ঢাকা
অনেক আলোচনা, এরপর আইন প্রণয়ন করে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে কমিশন দায়িত্বও নিয়েছে। তাঁদের অভিনন্দন। তাঁদের সামনে গুরুদায়িত্ব। সেই দায়িত্ব কতটা নিরপেক্ষ ও সঠিকভাবে পালন করতে পারলেন, এর মূল্যায়ন ভবিষ্যতের ওপর ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয়।
অবশ্য যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ইসি গঠিত হলো এবং সেখানে যাঁরা নিয়োগ পেলেন—এর ভেতর-বাহির নিয়ে একটা আলোচনা হতেই পারে। আওয়ামী লীগ বলেছে, অনুসন্ধান কমিটিতে দেওয়া তাদের নামের তালিকা থেকে কেউ নবগঠিত ইসিতে স্থান পাননি। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) তালিকারও কেউ নেই। বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ ১৩টি বিরোধী দল অনুসন্ধান কমিটিতে নামই দেয়নি। জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে—এমন দলের মধ্যে বাদ থাকল ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও বিকল্পধারা বাংলাদেশ। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, তাদের দেওয়া নামের তালিকা থেকে কেউ ইসিতে নিয়োগ পাননি। আর বিকল্পধারা নাম জমা দিয়ে তা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছিল। এতে দেখা যাচ্ছে, তাদের তালিকা থেকেও কেউ ইসিতে নেই।
বর্তমান জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে নয়টি রাজনৈতিক দলের। প্রথম আলোর অনুসন্ধান অনুসারে, সদ্য নিয়োগ পাওয়া সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল এবং চার কমিশনারের নাম সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে—এমন মাত্র দুটি দলের তালিকায় ছিল। এ দুটি দল হচ্ছে তরিকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টি (জেপি)। এ দুটি দলের একজন করে সাংসদ আছেন। অর্থাৎ, স্বাধীনতার পর ঘুরেফিরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাপা ইসি গঠনের ক্ষেত্রে ‘নবিশ’। বিষয়টি অনেকটা সেই প্রবাদের মতো দাঁড়িয়েছে যে ‘হাতি-ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল!’ এমন নজির আগেও দেখা গেছে। ২০১৭ সালে সর্বশেষ যে ইসিতে সিইসিসহ সব কমিশনারের নাম ছিল ছোট দলের তালিকায়, এর মধ্যে তরীকত ফেডারেশন ও গণতন্ত্রী পার্টির নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল।
এবার দেখা যাক সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের বাইরে কোন কোন দলের তালিকায় নতুন সিইসি ও অন্য চার কমিশনারের নাম ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে না প্রকাশ করলেও অনুসন্ধানে পাওয়া দলগুলোর নাম হচ্ছে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, বাসদ-বিএসডি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), গ্রেপ্তার হেফাজত নেতা মামুনুল ইসলামের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ। এই দলগুলো যে নামের তালিকা দিয়েছিল, তাতে ইসিতে নিয়োগ পাওয়া এক বা একাধিক জনের নাম ছিল। এর মধ্যে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম প্রায় সব দলের তালিকায় ছিল। অন্য কমিশনারদের অনেকের নাম একাধিক দলের তালিকায় থাকার তথ্যও জানা যায়।
ছোট দল যেভাবে কিংমেকার
প্রশ্ন হচ্ছে, ঘুরেফিরে ছোট কিছু দলই প্রতিবার ইসি গঠনে কীভাবে ‘কিংমেকার’ হয়ে ওঠে? এটা কি তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, চিন্তার ব্যাপকতা এবং নিরপেক্ষ মনোভাবের কারণে সম্ভব হয়েছে? নাকি এর পেছনে কারও কৌশল কাজ করেছে?
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবার ইসি গঠনে ১০ জনের নামের তালিকা দিয়েছিল। তবে এই তালিকা প্রকাশ করেনি। কিন্তু গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একটি বিবৃতি দিয়ে নতুন ইসিকে স্বাগত জানান। বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, তাঁর দলের তালিকা থেকে কেউ ইসিতে স্থান পাননি। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য থেকে দুটি প্রশ্ন সামনে আসে। দলটি কি ইসিতে নিয়োগ দেওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে সক্ষম নয়? তাহলে তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এতটা কম কীভাবে সম্ভব?
