উন্নয়ন প্রকল্পের হালচাল (১): কাজের গতিতে লজ্জিত কচ্ছপ!

Daily Nayadiganta

দ্বিগুণ সময় বাড়িয়েও অগ্রগতি ২৬ শতাংশ : খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ

তার চলার গতির চেয়ে ধীরে চলে বাংলাদেশের বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন। – ফাইল ছবি

উন্নয়ন কার্যক্রমের গতিপ্রকৃতি দেখে ধীরগতির প্রাণী কচ্ছপও যেন লজ্জিত হবে। তার চলার গতির চেয়ে ধীরে চলে বাংলাদেশের বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন। যার কারণে সময়ের সাথে সাথে অর্থও ঢালতে হচ্ছে দ্বিগুণ পরিমাণ। চার বছরে বাস্তবায়নের কথা ছিল বৃহত্তর ঢাকা টেকসই নগর পরিবহন প্রকল্প। দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে সাড়ে ৭ বছরে সেটির কাজ হয়েছে মাত্র এক-চতুর্থাংশ বা ২৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। দুই দফায় সময় বাড়িয়েও লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৭৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ পিছিয়ে আছে প্রকল্পটি। বিলম্বের জন্য ঠিকাদারকে দায়ী করছেন প্রকল্প পরিচালক। আর পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি বলছে, ঠিকাদারের দুর্বল অর্থ ব্যবস্থাপনা, প্রকল্পের কার্যক্রম সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত না করা এবং সঠিক পরিকল্পনা না করার জন্য এই দুর্গতি।

সরকার ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর একনেক সভায় গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) অনুমোদন দেয়। ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকার এই প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার অনুমোদিত মেয়াদ। ডিপিপির প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্প মেয়াদ পরিবর্তন না করে শুধু প্রকল্প সাহায্য ও স্থানীয় মুদ্রার সমন্বয় করা হয়। তবে প্রকল্প ব্যয়ের কোনো সংশোধনী করা হয়নি। এরপর ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারিতে মেয়াদ ২ বছর বাড়ানো হয়। ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়িয়ে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়। এখানে প্রকল্প সহায়তা ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত নেয়া হয়। অর্থায়নকারী সংস্থা হলো, এডিবি, ফরাসী উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি), গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (ডিইএফ)। দুঃখজনক হলো প্রকল্প সাহায্য বৃদ্ধি পেলেও অতিরিক্ত এক হাজার ৩১৬ কোটি ১১ লাখ টাকা বৈদেশিক সাহায্যের অর্থ এখনো পর্যন্ত প্রদান করা হয়নি।

বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় সংশোধনীতে ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় ৬৬ কোটি ৪৮ লাখ থেকে ২২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও ক্ষতিপূরণ ব্যয় ১৫৬ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিমানবন্দরে ভুগর্ভস্থ পথচারী টানেল নির্মাণে ৪২০ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়। এ ছাড়া ভৌত অবকাঠামোর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি, প্রাক্কলন প্রস্তুতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) ২০১৫ সালের রেট শিডিউল ব্যবহারের কারণে ১০৯ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। এই প্রকল্পের প্রধান কাজ হচ্ছে ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পেইন করিডোর নির্মাণ। যার ১৬ কিলোমিটার এ্যাট গ্রেড, সাড়ে ৪ কিলোমিটার অ্যালিভেটেড। এ ছাড়া বিআরটি বাস ডিপোসহ বিভিন্ন স্থানে স্টপেজ নির্মাণ করা। পাশাপাশি মেইন করিডোর সংলগ্ন ১১৩টি বা ৫৬ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের উন্নয়ন। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ড্রেন নির্মাণ ও ১০টি কাঁচাবাজার নির্মাণ। রয়েছে আর্টিকুলেটেড বাস ক্রয়।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অবকাঠামো কাজের ডিজাইন, প্রাক্কলন প্রস্তুত, দরপত্রের মাধ্যমে প্রস্তুত এসব বিষয়ের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএমইসি ইন্টা. প্রাইভেট লিমিটেডকে ২০০৩ সালের মে মাসে নিয়োগ দেয়া হয়। বিস্তারিত ডিজাইন, দরপত্র আহ্বান এসব কাজ সম্পন্ন করে চারটি প্যাকেজে বিভক্ত ভৌত অবকাঠামো বাস্তবায়নের জন্য ঠিকাদারের সাথে চুক্তি করতেই ৫ বছর অতিক্রম করে। সিও-৪ চুক্তি ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, অ্যালিভেটেড সেকশনের সিও-২ চুক্তি হয় ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর। সিও-৩ এবং সিও-৪ এর অগ্রগতি শতভাগ। মূল্যও পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু সিও-১ এর অগ্রগতি ৪২.৫২ শতাংশ এবং সিও-২ এর অগ্রগতি ২৯.২০ শতাংশ। ফলে ২০২০ সালের জুনে যে প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার কথা সেটার অগ্রগতি সমাপ্তির আগের মাস অর্থাৎ মে পর্যন্ত মাত্র ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ। যেখানে অর্থ ব্যয় হয়েছে ২৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। দুদফায় সময় বাড়িয়েও লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৭৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ পিছিয়ে আছে প্রকল্পটি। এ দিকে চুক্তি সিও-১ শেষ করার জন্য ২০২১ সালের জানুয়ারি এবং চুক্তি সিও-২ এর কাজ শেষ করার জন্য ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানোর জন্য বলেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। আর প্রকল্প পরিচালক প্রকল্পটি সমাপ্তির জন্য ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সময় চেয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে। গত মে পর্যন্ত খরচ হয়েছে এক হাজার ১১৯ কোটি ৯৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।

