টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক, গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ।
প্রস্তাবিত ডেটা বা উপাত্ত সুরক্ষা খসড়া আইনের কয়েকটি ধারায় মানবাধিকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় অন্তত ১০টি পর্যবেক্ষণ ও আপত্তি জানিয়ে জাতিসংঘ এ থেকে বেরিয়ে আসতে বলেছে বাংলাদেশকে। আগস্ট ২০২২ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশেলেত বলেছিলেন, খসড়া উপাত্ত সুরক্ষা ও ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফর্মস (ওটিটি) সংক্রান্ত বিধিবিধান যাতে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়, তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নাগরিক সমাজ ও জাতিসংঘের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করা প্রয়োজন। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি বলেছে, এই আইন প্রণয়ন হলে ব্যক্তির গোপনীয়তা ঝুঁকিতে পড়বে।
জাতিসংঘের আপত্তি পর্যবেক্ষণ এবং পরামর্শ
‘স্পর্শকাতর ডেটা’র সংজ্ঞায় আপত্তি তুলে জাতিসংঘ বলেছে, খসড়া আইনে স্পর্শকাতর তথ্য-উপাত্তের সংজ্ঞার গণ্ডি বেশ সীমিত। জাতি বা বর্ণগোষ্ঠী, রাজনৈতিক মতামত, বাণিজ্য সংগঠনের সদস্যপদ, ধর্মীয় বা অন্যান্য বিশ্বাস, যৌন জীবন, যৌনতার ঝোঁকসম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ ‘স্পর্শকাতর ডেটার’ সংজ্ঞার বাইরে রাখা হয়েছে। খসড়া আইনে, ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্তের কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। খসড়া আইনের পঞ্চম অনুচ্ছেদে বলা তথ্য-উপাত্ত সুরক্ষার নীতি যথেষ্ট নয়। ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্ত বিষয়ে ‘কনভেনশন ১৮০ প্লাস’-এর উদাহরণ দিয়েছে তারা। আইনের খসড়ার ৪২ ও ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, উপাত্ত স্থানীয়করণে নজরদারি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। খসড়ায় উপাত্তের স্থানীয়করণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা উন্মুক্ত ইন্টারনেটবিষয়ক বৈশ্বিক নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশের সব ডিজিটাল আইন শুধু সরকারকে সুবিধা ও সুরক্ষা দিতে তৈরি, এখানে নাগরিকের ব্যক্তিগত আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষায় কোনো ডিজিটাল আইন হয়নি। ডেটার যদি অপব্যবহার ও বিধিবহির্ভূত বাণিজ্য না হয়, তাহলে ডেটা দেশ-বিদেশের ক্লাউড নেটওয়ার্কে থাকলেও সমস্যা নেই। অপব্যবহার না করার শর্তে ডেটার স্থানীকরণ দেশের ব্যবসা বিকাশে সহায়ক। কিন্তু যে দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা, গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহি নেই, সেখানে অপব্যবহার এবং অপব্যবহারের দায়মুক্তিই প্রধান আশঙ্কা।
খসড়ায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা সংস্থার একজন মহাপরিচালক উপাত্ত সরবরাহে নির্দেশনা দিতে পারবেন। জাতিসংঘ মনে করে, এতে তথ্য-উপাত্তে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও জাতীয় কর্তৃপক্ষের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকবে। জাতিসংঘ এ নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আইনের ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে এই আইন প্রয়োগ থেকে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে, এতে বাংলাদেশের ডেটা সেন্টার ও সার্ভারগুলো নজরদারিতে পড়তে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানি ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষকে গোপন তথ্য প্রকাশ করতে চাপ দেওয়া হতে পারে, যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।
