সম্প্রতি এক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দেশের একটি পোশাক কারখানাকে শর্ত দিয়েছে। বুধবার তার স্পষ্টিকরণ করেছে বিজিএমইএ সভাপতি। তাতে বলা হয়েছে, বিশ্ব বাণিজ্যের দৃশ্যপট দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে; মানবাধিকার এবং পরিবেশগত কারণে ক্রমবর্ধমান অগ্রাধিকার পাচ্ছে, অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলোও বাণিজ্যকে প্রভাবিত করছে।
তাই বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করার জন্য এই বিবৃতি দেয়ার তাগিদ অনুভব করছি। তিনি বলেন, বিজিএমইএ’র একজন সদস্যকে বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে এলসি’র একটি অনুলিপি আমাদের নজরে এসেছে। অনুলিপিতে রয়েছে- “জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য যদি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাহলে ওই সব দেশ বা অঞ্চলের সঙ্গে কোনো ধরনের লেনদেন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবো না। এ অবস্থায় নিষেজ্ঞার কারণে হওয়া যেকোনো ধরনের বিলম্ব বা লেনদেন বাতিলের তথ্য প্রকাশের দায় নেবো না।
ফারুক হাসান বলেন, এই বক্তব্যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে বলে উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, যা সঠিক নয়। উল্লেখ্য যে, এলসি একটি নির্দিষ্ট ক্রেতার কাছ থেকে এসেছে এবং এটি কোনো দেশের দ্বারা সংবিধিবদ্ধ আদেশ বা বিজ্ঞপ্তি নয়। সুতরাং এটিকে বাংলাদেশের উপর বাণিজ্য প্রয়োগ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পরিমাপ হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করা উচিত নয় বলে বিজিএমইএ তাদের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন। তবে কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এমন শর্ত দিয়েছে কিংবা কোন পোশাক কারখানাকে এমন শর্ত দেয়া হয়েছে, তা জানাননি বিজিএমইএ সভাপতি।
স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে পোশাক উদ্যোক্তারা ইতিমধ্যেই কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন এবং ক্রেতাদের থেকে উদ্ভূত সর্বশেষ এই শর্ত তাদেরকে আরও শঙ্কিত করে তুলেছে।
বিশ্বব্যাপী পোশাক ব্যবসা যখন ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় রয়েছে ঠিক তখনই এই সমস্যা হাজির হয়েছে উল্লেখ করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, এটি পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়। এখন ব্যাংকগুলো এ ধরনের মাস্টার এলসি বা রপ্তানি আদেশের বিরুদ্ধে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলতে ইচ্ছুক নাও হতে পারে।
ফারুক হাসান বলেন, গত ব্ল্যাক ফ্রাইডে, থ্যাঙ্কসগিভিং এবং সাইবার মানডেতে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক পণ্যের বিক্রিতে একটি বড় উল্লম্ফন দেখা গিয়েছিল। পোশাক রপ্তানিকারকরা যদি আগামী ছয় মাস টিকে থাকতে পারেন, তাহলে সামনের দিনে তারা আরও শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।
বাংলাদেশ সিঅ্যান্ডএফ এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটর এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং এসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো এসোসিয়েশনের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিজিএমইএ। বন্দর পরিষেবার গুণমান উন্নয়ন নিয়ে ডাকা বৈঠকটিতে সম্ভাব্য পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বেশি। বাজার পুনরুদ্ধারের এই সময়ে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সব স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতা চেয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি। সভায় আরও বক্তব্য রাখেন- বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি এসএ মান্নান কচি ও প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
সমপ্রতি এক অনুষ্ঠানে ইউরোপ ও সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ ব্যবসার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে; এর ফলে দোকানে মালামাল কমে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলে চীন ও রাশিয়া বাদে ইউরোপের দেশগুলোসহ বেশির ভাগ দেশই তা অনুসরণ করতে পারে। সাশ্রয়ী মূল্যে বাংলাদেশের পোশাকের ক্রেতা থাকতে পারে; তবে যাদের ক্রয়ক্ষমতা ভালো তারা অন্য দেশে বিকল্প খুঁজবে। যদি কোনো ক্রেতা অন্য কোথাও বিকল্প খুঁজে পান, তাহলে আগের দেশে ফিরতে তার কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।
বিশ্বব্যাপী অধিকার গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান ও সরকার থেকে বাংলাদেশের ওপর চাপ বেড়েছে। ‘দেশে যারা হুমকি দেয়, ভয় দেখায়; যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক অধিকার রক্ষাকারী এবং শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে’ তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের এই সতর্কবার্তা উদ্বেগজনক।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশি পোশাক কর্মী কল্পনা আকতারের নাম উল্লেখ করে বাংলাদেশে শ্রম অধিকার রক্ষাকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। শ্রম অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে এমন সব দেশ ও ব্যবসায়ের ওপর গত ১৬ই নভেম্বর নতুন সতর্কতা জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের এক-পঞ্চমাংশ রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, যার আর্থিক মূল্য ৪৭ বিলিয়ন ডলার। ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রভাব রয়েছে। সমপ্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে শ্রম ও মানবাধিকার নিয়ে একই ধরনের উদ্বেগ দেখানো হয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি কমেছে। ইপিবি’র তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, জানুয়ারি-অক্টোবর ২০২৩ সময়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৮.৩৯ শতাংশ কমেছে।
এদিকে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৫০ ভাগই হয়েছে ইইউ এবং যুক্তরাজ্যে। এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের জুলাই-নভেম্বরে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ১.৩০ শতাংশ। এ বছরের নভেম্বরে মোট রপ্তানি হয়েছে ৪.৭৮ বিলিয়ন ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের ৫.০৯ বিলিয়নের চেয়ে ৬.০৫ শতাংশ কম।