Site icon The Bangladesh Chronicle

ঋণ করে উন্নয়ন দুর্নীতিকে আরও উসকে দেবে

ঋণ করে উন্নয়ন দুর্নীতিকে আরও উসকে দেবে

বিরূপাক্ষ পাল

আশা করা হয়েছিল নতুন অর্থমন্ত্রী তাঁর অধীত শিক্ষার প্রয়োগ ঘটাবেন এই বাজেটে। তিনি অর্থনীতির শিক্ষক ও কূটনীতির মানুষ। কিন্তু তিনি কোনো নতুনত্ব দেখাতে পারলেন না। আগের অর্থমন্ত্রী যে যে ভুল করে বাজেটকে বেপরোয়া বানিয়ে গেছেন, তা থেকে এই অসহায় কাঠামোকে উদ্ধার করতে পারলেন না। আগের অর্থমন্ত্রী হিসাববিদ ছিলেন। তাঁর কাজকর্মে অর্থনীতির নামগন্ধ ছিল না। যদিও তিনি মাঝেমধ্যে অর্থনীতির নতুন নতুন তত্ত্ব দেওয়ার চেষ্টা করতেন।

যেমন সুদের টুপিতত্ত্ব ও রেমিট্যান্সের প্রণোদনাতত্ত্ব—কোনোটিই কাজে আসেনি। বরং ক্ষতি করেছে। কাজের সীমারেখা বুঝতেন না বলে খেলাপি ঋণের বিশ্ব-শিথিল নব সংজ্ঞায়ন করে পুরো ব্যাংকিং খাতকে রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে গেছেন। আজকের অর্থনীতির সংকটের পেছনে তাঁর ‘অসামান্য কৃতিত্ব’ রয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, নতুন অর্থমন্ত্রী আগের মতো ভুল গিয়ারে গাড়ি চালাবেন না, যা সরকারকে আরও খাদে নিয়ে নামাবে।

বাজেটকে বিরোধী দল ‘গণবিরোধী’ বলবে আর সরকারি দল বলবে ‘চমৎকার’—এ সংস্কৃতিতে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু কিছু অসংগত দাবি অস্বস্তিকর বটে। আয়বৈষম্যের প্রকট উত্থান সত্ত্বেও সরকারি দলের একজন বললেন এটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের বাজেট।

দু–একজন নেতা বললেন যে বর্তমান ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতির’ তুলনায় এ বাজেট অনেক ভালো হয়েছে। বিশ্বের কোথায় পরিস্থিতি খারাপ, সেটা বোঝা গেল না। সবাই তো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ফেলেছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশেও। ওদের রিজার্ভও বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক বড় অর্থনীতিতে বেকারত্ব অনেক কম। কারও জন্য এটি রেকর্ড। বৈশ্বিক তেল ও পণ্যের দামও পুতিন-তাড়িত যুদ্ধের পূর্বাবস্থায় চলে গেছে। কোভিড, পুতিন, যুদ্ধ—এগুলো এখন অপ্রাসঙ্গিক আলাপ।

কথা ছিল বাজেট হবে সংকোচনমূলক। এই মুহূর্তে সংকোচনমূলক হওয়া আবশ্যক ছিল। তা না হলে মাসখানেক পর ঘোষিতব্য মুদ্রানীতি একা সংকোচনমূলক হয়ে কাজ করতে পারবে না। গাড়ির গতি কমাতে গেলে এর ব্রেক সিস্টেম যদি সব কটি চাকার ওপর একসঙ্গে কাজ না করে, তাহলে যথাস্থানে গাড়ি থামানো যায় না। গাড়ি উল্টে যায়। আড়াই বছর ধরে মূল্যস্ফীতির দহন সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষকে যেভাবে যাতনা দিচ্ছে, তার দীর্ঘায়ুর পেছনে একটা বড় কারণ বাজেট ও মুদ্রানীতি কখনোই যৌথভাবে সংকোচনমুখী হয়নি।