খসড়া মতে, আইন মেনে না চলা প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত ব্যক্তি যেমন শেয়ারহোল্ডার, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিচালক, কর্মী বা প্রতিনিধিকেও এই কাঠামোতে ব্যক্তিবিশেষকে জবাবদিহির আওতায় আনা যাবে। জাতিসংঘের মতে, উপাত্তের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জরিমানা যৌক্তিক হলেও ফৌজদারি দায়বদ্ধতা আরোপের যে ব্যবস্থা প্রস্তাব করা হয়েছে, তা ফৌজদারি আইনের নীতি বা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এবং বিষয়টি উদ্বেগের। এটি আইনে পরিণত হলে নাগরিকদের ওপর আইন প্রয়োগের হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়বে। জাতিসংঘ খসড়া আইন থেকে ব্যক্তিগত জবাবদিহিসহ ফৌজদারি দায়বদ্ধতা কাঠামো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে, শুধু প্রশাসনিকভাবে জরিমানার ব্যবস্থা রাখার উপাত্ত স্থানীয়করণের বাধ্যবাধকতা বাদ দিতে বলেছে। জাতিসংঘ বলেছে, এ আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য নিয়ন্ত্রণ নয়, উপাত্ত সুরক্ষাই হওয়া উচিত।
উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়ায় এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলো সুরক্ষার চেয়ে নিয়ন্ত্রণের ঝোঁক প্রকাশ করে। খসড়া আইনে বাংলাদেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের উপাত্ত সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, ব্যবহার, বিতরণ বা ধারণ করার সুযোগ রাখায় সেসব উপাত্তের স্থানীয়করণ, নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধের দায়বদ্ধতা নিরূপণের সুযোগসংবলিত বিধান নিয়েও তারা উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘ বাংলাদেশের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রেই এই আইন প্রয়োগ সীমিত রাখার সুপারিশ করেছে। জাতিসংঘ বলেছে, স্বাধীন কর্তৃপক্ষ ছাড়া কোনো উপাত্তকাঠামোই সম্পূর্ণ নয়। স্বাধীন কর্তৃপক্ষ না থাকলে বিশ্বের সেরা আইনও অর্থহীন হয়ে পড়বে। তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে উপাত্ত সুরক্ষা আইন যেন সাংঘর্ষিক না হয়, তা অবশ্যই নিশ্চিত করার কথা বলেছে সংস্থাটি।
ডেটা লোকালাইজেশনের সুবিধা-অসুবিধা কী
আজ ও আগামীর বিশ্বে তথ্য বা ডেটা হচ্ছে নতুন গোল্ড। ডেটা মাইনিং ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের দিনের বিপণন, পণ্য ও সেবা মানের ধারণা তৈরি, পণ্যের ডিজিটাল নকশা, ডিজিটাল বাণিজ্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাজাত অ্যাপ্লিকেশনের বিকাশ ও প্রসার ইত্যাদি। এই দিক থেকে উপাত্তের স্থানীয়করণ এবং ওনারশিপ দেশের স্বার্থে একটি বাণিজ্যবান্ধব মনে হতে পারে। তবে বড় বড় ডিজিটাল সার্ভিস, যেমন গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, আমাজন, মাইক্রোসফট, ওপেন-এআই এবং অন্যান্য ক্রাউড সোর্সিং তথ্য সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর জন্য তথ্যপ্রাপ্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ব্যাকআপ এবং ডেটা স্টোরেজ নেটওয়ার্কের ব্যাকআপ।
ব্যবহারকারীদের কম সময়ে সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে তারা ডেটা সেন্টারগুলোকে জিও-লোকেশনে বিভক্ত করে তারপর বিভিন্ন দেশে তাদের সার্ভার স্থাপন করে, একই ডেটার কপি বিভিন্ন জায়গায় রাখে। এটি ডেটার ব্যাকআপ এবং নেটওয়ার্কে কারিগরি সমস্যার সময়ে ডিজাস্টার রিকভারি ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করে। ফলে একটি দেশ তার রাষ্ট্রীয় সীমানায় কর্ম তৈরি এবং বিনিয়োগ প্রবাহের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ডেটা সেন্টার স্থাপনের শর্ত তৈরি করতে পারে, কিন্তু কারিগরি দিক থেকে সমুদয় তথ্য-উপাত্ত শুধু দেশের ভেতরেই স্থানীয়করণে বাধ্য একমুখী আইন করতে পারে না।
ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ডেটা সুরক্ষা আইন যদি ডেটা স্থানীয়করণের প্রয়োজনীয়তাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করার শর্ত দিয়ে অনুমোদন করা হয়, তাহলে বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছে, এমন কিছু আমেরিকান কোম্পানি বাংলাদেশের বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে। রাষ্ট্রদূত বলেছেন, স্থানীয়করণে বাধ্য করলে ২ হাজারেরও বেশি স্টার্টআপকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হতে পারে। এবং প্রতিদিন যে কোটি কোটি বাংলাদেশি ব্যবহারকারী তাঁদের সেবা নিচ্ছেন, তাঁরা আর এই সেবাগুলো পাবেন না।
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, ডেটা বা উপাত্ত সুরক্ষা খসড়া আইনের সঙ্গে অনলাইন স্বাধীনতা এবং ব্যবসায়িক বিনিয়োগের যোগসূত্র আছে।
