- রিন্টু আনোয়ার
- ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১৯:৪১
ইভিএমে ভোট হচ্ছে না, এটি মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। অপেক্ষা ছিল আনুষ্ঠানিক ঘোষণার। নির্বাচন কমিশন ঘোষকের সেই কাজটি শেষ করেছে। কিন্তু, আগাম নির্বাচনের কোনো কানাঘুষা-গুঞ্জন ছিল না। রাজনীতির চলমান গতি-প্রকৃতি ও নির্বাচনী ঢামাঢোলের মাঝে এটি প্রাসঙ্গিকও ছিল না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়াল ছোট্ট করে এক টোকায় আগাম নির্বাচনকে প্রাসঙ্গিক করে দেন। ইসির মাসিক সমন্বয় সভায় কর্মকর্তাদের যেকোনো সময় জাতীয় নির্বাচন করার প্রস্তুতি রাখতে বলেছেন। সংবিধান অনুযায়ী ডিসেম্বরের শেষ দিকে বা জানুয়ারির শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে উল্লেখ করে, সংবিধানে ওই সময়ের আগেও ভোট হতে পারে এমন প্রভিশনের কথা মনে করিয়ে দেন তিনি।
আগাম নির্বাচনের ইস্যুটি বাজারে আসে তার ওই বক্তব্যের সূত্র ধরে। যদিও এখন পর্যন্ত এর তৎপরতা নেই। নির্বাচন কমিশন সচিব মো: জাহাঙ্গীর আলম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাদের আলোচনা হয়নি। ইসি কর্মকর্তাদের দায়িত্বের তাগিদ বোঝাতে গিয়ে সভায় সিইসি বলেছেন, যেকোনো সময় নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকতে হবে। প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি রাখা যাবে না।
শুধু বক্তৃতার জন্য বক্তব্য বা কাজের তাগিদ বোঝাতে এটি হয়ে থাকলে আগাম নির্বাচন হবে মনে করা যায় না। এ ছাড়া, প্রস্তুতিগত সমস্যাও আছে। এখনো নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, সংসদীয় আসনের সীমানা চূড়ান্তকরণ এবং ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কাজ বাকি। আবার সরকার চাইলে এগুলো ছাড়াও নির্বাচন করিয়ে নিতে পারে। সংবিধানে এ সংক্রান্ত ক্ষমতার কোনো শেষ নেই। যথাসময়ে নির্বাচনের কথা আছে সংবিধানে। আগাম নির্বাচনেরও বিধান আছে। আবার পরিস্থিতির অনিবার্যতায় পেছানোর রাস্তা তৈরির ব্যবস্থাও করা যাবে। সরকারপ্রধান চাইলে সংসদ ভেঙে দিয়ে মন্ত্রিসভা বহাল রাখতে পারবেন। এগুলো নতুন কথা নয়। এসব ব্যবস্থা করা আছে। তাই বরাবর সব ক্ষমতাসীনদের কাছে সংবিধান খুব পবিত্র এবং দামি। তারা বিরোধী দলে গেলে তাদের কাছে সংবিধান আর তখন এমন পবিত্র থাকে না।
সংবিধানের কথা বলে আগাম নির্বাচনের ঢেঁকুরটি শুরুতে তেমন নিউজ ভ্যালু পায়নি। কিন্তু, একই সময়ে ইভিএম বাতিল ঘোষণা আগাম নির্বাচনের গুঞ্জনের সাথে একটি বাতাবরণ তৈরি করে দেয়। তার ওপর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিতীয় ব্যক্তিদের বাহাস এর গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। সরকার আগাম নির্বাচন দিয়ে আরেকটি চাতুরী করতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিএনপি। সরকার আগাম নির্বাচন দিলে বিএনপির রাজনীতি ও ভোটের মাঠে কোণঠাসা অবস্থা হবে- দলটির নেতাদের এমন উপলব্ধি। এর প্রকাশ ঘটেছে বিএনপি মহাসচিবের কণ্ঠে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কথা আরো কড়া। তার অভিযোগ, বিএনপি সামনের নির্বাচন বানচাল করে দিতে চায়। দলটি নিজে নির্বাচন করবে না, আবার হতেও দেবে না সরকার তা সহ্য করবে না। নির্বাচন আগাম হোক আর পরে হোক বিএনপির ভরাডুবি হবে- এমন কথাও বলেছেন তিনি।
তাদের এ ধরনের বাদানুবাদ সময় এবং ঘটনার পরম্পরায় চলে আসছে। এর কারণ আছে। সরকার জানে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লে তাদের করুণ অবস্থা করে ছাড়বে ক্ষুব্ধ নানা মহল। আবার বিএনপি নিশ্চিত সরকার বিগত ২০১৪ বা ১৮ সালের মতো নির্বাচন করতে চায়। বড় জোর ধরন বদলাবে। ফল একই হবে। যেমনটি হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ও সুপ্রিম কোর্টে। সেই ভাবনায় বিএনপি এখন ইভিএম, আগাম নির্বাচন, সংলাপ এসব ইস্যুতে ঢুকতে চায় না। বিএনপি যে পর্যায়ে এসেছে আন্দোলন ছাড়া গতি নেই। পেছনে ফেরা মানে আত্মহনন। আবার তেজোদীপ্ত আন্দোলন গড়ার শক্তি-কৌশল বড় দুর্বল। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে পারঙ্গম। কিন্তু, আগামীতে ২০১৪ বা ২০১৮ স্টাইলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার সুযোগ ক্রমে সংকোচিত হচ্ছে। সামনের দিনগুলো আরো কঠিন হয়ে উঠতে পারে। দলীয় নেতাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক একটি মন্তব্যেও এ কঠিনের ছাপ রয়েছে। এমপি প্রার্থীদের সতর্ক করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনে আমার দিকে চেয়ে থেকে লাভ নেই’।
বড় কঠিন বার্তা লুকানো রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বাক্যটিতে। রাজনীতি সম্পর্কে কম বোঝা মানুষও উপলব্ধি করছেন বাংলাদেশে নির্বাচনের ঢোলে বাড়ির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। সুষ্ঠু ভোটের দাবির সাথে ওয়াদাও তুঙ্গে। লক্ষণীয় বিষয়, এ দাবি ও ওয়াদার বেশির ভাগ বিদেশীদের কাছে। বিএনপির বিদেশীদের কাছে নালিশ রাজনীতিতে তুমুল আলোচিত। সেই সাথে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিটি স্থানিকের আওতা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক করে দেয়ার চেষ্টাও তীব্র। যার অর্থ, সুষ্ঠু-অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়, এটি গোটা দুনিয়ার বিষয়। বিপরীতে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে নির্বাচন প্রশ্নে বিদেশীদের কথা শোনা হবে না মর্মে জানানো হলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওয়াদা শোনানো হচ্ছে তাদের। কিছু দিন ধরে যেসব বিদেশী হাই-প্রোফাইল এসেছেন তাদের সবাইকে আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস শোনানো হচ্ছে। এমন কি তিক্ততার মধ্যেও অনেকটা বিস্ময়করভাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে চলে যান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কথা দিয়েছেন আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে।
আরো কিছু আলামতের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের বিচারের তালগাছটা প্রকারান্তরে বিদেশীদের হাতে চলে যাচ্ছে কি না প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে- কথাটি কেন সরকারি মহলকে বিদেশী অতিথিদের কাছে অবিরাম বলতে হচ্ছে? নির্বাচন প্রশ্নে বিদেশীদের কোনো কথা শোনা হবে না বলে আওয়ামী লীগের সাহসী ও স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। না শুনলে সেই বিদেশীদের কেন সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিতে হচ্ছে? ক্ষমতাসীনদের ঘোষণায় বিদেশীরা দমেনি। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নির্বাচনের কথা আনছেন। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন করে বলা শুরু করেছে। যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপানও সুষ্ঠু নির্বাচনের নসিয়ত করছে। সরকার বা সরকারি দল তা অগ্রাহ্য করছে না। বলছে না, এসব সবক তারা শুনবে না। কথা দিচ্ছে; সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওয়াদা দিচ্ছে।
এমন একটা সন্ধিক্ষণে অনেকটা বিনোদিত কাণ্ড ঘটালো নির্বাচন কমিশন। মুখস্থ নোট বা স্লিপ পড়ার মতো জানিয়ে দিলো, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে ইসি। ৩০০ আসনে ভোট হবে আগের মতো কাগুজে ব্যালটে। অথচ, ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক সত্ত্বে ও আগামী নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট নেয়ার সিদ্ধান্ত বিরতিহীনভাবে জোর গলায় জানিয়ে আসছিল ইসি। এ জন্য নতুন ২ লাখ ইভিএম কিনতে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছিল। এখন শোনানো হলো অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা। গণমাধ্যমকে ইসি সচিব জানিয়েছেন, ইসির কর্মপরিকল্পনায় সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের কথা বলা হলেও মেশিনগুলো মেরামতে প্রায় ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা দরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সেই টাকা চাওয়াও হয়েছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক মতানৈক্য সিটি করপোরেশনেও আছে। রয়েছে প্রশ্নও। সেখানে কেন ইভিএমে ভোট হবে? ওখানে যে পরিমাণ মেশিন লাগবে, সেগুলো ঠিক করতে কি টাকা লাগবে না? যৌক্তিক এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারছে না ইসি।
সরকার বা ইসি চাইলেও আগামী সংসদ নির্বাচন মেশিনে করতে পারবে না- এমন একটি সংবাদ ঘুরছিল কিছু দিন ধরে। কিন্তু, ইসি লুকোচুরি করছিল। ভেতরের খবর ছিল টাকা সমস্যা নয়, বিরোধী দলের আপত্তিও সমস্যা নয়; নিজস্ব সমস্যাতে বরবাদ হতে বসেছে নির্বাচন কমিশনের ইলেক্ট্রনিক ভোট মেশিন-ইভিএম প্রজেক্ট। আর সেই সমস্যাটি হচ্ছে, ইসির নিজস্ব সক্ষমতার ঘাটতি। নিজেদের অক্ষমতা জানার পরও বিশাল এ কেনাকাটা যজ্ঞে হাল ছাড়েনি কমিশন। এগিয়েছে দ্রুত গতিতে। ৩০০ আসনে না পারলেও অন্তত দেড়শ’ আসনে এ মেশিনে আগামীতে ভোট নেয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি চলেছে। প্রকল্প ভণ্ডুলের কথা স্বীকার করলো এতদিন পর এসে। সেই সাথে দিলো আগাম নির্বাচনের টোকা। এখন অপেক্ষায় থাকতে হবে, তার পরে কী রয়েছে..?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com