বাংলাদেশে পদ্মা সেতু নিয়ে তিন কোটি সংবাদ প্রচারের পরও হাসিনা গোষ্ঠীর আত্মপ্রশংসার খায়েশ মেটে নাই। মহা ধুমধামে উদ্বোধনের পর সেই সেতু নিয়ে গোলাম মিডিয়ার এখনকার নিউজের স্যাম্পল হলো, ‘কলকাতার প্রথম বাস সেতু পার হলো’ কিংবা ‘আজকের পদ্মা সেতুর টোলের রেকর্ড’ অথবা ‘পদ্মা সেতুর কারণে প্রায় চল্লিশটি দেশের সাথে সংযোগ সৃষ্টি হবে’, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এদিকে বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জের কৃষক যে পথে বসেছে, অসহনীয় দ্রব্যমূল্যের চাপে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যে ক্রমেই দিশেহারা হয়ে পড়ছে, পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের গালগল্প যে শূন্যে মিলিয়ে গেছে সেদিকে সরকার কিংবা গোলাম মিডিয়ার কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। অভাবের কারণে খোদ রাজধানীতে পারিবারিক কলহের জের ধরে এক মাঝবয়সী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তার স্ত্রীকে হত্যার পর নিজে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। একই দিনে বাবা-মা হারিয়ে তাদের ছেলে-মেয়েরা পথে বসেছে। এই করুণ, অসহনীয় পরিস্থিতি নিয়ে কোথাও কোন আলোচনা শুনবেন না। অর্থনীতির পরিসংখ্যানগত চিত্রের দিকে খানিকটা নজর দেয়া যাক।
সরকারের বানানো পরিসংখ্যানেই দেশের মুদ্রাস্ফিতি সাত শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বাজারে গেলে মালুম হচ্ছে, প্রকৃত মুদ্রাস্ফিতি অনেক আগেই দুই অংক পার করেছে। গত তিন মাসে শুধু ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় কুড়ি শতাংশ। খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সাধারণ জনগণকে পিষে মারছে। কিন্তু, দালালদের মুখে প্রবৃদ্ধির গল্প ছাড়া আর কিছু নাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ৩০ জুন দেশের রিজার্ভ ছিল ৪১ বিলিয়ন ডলার। এটা সম্পূর্ণ ধাপ্পাবাজির হিসাব। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলারের উর্ধ্বে নয়। উপরন্তু, আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) দেনা দুই বিলিয়ন ডলার জুলাই এর প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ হাতে রইলো ৩৩ বিলিয়ন ডলার যা দিয়ে বড় জোর মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। নানারকম প্রণোদনা দিয়েও রেমিট্যান্সের প্রায় ১৫ শতাংশ ধ্বস সামাল দেয়া যাচ্ছে না। সে কারণে গোলাম মিডিয়ায় এখন আর আর রেমিট্যান্স নিয়ে লাফালাফি দেখতে পাবেন না। গত এক বছরে রফতানি শতকরা তিরিশ ভাগ বৃদ্ধির বিপরীতে আমদানি বেড়েছে চল্লিশ শতাংশের উপরে। ফলে প্রতি মাসে এক বিলিয়ন ডলারের উপরে চলতি হিসাবের ঘাটতি রয়েছে। শুধু তাই নয়, চলতি হিসাবের ঘাটতি বিপদজনকভাবে ক্রমবর্ধমান। একদিকে শেখ হাসিনা প্রফেসর ইউনুসকে জড়িয়ে বিশ্বব্যাংককে রাতদিন গালাগালি করছেন, অপরদিকে পুরো অর্থ মন্ত্রনালয় বাজেট সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর কর্মকর্তাদের হাতেপায়ে ধরছে। বিপুল অংকের নতুন ঋণ গ্রহণ ছাড়া এই বছর বাজেট বাস্তবায়ন অসম্ভব। জনগণ শেখ হাসিনার বাটপারি ধরতে পারছেন কিনা বলতে পারব না। এই দিন দশেক আগে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু বানানোর কতই না বাহাদুরি আপনারা শুনলেন। অথচ বাস্তবতা হলো, বিদেশিদের কাছ থেকে ঋণ না পেলে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরকারের কাছে নেই। এই মুহুর্তে সঠিক পরিসংখ্যান আমার হাতের কাছে নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছেন যে, শেখ হাসিনার সরকার চীন, জাপান ও ভারতের কাছ থেকে গত চৌদ্দ বছরে উচ্চ সুদে বিপুল অংকের যে দ্বিপাক্ষিক ক্ষণ নিয়েছে তার সংগে অন্যান্য বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (বিশ্ব ব্যাংক, আই এম এফ, এডিবি, আই ডি বি, ইত্যাদি) কাছ থেকে নেওয়া ঋণ যোগ করলে মোট ঋণের পরিমাণ ২০০৮ সালে বাংলাদেশের যে ঋণ ছিল (১৯৭২-২০০৮) তার চাইতেও বেশি। অর্থাৎ চৌদ্দ বছরে নেয়া ঋণ তার আগের ৩৬ বছরের চাইতে অধিক। অনুসন্ধিৎসু পাঠক প্রকৃত তথ্য নিয়ে আমাকে জানালে উপকৃত হব।
দেশের সব টাকা সুইস ব্যাংকে পাচার করার পর শেখ হাসিনা এখন দেশের জনগণকে সঞ্চয়ী হওয়ার জন্য নির্লজ্জভাবে নসিহত করছেন। শেখ পরিবার ও তাদের লুটপাটের সহযোগী ব্যবসায়ীকুল ছাড়া দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন ধারদেনা করে ও সঞ্চয় ভেঙ্গে কোনক্রমে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন, সেই সময় ফ্যাসিস্ট, বিলাসী প্রধানমন্ত্রীর সঞ্চয়ী হওয়ার পরামর্শ এক নিষ্ঠুর তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। এদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি সঞ্চয়কারী যারা ব্যাংকে টাকা রেখেছেন প্রকৃতপক্ষে তাদের টাকার পরিমাণ প্রতিদিন কমছে। একে তো সুদের হার মূল্যস্ফিতির থেকে অনেক কম, তার উপর সরকার আমানতের উপর কর এবং লেভি প্রতি বছর বাড়িয়ে চলেছে। ব্যাংকে আমানতের উপর সুদের হার কমিয়ে আওয়ামী শিল্পপতিদের প্রায় বিনা সুদে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে লুটেরা সরকার। এই সমস্ত দুর্নীতিবাজ শিল্পপতিদের অধিকাংশই আবার বর্তমান সরকারের মন্ত্রি ও সংসদ সদস্য। স্বয়ং অর্থমন্ত্রি এবং প্রধানমন্ত্রির বেসরকারী খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সুবিধাভোগীদের মধ্যে অন্যতম। এই লোকগুলোই দুর্নীতিলব্ধ সম্পদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শেখ হাসিনার পরিবারের কাছে নিয়মিতভাবে বিদেশে পাঠাচ্ছে। আর এদিকে দেশের অসহায় জনগণ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সর্বনাশের প্রকৃত চিত্র ফ্যাসিস্ট জামানায় জানবার কোন সুযোগ নাই। বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত তথ্য সংগ্রহ এই সম্পাদকীয়তে আমার কিছু সরকারী ও বেসরকারী অভিজ্ঞতা এবং সীমিত জ্ঞানে আপনাদের জন্য সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম। আপনারা জাগ্রত হলে দেশকে এখনও বোধহয় রক্ষা করা সম্ভব।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ
০৩-০৭-২০২২
https://www.amardesh.co.uk/editorial/details/565