বাংলাদেশের ডেটা সেন্টার নিয়ে আসলে কী ঘটছে
বাংলাদেশের প্রায় সব কটি ডেটা সেন্টার বিদেশি ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের নির্মিত এবং রক্ষণাবেক্ষণ কৃত। এমনকি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুইফট সফটওয়্যার, বাণিজ্যিক ব্যাংকিং সফটওয়্যার, ড্রাইভিং লাইসেন্স, আয়কর ডিজিটালাইজেশনের প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই মূলত বিদেশি সরবরাহকারী এবং বিদেশি প্রকৌশলী দ্বারা রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা নিয়ন্ত্রিত। একমাত্র জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রকল্পটি দেশীয় স্বত্বাধীনে পরিচালিত। একটি স্পর্শকাতর তথ্য-উপাত্তের ওপর কিংবা ডেটা সেন্টারের ওপর যদি বিদেশি ঠিকাদার, বিদেশি আইটি কোম্পানি, দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী কিংবা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রবেশাধিকার থাকে, তা হলে সে তথ্য-উপাত্ত দেশে ভেতরে বা বাইরে কোথায় রাখা হলো, সেই আলোচনা অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের সব ডিজিটাল আইন শুধু সরকারকে সুবিধা ও সুরক্ষা দিতে তৈরি, এখানে নাগরিকের ব্যক্তিগত আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষায় কোনো ডিজিটাল আইন হয়নি।
ডেটার যদি অপব্যবহার ও বিধিবহির্ভূত বাণিজ্য না হয়, তাহলে ডেটা দেশ-বিদেশের ক্লাউড নেটওয়ার্কে থাকলেও সমস্যা নেই। অপব্যবহার না করার শর্তে ডেটার স্থানীকরণ দেশের ব্যবসা বিকাশে সহায়ক। কিন্তু যে দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা, গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহি নেই, সেখানে অপব্যবহার এবং অপব্যবহারের দায়মুক্তিই প্রধান আশঙ্কা।
এটা ঠিক যে অ্যান্ড্রয়েড এবং অ্যাপলের অ্যাপগুলো টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনের মারপ্যাঁচে গ্রাহকের বহু তথ্য চুরি করে। তবে অফিশিয়ালি ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত তারা আড়ি পাতায় কিংবা নজরদারি করা সরকারি সংস্থাকে প্রদানে বাধ্য নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তবে কি যেকোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়, আর্থিক ও স্পর্শকাতর তথ্য-উপাত্তে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণই প্রধান উদ্দেশ্য? সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘের আপত্তি শতভাগ যৌক্তিক, যদিও ডেটা স্থানীয়করণ প্রশ্নে জাতিসংঘ ডেটা জায়ান্টদের পক্ষেই বার্তা দিয়েছে!
আমরা চাই, বাংলাদেশ ইউরোপীয় জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশনের (জিডিপিআর) আদলে ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার আইন করবে। যেখানে দেশের ও দেশের বাইরের ব্যবসায়ীরা, সরকারি সংস্থা, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কোন কোন ডেটা ফিল্ড কোন কোন শর্তে কতটুকু স্টোরেজ প্রসেসিং হস্তান্তর করতে পারবেন, বিক্রি ও বিপণনে ব্যবহার করতে পারবেন তার বিশদ সংজ্ঞা থাকবে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হরণ প্রশ্নে যেখানে সরকার এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে কোনো ধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্নে, বিচারাধীন বিষয়ে শুধু আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ গোপনীয় তথ্য পাবে এবং সেখানেও তৃতীয় পক্ষের সাক্ষী নিশ্চিত করা হবে। অন্যথায় স্পর্শকাতর ডেটায় অবাধ প্রবেশাধিকার নিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের ডিজিটাল এরিনাকে নাগরিক হয়রানি, দুর্নীতি, অর্থ আদায়, গুম ও অপহরণ, রাজনৈতিক বিরোধী দমন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, ঘুষ তদবিরকেন্দ্রিক অপরাধ বাণিজ্যের বিষাক্ত উর্বর ক্ষেত্র বানাবে। পাশাপাশি যৌক্তিক কারিগরি চাহিদা বিবেচনা না করে একমুখী ডেটা লোকালাইজেশনে ডিজিটাল ব্যবসা ও উদ্যোক্তা তৈরির পরিবেশও বিঘ্নিত হবে।
- ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য।
faiz.taiyeb@gmail.com