোহরাওয়ার্দীতে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দরকার, তা নিশ্চিত করতে হবে। জুলাই গণহত্যার বিচার দ্রুত শেষ করতে হবে। যেন এ বিচার নির্বাচনের আগে দৃশ্যমান হয়। কোনো ষড়যন্ত্র যেন এই সংস্কার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে না পারে।

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এককভাবে জামায়াতের এটাই প্রথম জনসভা। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতি এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনমত গঠন করাই আমাদের লক্ষ্য।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিকে ঘিরে সমাবেশস্থলে পুরো বিকেল ছিল কর্মব্যস্ততায় মুখর। দীর্ঘদিন পর রাজধানীতে এমন রাজনৈতিক সমাবেশের আয়োজনকে ঘিরে দলটির নেতাকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক এবং প্রশাসনিক সমন্বয়কারীদের মধ্যে চোখে পড়ার মতো তৎপরতা দেখা গেছে। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক বালু ছিটানো, চেয়ার বসানো, টয়লেট ও পানির কল স্থাপন, জায়ান্ট স্ক্রিনের তার সংযোগসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। মাঠজুড়ে পানি অপসারণের জন্য ফেলা হয়েছে বালু ও কংক্রিট, ছিটানো হয়েছে ব্লিচিং পাউডার।

রাজধানীর শাহবাগ, জাতীয় প্রেস ক্লাব, হাইকোর্ট, কাকরাইল, মৎসভবন, টিএসসি, দোয়েল চত্বর এলাকায় দলটির নেতাকর্মীদের উপস্থিতি দেখা গেছে। ছোট ছোট গ্রুপ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করতে দেখা যায়। কারো হাতে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকও ছিল। আগত অধিকাংশ নেতাকর্মীদের গায়ে পাঞ্জাবি থাকলেও কারো কারো গায়ে সাদা গেঞ্জি পড়তে দেখা গেছে। গেঞ্জিতে লেখা রয়েছে, ‘তারুণ্যের প্রথম ভোট, চাঁদাবাজের বিপক্ষে হোক’, ‘দাঁড়িপাল্লা ভোট দিন’।

বরিশাল থেকে সমাবেশে আসা সাইফুল ইসলাম বলেন, বরিশাল জেলা থেকে ১১ হাজারেরও বেশি লোক সমাবেশে আসবেন। এ ছাড়া মহানগরী থেকেও বিপুল সংখ্যক লোক সমাবেশে যোগ দেবেন। পথের ভোগান্তি কথা চিন্তা করে ইতোমধ্যে অনেকেই ঢাকা এসেছেন বলে জানান তিনি।

নোয়াখালী থেকে আসা দলটির নেতাকর্মীরা জানান, আগামীকাল সকাল থেকেই আমাদের সমাবেশ শুরু হবে। রাস্তার যানজটের কথা চিন্তা করে আজ চলে এসেছি।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে থাকা আমজাদ হোসেন বলেন, আমাদের শিবিরের নেতাদের স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। রাতে এখানে আমরা অবস্থান করব। বিভিন্ন গ্রুপের আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া আছে। রাতে সারাদেশ থেকে যেসব নেতাকর্মীরা আসবেন তাদের সেবার দায়িত্বে আমরা আছি।

জানা গেছে, সমাবেশে নেতাকর্মীদের আনতে তিন জোড়া বিশেষ ট্রেন ভাড়া করেছে দলটি। এসব ট্রেন একবার করে চলবে রাজশাহী-ঢাকা-রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ-ঢাকা-সিরাজগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ-ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে।

আরো জানা গেছে, ১৯ জুলাই সকাল ১০টা থেকে কুরআন পাঠ হবে। এতে হামদ ও নাত পরিবেশন করা হবে। মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে দুপুর ২টায়। সমাবেশস্থলে ২০টি পয়েন্টে প্রায় ৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক দায়িত্ব পালন করবেন। ঢাকা শহরের বাইরে থেকে যারা আসবেন তাদের জন্য কমপক্ষে ১৫টি পার্কিং পয়েন্ট রাখা হয়েছে।

ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, প্রায় এক মাস ধরেই আমরা মনিটরিং করছি। আবহাওয়া কিছুটা দুর্যোগপূর্ণ হওয়ায় মাঝে মধ্যেই পানি নিষ্কাশন, ইট ফেলা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য প্রচুর শ্রম দিতে হয়েছে।

দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সমাবেশে অংশ নিতে ঢাকা ও এর বাইরের জেলা থেকে কয়েক লাখ মানুষ আসবেন। তাই সমাবেশস্থল ও আশপাশের এলাকাজুড়ে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। উদ্যানের বিভিন্ন প্রান্তে বসানো হয়েছে ৫০০ এর বেশি অস্থায়ী টয়লেট এবং অজুর জন্য এক হাজার পানির কল।

প্রস্তুতি প্রসঙ্গে শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া হলেও যেন সমাবেশে অংশগ্রহণকারী মানুষের কষ্ট না হয়, সে জন্য আমাদের কর্মীরা আগে থেকেই সব ব্যবস্থা নিচ্ছে। নিরাপত্তা, সেবাপ্রদান ও শৃঙ্খলার বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক।

জামায়াত নেতারা জানিয়েছেন, মঞ্চের দুই পাশে থাকছে দুটি বড় জায়ান্ট স্ক্রিন এবং সমাবেশের আশেপাশে গুরুত্বপূর্ণ ৫০টিরও বেশি পয়েন্টে বসানো হয়েছে এলইডি স্ক্রিন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাজুড়ে ৪০০টির বেশি মাইক বসানো হয়েছে। অতিথি ও নেতাদের বসার জন্য মঞ্চের সামনের দুই পাশে রাখা হয়েছে ৬০০ চেয়ার।

মাঠের ভেতরে ও বাইরে আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে স্থাপন করা হয়েছে একাধিক মনিটরিং সেল। দলে ৬ হাজারের মতো স্বেচ্ছাসেবক আটটি বিভাগের আওতায় কাজ করবেন বলে জানানো হয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থাপনায় ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে জামায়াত নেতারা। ঢাকার বাইরের বাসগুলোর ড্রপিং পয়েন্ট নিয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশনা তৈরি হয়েছে।

সাংবাদিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে দলটির নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। আপনারা সংবাদকর্মীরা আমাদের খবর দেশ-বিদেশে পৌঁছে দিচ্ছেন, এজন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা চাই, সাংবাদিকরাও যেন এই ঐতিহাসিক আয়োজনে সহযোগিতা করে চলেন।

এদিকে দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশস্থল পরিদর্শন করেছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।

দলের নায়েবে আমির সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিদর্শন টিমে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, অ্যাডভোকেট মোয়াযযম হোসাইন হেলাল ও অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মো: সাহাবুদ্দিন ও মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, ঢাকা মহানগরী উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি ইয়াসিন আরাফাত ও ডা. ফখরুদ্দিন মানিক, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি মুহাম্মাদ দেলাওয়ার হোসেন, ঢাকা মহানগরী উত্তরের প্রচার সেক্রেটারি আতাউর রহমান সরকার প্রমুখ।

Exit mobile version