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নাম চাওয়ার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলীর সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দলের প্রধান শেখ হাসিনা উপস্থিত প্রত্যেক নেতার কাছে কারা সিইসি ও কমিশনার হতে পারেন—এমন যোগ্য ব্যক্তিদের নাম দেওয়ার অনুরোধ জানান। নেতারা প্রায় সবাই নিজেদের মতো করে নাম লিখে দেন। সেই নামগুলো একসঙ্গে খামে রেখে তা পর্যালোচনা করে অনুসন্ধান কমিটিতে তালিকা পাঠানো হয়।
২০১৭ সালে গঠিত ইসিতে সিইসি কে এম নূরুল হুদার নাম জাপার তালিকায় ছিল। এবার তাঁদের তালিকা থেকে কেউ হয়নি বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের অনেকেই মন্ত্রী-সাংসদ। তাঁরা রাজনীতিতে আছেন দীর্ঘদিন। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে দেশের ক্ষমতায়। সব মিলিয়ে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি শাসনভার পাওয়া দল। এত ঐতিহ্যবাহী একটি দলের নেতারা ইসিতে নিয়োগ পেতে পারেন—এমন যোগ্য ব্যক্তিদের একটি তালিকা করতে পারলেন না? এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? নাকি আওয়ামী লীগের তালিকা থেকে কেউ স্থান পাক, সেটা চায়নি দলটি? এমনটা চাওয়ার কোনো কারণ আছে কি? নাকি সরকারঘেঁষা অন্য ছোট দল দিয়ে ইসি গঠনের মাধ্যমে নিজেদের সুবিধা নিতে চেয়েছে দলটি?
সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি কি করল? তারা কেন যোগ্য কাউকে বাছাই করতে পারল না? দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ দীর্ঘ ৯ বছর দেশ শাসন করেছেন। এরশাদ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করতেন। এ জন্য ১৯৯৬ সালের পর আওয়ামী লীগের চার দফায় দেশ শাসনের তিনবারই সরকারের অংশীদার হয়েছে এরশাদের দল। প্রধান বিরোধী দলের চেয়ারেও বসেছে জাপা। যদিও সবাই তাদের ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল বলেই মনে করে। ২০১৭ সালে গঠিত ইসিতে সিইসি কে এম নূরুল হুদার নাম জাপার তালিকায় ছিল। এবার তাঁদের তালিকা থেকে কেউ হয়নি বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন।
এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় সামনে এসেছে। ১. জাপার কেউ কেউ বলছেন, এখন সরকারের সঙ্গে দলটির সখ্য আগের মতো নেই। এ কারণে ইসি গঠনে অন্য দলগুলোকে দিয়ে কৌশলে পছন্দের নাম জমা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় জাপাকে রাখেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সরকারের আশীর্বাদ ছাড়া যে দলটির চলে না—এটাও অনেকটা প্রকাশ পেল। দলটি অনুসন্ধান কমিটিতে যে নামের তালিকা জমা দিয়েছে, এতে দলের মহাসচিবের স্ত্রীর নাম রয়েছে। প্রধান বিরোধী দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তির স্ত্রীর নাম দেওয়া উদ্দেশ্যহীন চেষ্টা ছাড়া আর কি হতে পারে?
