- মো: লিয়াকত উল্লাহ
- ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:১৩
বিএনপি নেতা জনাব মির্জা আব্বাস সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে বলেছেন, আমরা তো এই অবৈধ সরকারকেই মানি না, সেখানে নির্বাচন কমিশনকে মানার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগে যে, বিএনিপসহ অন্যান্য দলের লোকজন কেন বলেন না যে, আমরা এই সরকারকে মানি না। ড. কামাল হোসেনসহ দেশের প্রায় সবাই এ ব্যাপারে একমত যে গত নির্বাচনে মানুষ কাউকেই ভোট দেয়নি। ভোটের আগের রাতে আওয়ামী লীগের লোকজন, পুলিশ ও প্রশাসন মিলে ব্যালট বাক্স ভরে দিয়েছিল। জাতীয় পার্টিও একই বক্তব্য দিয়েছে। তাহলে কেন সবাই বলতে পারে না, আমরা এই অবৈধ সরকার, অবৈধ প্রধানমন্ত্রী ও অবৈধ সংসদ মানি না।
১৯৪৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কোনো দিন কেউ শুনেছেন, কোনো রাজনৈতিক মামলায় ১০-২০ জনের বেশি লোককে আসামি করা হয়েছে? এখন তো যেকোনো মামলায় ৫০০ থেকে ২০০০ লোককে আসামি করা হয়। বলা হয়, ৯০ শতাংশ অজ্ঞাত আসামি। এটিই হলো গ্রেফতারবাণিজ্য। এই বাণিজ্য করে পুলিশ বাহিনীর সবাই আজ কোটিপতি। এই চালাকির মাধ্যমেই অবৈধ সরকার পুরো পুলিশ বাহিনীকে কিনে ফেলেছে।
বিরোধী দলের যেকোনো মিটিং মিছিল সমাবেশে সরকারের গুণ্ডাবাহিনী গণ্ডগোল করবেই, সাথে থাকবে পুলিশ। সেখানে বিরোধীদল বিশৃঙ্খলা না করলেও দলীয় বাহিনী ও পুলিশ গণ্ডগোল করবে। তারাই যানবাহন পুড়াবে, গোলাগুলি করবে এবং দুই পক্ষ মিলে অল্প কিছু নামসহ বিরোধীদলের শত শত লোককে আসামি করে মামলা দেবে। আরম্ভ হবে গণগ্রেফতার বাণিজ্য। সুতরাং বিরোধীদল আন্দোলন করবে কোথায়? মানুষ বিএনপিকে সমর্থন করে ভোট দেবে; কিন্তু তাদের জন্য তো জীবন দেবে না, মিথ্যা আসামি হয়ে গ্রেফতার হবে না। সুতরাং অবৈধ সরকারের আমলে কার্যকর কোন আন্দোলন হওয়া সম্ভব নয়। দেশের এই রাজনৈতিক অবস্থা সারা বিশ্বের মানুষকে জানানো দরকার। আমাদের দেশে বিদেশের যত বন্ধুরাষ্ট্রের অ্যাম্বেসি আছে, তাদের এ ব্যাপারে অবহিত করা দরকার।
আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি, পাকিস্তান আমলে আমরা তৃতীয় বা চতুথ শ্রেণীতে যা জানতাম, এখনকার একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরাও তা জানে না। এরা ‘আমরা’ ইংরেজি জানে না, ‘তোমরা’ ইংরেজি জানে না, বাংলায় গরুর রচনা লিখতে পারে না, ৩ থেকে ৯ পর্যন্ত একটা নামতাও জানে না। কারো যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়, আপনারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখুন। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ে এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় চার গ্রুপে ৯২%, ৯০%, ৮৮%, ৮৭% ছাত্রছাত্রী ফেল করেছে। অথচ পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষায়, অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষায়, এসএসসি পরীক্ষায়, এইচএসসি পরীক্ষায় ৯৯% ছাত্রছাত্রী পাস করে।
এ থেকে কী প্রমাণ হয়? সরকারি নিয়ম করেছে, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেই পাস। এভাবে সরকার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলছে। সরকারের চামচারা সবসময় এবং কিছু সংবাদপত্র ও মিডিয়াও বলে যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সরকারপ্রধান। আসলেও তাই। রাতের আঁধারে ব্যালট বাক্সভর্তি করার নিয়ম চালু করা, পুলিশকে গ্রেফতার বাণিজ্য শেখানো, কিছু না জানা সত্ত্বেও ৯৯% ছাত্রছাত্রীকে যেকোনো পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেয়া এবং সর্বোপরি তার গুণ্ডাবাহিনী ও পুলিশ দিয়ে বিরোধী দলের সব ধরনের মিটিং মিছিল সমাবেশ পণ্ড করে ওই বিরোধীদলেরই লাখ লাখ নেতা ও কর্মীকে আসামি বানানোর ক্ষমতা বিশ্বের আর কারো নেই। আওয়ামী লীগের নেতাকর্র্মীরা বলেন, তারা নাকি মুজিবের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছেন। কিন্তু শেখ মুজিবের আসল স্বপ্ন কি ছিল? সবাই জানেন, তিনি সর্বশেষ বাকশাল কায়েম করেছিলেন। কিন্তু কই গত ৪৭ (সাতচল্লিশ) বছরে কেউ তো কোনো দিন এ স্বপ্নের কথা বলে না! বাস্তবায়ন তো দূরের কথা। তবে কি বাকশালের স্বপ্ন ভুল ছিল?
আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও তাদের অনুসারী বিজ্ঞজন বলেন, এ পর্যন্ত দেশে যা কিছু উন্নতি হয়েছে সবই শেখ মুজিবের স্বপ্নের ফসল। শেখ মুজিব ১৯৪৭ সালেই স্বপ্নই দেখছিলেন আমরা একদিন পাকিস্তান থেকে আলাদা হবো।
আসলে শেখ মুজিবের পতনের মূলে ছিল বাকশাল গঠন। তখন দেশে একমাত্র বিরোধী দল ছিল হাসানুল হক ইনু ও কর্নেল তাহেরের জাসদ। তখনকার রক্ষীবাহিনী কমপক্ষে এক লাখ জাসদকর্মীকে হত্যা করেছে। জাসদ সেনাবাহিনীতে স্লোগান তৈরি করেছিল- ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই- অফিসারদের রক্ত চাই’। জিয়াউর রহমান তো ৫ নভেম্বর/৭৫ সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের আবেদন করেছিলেন। তখন তিনি সৈন্যদের দ্বারা বন্দী ছিলেন। যেকোনো সময় সিপাহিরা তাকে হত্যা করতে পারত। শুধু বন্ধুত্বের খাতিরে কর্নেল তাহের তাকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার ও কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এটা না করলে তো আমাদের দেশে আজ কোনো সেনাবাহিনী থাকত না।
শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত হয়েছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তাদের লাখ লাখ নেতাকর্মী ও রক্ষীবাহিনীর ভয়ে মানুষ দিশেহারা। রক্ষীবাহিনীকে মানুষ বাঘের থেকেও বেশি ভয় করত, তার পরও তখন তো একটি লোকও তার হত্যার প্রতিবাদ করেনি।
সাধের রক্ষীবাহিনী নির্বাক হয়ে বসে রইল। সরকারের সব মন্ত্রীরা, নেতারা ও বাকশালে যোগদানকারী আমলারা সবাই চুপ। এই মন্ত্রীরাই খন্দকার মুশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল। সব এমিপই পার্লামেন্টে যোগ দিয়ে মুশতাককে সমর্থন করেছিল। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সভাপতি জনাব মালেক উকিল লন্ডন থেকে বিবৃতি দিয়েছিলেন, দেশ রক্ষা পেয়েছে।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ আমরা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের ভাষণ শুনেছিলাম। তিনি প্রথমে ইংরেজিতে ও পরে বাংলায় বলেছিলেন আমি বাংলাদেশর স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আবার ২৭ মার্চ একই সময়ে (আসর ও মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়) ঘোষণা করেছিলেন আমি শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। এ ভাষণ কমপক্ষে দেশের এক কোটি লোক শুনেছে, অথচ এখন উচ্চপর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ কোনো ভাষণ দেননি।
আমি রাষ্ট্রপতি জেনারল জিয়াউর রহমান সম্বন্ধে শুধু একটা কথা বলতে চাই, উনার মৃত্যুর পর সব ধরনের বিশ্বমিডিয়ার (বিবিসি, ভয়েস অব আমেরকিা, সিএনএন ও অন্যান্য মিডিয়া) মন্তব্য ছিল তৃতীয় বিশ্বে তার মতো রাষ্ট্রনায়ক কোথাও নেই। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তাঁর পরম শত্রুও দিতে পারবে না। অবৈধ সরকারের সেতু মন্ত্রী ও তথ্য মন্ত্রী প্রায়ই বলে থাকেন বিএনপি যদি কোনো মিছিল বা সমাবেশে গণ্ডগোল করে তাহলে তাদের যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা তার সমুচিত জবাব দেবে। আমাদের প্রশ্ন, বিএনপি যদি সত্যিই কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কার- পুলিশের না যুবলীগ ও ছাত্রলীগের?
আজ দেশের হাজার হাজার ছেলে কিশোর অপরাধী। কিন্তু কেন? স্কুল-কলেজে কোনো পড়াশোনা নেই। তারা জানে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেই পাস- ৯৯% পাসের ভেতরে তারা আছে। তাই লেখাপড়া নেই বিধায় তারা আজ কিশোর অপরাধী। বর্তমান অবৈধ সরকার শিক্ষাব্যবস্থাকে যেভাবে ধ্বংস করে চলেছে, আগামী ৫০ বছরেও এটা ঠিক করা যাবে না। একটা কেন ১০০টা পদ্মা সেতু হলেও দেশ উন্নত হবে না। দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা হয়েছে।
লেখক : সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড