সৌম্য ভৌমিক
সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ২০১৯ সালে পাকিস্তান সফরের সময় দেশটিতে একটি গভীর রূপান্তর শোধনাগার ও পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স নির্মাণ বাবদ ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারসহ মোট ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের সমঝোতা স্মারকে সই করেছিলেন।
এই বিনিয়োগ সম্ভাবনা কোটি কোটি পাকিস্তানির মনে আশা জাগিয়েছিল। তাঁরা আশা করেছিলেন, এই বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ তাঁদের দেশে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা আনতে পারে। তবে তাঁদের জন্য হতাশ করা বিষয় হলো, বহুপ্রত্যাশিত এই উদ্যোগ আজও আলোর মুখ তো দেখেইনি, উল্টো দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক ব্যর্থতা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও ফিকে করে দিয়েছে।
২০২০ সালের শেষ ভাগটিকে সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের এটি বাঁকবদলের সময় বলা যেতে পারে। ওই সময় ভারতের কাশ্মীরে মোদি সরকারের আচরণ নিয়ে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন ৫৭টি মুসলিম দেশের সংগঠন ওআইসি কোনো কথা বলেনি বলে ইসলামাবাদ অভিযোগ করেছিল। এই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইমরান খান।
ইসলামাবাদের এই অভিযোগ ও তৎপরবর্তী পরিস্থিতি মুসলিম বিশ্বের ওপর সৌদি আরবের আধিপত্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। এর ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে ছেদ ঘটে। এই কথিত হুমকির প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরব এমন কিছু ব্যবস্থা নেয়, যা দুই দেশের সম্পর্ককে অধিকতর উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়।
শুধু আর্থিকভাবেই নয়, রাজনৈতিকসহ নানাভাবে সৌদি আরব পাকিস্তানকে দীর্ঘদিন ধরে সহায়তা দিয়ে আসছে। তবে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তান সৌদি আরবের সঙ্গে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছে, তা গত ৭৫ বছরে গড়ে ওঠা দুই দেশের সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলেছে। দুই দেশের সম্পর্ক এখন সংকটের মধ্যে পড়েছে।
পাকিস্তানের ওপর প্রথম ধাক্কাটি আসে ১০০ কোটি ডলারের সুদমুক্ত ঋণ প্রত্যাহারের মাধ্যমে। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এমনিতেই নাজুক অবস্থায় ছিল। এ অবস্থায় এই সুদমুক্ত ঋণসুবিধা প্রত্যাহার পাকিস্তানকে খেলাপির দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
এ ছাড়া পাকিস্তানকে আমদানি ব্যয় পরিচালনা করতে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরব তেলের দাম পরিশোধে অধিকতর সময় দেওয়ার যে স্কিম হাতে নিয়েছিল, সেটিও সৌদি আরব প্রত্যাহার করেছে। সৌদির এই প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর ভয়ানক প্রভাব ফেলেছে এবং দেশটিকে একটি দুর্বিষহ অবস্থায় ফেলেছে।
যা হোক, দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে সম্প্রতি এই চ্যালেঞ্জগুলো দেখা দেওয়ার পরও যে বিষয়টি মনে রাখা দরকার, তা হলো পাকিস্তান-সৌদি সম্পর্কের অটল স্থিতিস্থাপকতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই দুই দেশের মধ্যে যে দীর্ঘস্থায়ী মৈত্রী গড়ে উঠেছে ও ব্যতিক্রমী ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক জারি আছে, তার পেছনে অভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক সখ্য ভূমিকা রেখেছে।
পাকিস্তান বরাবরই অর্থনৈতিক কঠিন সময়ে, বিশেষ করে তেলসংকট ও অর্থনৈতিক ঘাটতি পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের ওপর নির্ভর করে এসেছে। এই দুই দেশের বন্ধুত্ব ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে টিকে আছে। এ বিষয়টি তাদের সম্পর্কের স্থায়ী ধরনের বিষয়টিকেই প্রমাণ করে।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, পাকিস্তানে সৌদি আরবের ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার কথা। একই সঙ্গে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া ৩০০ কোটি ডলারের ঋণকে বাড়িয়ে ৫০০ কোটিতে উন্নীত করার কথা। সৌদির তরফে এসব সহায়তা মিললে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, ডলারের বিনিময় হারের অস্থিরতা ও ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কবলে পড়া পাকিস্তানের নাজুক অর্থনীতি ফের চাঙা হয়ে উঠতে পারে।
এই সহায়তা পেলে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় পড়া থেকে রেহাই পেতে পারে। না হলে আইএমএফের কথামতো পাকিস্তানকে বিদ্যুৎ ও পেট্রলের দাম বাড়াতে হবে এবং জনগণের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা আরও ভারী করতে হতে পারে।
শুধু আর্থিকভাবেই নয়, রাজনৈতিকসহ নানাভাবে সৌদি আরব পাকিস্তানকে দীর্ঘদিন ধরে সহায়তা দিয়ে আসছে। তবে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তান সৌদি আরবের সঙ্গে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছে, তা গত ৭৫ বছরে গড়ে ওঠা দুই দেশের সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলেছে। দুই দেশের সম্পর্ক এখন সংকটের মধ্যে পড়েছে।
এখন পাকিস্তান কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে এবং সৌদির সঙ্গে থাকা তার সম্পর্কের প্রতি কতটুকু প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করবে, তার ওপর এই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারির ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ভর করছে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
- সৌম্য ভৌমিক ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সেন্টার ফর নিউ ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির একজন সহযোগী ফেলো