এবার ইসি গঠন প্রক্রিয়া থেকে আগেই নিজেদের সরিয়ে রেখেছিল বিএনপি। এ কারণে তাদের বিষয়ে এখানে আলোচনার আসলে কিছু নেই।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাপার বাইরে সংসদে সর্বাধিক চারজন সাংসদ আছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির। জাসদের সাংসদ দুজন। এই দুটি দলই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের পর এই দুটি দল থেকেই সরকারের একজন করে মন্ত্রী ছিলেন। বর্তমান মন্ত্রিসভায় তাঁদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। এ দুটি দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে আলোচনা আছে। এবার অনুসন্ধান কমিটিতে নাম দেওয়ার আগে দল দুটির সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ করা হয়েছিল। তবে তারা খুব একটা সাড়া দেয়নি। যে কারণে এই দুই দলের তালিকা থেকেও কেউ ইসিতে স্থান পাননি। এবার তাঁদের তালিকা থেকে নাম থাকার সম্ভাবনা কম—এমনটা শুরু থেকেই দলের নেতারা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন। তাহলে কি বিষয়টি এমন দাঁড়ালো যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্যই তাঁরা অনুসন্ধান কমিটিতে নাম জমা দিয়েছেন। বিকল্পধারা বাংলাদেশের দুজন সাংসদ আছেন। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দলটির সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যে যোগাযোগ ছিল, তা এখন অনেকটাই কমে গেছে। তাই তাদের তালিকা নিয়েও রাজনৈতিক মহলে খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তারা নিজেদের তালিকা আগাম প্রকাশই করে দেয়।
সামনে নির্বাচনী পরীক্ষা
এবার যেভাবে এবং যেসব দলের তালিকা থেকে নতুন ইসি গঠিত হলো, তা নিয়ে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা-বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। বর্তমান ইসির অধীনে ২০২৩ সালের শেষ বা ২০২৪ সালের শুরুতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৮ ও ২০১৪ সালের সর্বশেষ দুটি নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক-সমালোচনা আছে। তাই আগামী নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে করার বিষয়ে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও উন্নয়ন সহযোগীরাও নানাভাবে নিজেদের মত তুলে ধরছে। এই পরিস্থিতিতে এবার সরকার প্রথমে তড়িঘড়ি আইন প্রণয়ন করে। প্রথমবারের মতো আইন অনুযায়ী ইসি গঠন করা হয়েছে। এর আগে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নিবন্ধিত ২৫টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেন। বর্জন করে বিএনপিসহ সাতটি দল।
আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতে হবে বর্তমান ইসিকে। এরপর রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটসহ বেশ কিছু সিটি করপোরেশনের ভোট আসবে।
সদ্য নিয়োগ পাওয়া সিইসি ও অন্য চার কমিশনার—সবাই সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। এর মধ্যে সিইসি ও দুজন কমিশনার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনপ্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর—সচিব পদে ছিলেন। একজন জেলা ও দায়রা জজ এবং অন্যজন সামরিক বাহিনীর উচ্চ পদে ছিলেন। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকে বিশেষ রাজনৈতিক সুবিধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সিইসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে সেই সুবিধা দুবার পেয়েছেন। বিচার বিভাগের এই কর্মকর্তাকে মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগের সময় নীতিমালা না মানার বিষয়ে আদালতের রায় ছিল। এমনকি আইনসচিব থাকা অবস্থায় বিধিবহির্ভূতভাবে দুই বিচারককে অবসরে পাঠানো নিয়েও জটিলতায় জড়িয়েছিলেন তিনি। এ জন্য তিনি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে ক্ষমাও চান। কমিশনারদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি।
সামনে কী
২০১৭ সালের মতো এবারও ছোট দলের তালিকা থেকেই সিইসিসহ চার কমিশনার নিয়োগ পেলেন। রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কৌশলই ছিল ছোট দলগুলোকে দিয়ে পছন্দের নামগুলো বেশি বেশি আসুক। ইসি গঠনে অনুসন্ধান কমিটির দেওয়া তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি সিইসি ও চারজন কমিশনারকে নিয়োগ দিলেন। সংবিধান অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া সব বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেবেন। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগেরও সভাপতি।
আইন অনুযায়ী ক্ষমতা পুরোপুরি প্রয়োগ না করার নানা অভিযোগ ছিল বিদায়ী কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসির বিরুদ্ধে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন ইসি কি আইন অনুযায়ী তাদের ক্ষমতা পুরোপুরি প্রয়োগ করতে পারবে? যে কৌশলের মধ্য দিয়ে তাঁরা নিয়োগ পেলেন, সেখানে বিশেষ কোনো দলেরই স্বার্থ রক্ষা হবে কি না, সেই প্রশ্নও এসেছে। এ অবস্থায় সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সবার আস্থা অর্জনই হবে নতুন ইসির বড় চ্যালেঞ্জ।