উচ্চ রক্তচাপের রোগীকে ঠিক করতে হলে ওষুধ ও পথ্য—দুই পথেই সহগামী ও সংগতিপূর্ণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। একদিকে ওষুধ খেয়ে অন্যদিকে কোলেস্টেরলবর্ধক খাসির তেল আর বেশি বেশি লবণ খেলে রক্তচাপের মাত্রা আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশের গত তিন বছরের নীতি প্রণয়নের ইতিহাস মানে এই খাসির তেল আর ওষুধের যুগপৎ অগ্রযাত্রা, যা মূল্যস্ফীতিকে উচ্চ স্থানে ধরে রেখেছে। এবারের বাজেট সংযত হওয়ার কোনো পদক্ষেপ দেখায়নি। তাই মূল্যস্ফীতি কমার কোনো ভরসাও এ থেকে লাভ করা যায়নি।

বিশ্বব্যাংকের মতে, বর্তমান অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৬ ভাগ। সংকোচনমূলক বাজেটের সদিচ্ছা থাকলে ২০২৫ অর্থবছরের জন্য শতকরা পৌনে ৭ ভাগ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্থমন্ত্রী গ্রহণ করতেন না। বড়জোর ৪–৫ ভাগে সীমিত থাকতেন। এ নিয়ে জনতার মধ্যে হইচই শুরু হতো না, যতটা হইচই হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ে।

প্রবৃদ্ধির অঙ্ক বাড়ালে বাজেটের হিসাবপত্রে অন্য সংখ্যাগুলোকেও বাড়াতে হয়েছে। তাই বাজেটকে সীমিত রাখা যায়নি। সে জন্যই দাবি করা যায় যে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি দমনে যথেষ্ট আন্তরিক নন। কিংবা আন্তরিক থাকলেও গাড়ির ব্রেকের পরিবর্তে এক্সেলেটরে পা চেপেছেন। এখন মুদ্রানীতি যদি শক্ত করে হ্যান্ডব্রেক টেনে ধরে, তাহলে গাড়ি উল্টে যেতে পারে। বাজেটে এই নীতি–সামঞ্জস্য বজায় রাখা হয়নি। ফলে বাজেটের প্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা এক উদ্ভট অনুমান বলেই মনে হচ্ছে। কোনো গবেষণা বা অর্থনীতি নেই এর পেছনে।

টিভিতে সাধারণ ক্রেতা–বিক্রেতারা বলছেন, বাজেট হয়েছে মানেই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। বাজেট হলেই দাম বাড়ে—এই মিথ বহুলাংশে ভাঙার জন্য যে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন ছিল, তার ধারেকাছে নেই এই বাজেট। ২০২৪–এর নির্বাচনী বাজেট থেকেও এটি প্রায় ১২ ভাগ বৃহত্তর। উন্নয়ন খরচ অনেকটা বেপরোয়া পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল বলে অর্থনীতিকেরা সরকারকে সতর্ক করছিলেন। চলমান অর্থবছরের বাজেট থেকেও আগামী বছরে উন্নয়ন বাজেট বাড়ল শতকরা ৮ ভাগ। বাজেট ঘাটতি বাড়ল শতকরা ৮ দশমিক ৩ ভাগ। অর্থাৎ কোথাও এমন কোনো সংযমের সুর লাগেনি, যা দিয়ে ভরসা করা যেত যে মূল্যস্ফীতি হয়তো কমতে পারে। বরং উল্টো সুর। সাবেক অর্থমন্ত্রী থাকলে হয়তো এ রকম বাজেটই দিতেন। বাজেটে নবনির্বাচিত অর্থমন্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া গেল না।

এটি অবশ্য ঠিক, বললেই বাজেটে বড়মাপের পরিবর্তন আনা সম্ভব হয় না। যেমন চলতি ব্যয় যা—বেতন, ভাতা, বাসা ভাড়া প্রভৃতি কমানো যায় না। কমানো যায় উন্নয়ন ব্যয় অন্তত স্বল্পকালের জন্য। সেটি করা উচিত ছিল, যা দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিকে লাভবান করত। আমাদের দেশের উন্নয়ন ব্যয়ের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা উন্নত দেশে তো বটেই, এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোতেও দেখা যায় না। এখানে সর্বব্যাপ্ত দুর্নীতির কারণে এক টাকার ঘোড়া তিন টাকার দানা খায়। মাইলপ্রতি নির্মাণ ব্যয় বিশ্বের সর্বোচ্চ। সেতু নির্মাণেও খরচ মানে একেকটি রেকর্ড। কালক্ষেপণেও বাঙালি ঠিকাদারেরা শামুকের বন্ধু। উন্নয়ন ব্যয় আপাতত কমানো মানে পরোক্ষভাবে দুর্নীতিরও কিছুটা লাগাম টানা। সেটি এই বাজেটে করা হয়নি।