২০২০ সালের মে পর্যন্ত কাজের সরেজমিন অগ্রগতি হলো, প্যাকেজ-১ এ ৬টি ফ্লাইওভারসহ ১৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ মাত্র ৪২ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা ২০২০ সালে ১৯ জুন সমাপ্ত করার কথা ছিল। প্যাকেজ-২ এর আওতায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার অ্যালিভেটেড বাস লাইন নির্মাণকাজ হয়েছে মাত্র ২৯.২০ শতাংশ, যা ২০২০ সালের ১৮ জুন শেষ করার কথা। প্যাকেজ-৩ এর আওতায় ১১৩টি সংযোগ সড়ক উন্নয়ন ও ১০টি কাঁচাবাজার নির্মাণ, যা ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। আর প্যাকেজ-৪ এর আওতায় গাজীপুরে একটি বিআরটি ডিপো নির্মাণ, সেটিও ২০১৯ সালে শেষ হয়েছে।

বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা ও সমস্যা তুলে ধরে সরকারি সংস্থা আইএমইডি বলছে, প্রকল্প এলাকায় রাস্তার পাশে ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টিসহ দৈনন্দিন ব্যবহারের পানি জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। ফলে নির্মাণকাজে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান স্ট্যাক ইয়ার্ডের যথেষ্ট জায়গা না পাওয়ায় পূর্ত কাজের দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণেই প্রকল্পের খরচ বাড়ছে। বিগত চার বছরে তিনবার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে। ফলে নতুন পিডিকে কাজ বুঝতে সময় লেগেছে। ২০২০ সালে প্রকল্পটি কোনোভাবেই সমাপ্ত হচ্ছে না।

প্রকল্প পরিচালক জানান, একটি প্যকেজের চুক্তি ঠিকাদার ৬.৫২ শতাংশ নিম্নদরে চুক্তিবদ্ধ হয়। যা কাজের অগ্রগতিতে প্রভাব ফেলছে। ঠিকাদার নিজ দায়িত্বে এই নিম্নদর প্রদান করে। এ ছাড়া ঠিকাদারের অপর্যাপ্ত অর্থ প্রবাহও একটি কারণ। আইএমইডি বলছে, ডিপিপি প্রণয়নে অধিক মনোনিবেশ করা, ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলে চুক্তির শর্তাবলীর আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। প্রকল্প এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে নির্মিত ড্রেন কার্যকর রাখতে চাই আউটফল খালগুলো প্রতিনিয়ত খনন ও সংস্কার অব্যাহত রাখা। তাদের অভিমত, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প দায়সারা সমীক্ষার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলে দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়ছে। তবে ভবিষ্যতে সব ধরনের প্রকল্প প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিশদ সমীক্ষার আলোকে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।