এর ধাক্কা গিয়ে পড়বে দুই জায়গায়। বিদেশি ঋণ গ্রহণ বেড়ে যাবে শতকরা প্রায় ২০ ভাগ। গত পাঁচ বছরে বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ফলে দেশের ঋণজনিত ঝুঁকি বাড়ছে। রেটিং এজেন্সিগুলো অর্থনীতির মান কমাচ্ছে এবং ঋণের ব্যবস্থাপনায় ভালো ‘আউটলুক’ দেখাচ্ছে না। আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঁধে অনেক বেশি বোঝা দিয়ে যাচ্ছি। ঠিক এই জায়গায় অনেকে চট করে যুক্তরাষ্ট্র বা জাপানের উদাহরণ দিয়ে ফেলেন। এসব রাজনীতিক বোঝেন না যে আগে জাপান হয়ে এরপর ঋণ বাড়াতে হয়। ঋণ বাড়িয়ে জাপান হওয়া যায় না। তাহলে স্কুল পালিয়েই রবীন্দ্রনাথ হওয়া যেত।

অভ্যন্তরীণ ঋণ কমিয়ে আনা উচিত ছিল। কারণ দুটি—১. নির্বাচনের আগে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি উসকে দেওয়া হয়েছে। তাই এটি সংযত করার কথা ছিল এবং ২. সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিলে ব্যক্তির জন্য বাকি তহবিলের সুদহার বেড়ে যায়। এই সুদহার বাড়ায় দ্রব্যের উৎপাদন খরচ বাড়ে এবং বিক্রেতা আগের চেয়ে অধিক দামে ওই দ্রব্য বেচতে বাধ্য হয়, যা মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। এ ছাড়া উচ্চতর সুদহারের কারণে খাঁটি উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীরা প্রয়োজনের চেয়ে ঋণ কম নেন, যাকে আমরা সরকার কর্তৃক সৃষ্ট ‘ক্রাউডিং আউট’ প্রভাব বলে থাকি। এতে বেকারত্ব বাড়ে ও জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে।

অন্যদিকে অখাঁটি লুটেরারা সুদহারের ধার ধারে না বলে তারা বেশি ঋণ নেয় এবং ব্যাংকিং খাতের ক্ষতিসাধন করে। এই দুষ্টচক্র ভাঙার জন্যই এবার প্রয়োজন ছিল উন্নয়ন বাজেট কমিয়ে আনা। আগের খোলসে থেকে ‘ঋণ করে ঘি খাওয়া’ চালিয়ে যাওয়া মানে মূল্যস্ফীতি বাড়ানো, প্রবৃদ্ধি কমানো এবং সর্বোপরি বেকারত্বকে আরও কষ্টকর অবস্থায় ঠেলে দেওয়া।

আশা ছিল, অর্থমন্ত্রী নিজে অর্থনীতির একজন সাবেক শিক্ষক হিসেবে ব্যাপক ঋণনির্ভর উন্নয়ন বাজেট চালিয়ে যাওয়ার এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো অনুধাবন করবেন। এর প্রতিফলন বাজেটে নেই বিধায় অচিরেই মুদ্রানীতি দেওয়ার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরেকটু বিপদে পড়বে বলে মনে হচ্ছে।

দেশকে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা দিতে হলে একদিকে রাজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দাগি বড়লোককে সাঁড়াশি অভিযানের আওতায় এনে কর দিতে বাধ্য করতে হবে। খেলাপির ওপর কর বাড়ানো নৈতিকতার অঙ্গ। অন্যদিকে রাজস্ব পরিস্থিতি উন্নত না হওয়া পর্যন্ত অন্তত আগামী তিন বছর উন্নয়ন ব্যয়ের লাগাম টানতে হবে।

 ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক

prothom alo

Exit mobile version