Site icon The Bangladesh Chronicle

ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ – সাংবাদিক প্রহার, নেতার গলায় ফুলের মালা

সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে থানার সামনে উপস্থিত শিক্ষার্থী
বখাটেদের পক্ষে এগিয়ে আসেন এক কলেজ শিক্ষক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। ওই শিক্ষকসহ বখাটেদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের ছাড়িয়ে নিতে কলেজ শিক্ষার্থীদের এনে দাঁড় করানো হয় থানার সামনে

বখাটেদের পক্ষে এগিয়ে আসেন এক কলেজ শিক্ষক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। ওই শিক্ষকসহ বখাটেদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের ছাড়িয়ে নিতে কলেজ শিক্ষার্থীদের এনে দাঁড় করানো হয় থানার সামনে। তা সত্ত্বেও পুলিশ আসামিদের আদালতে পাঠায়। ওইদিনই জামিনে মুক্তি পান কলেজ শিক্ষক। এরপর থানা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এনে তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার এনায়েরতপুরে একটি স্কুলের ইভ টিজিংয়ের শিকার ছাত্রীর বাবা স্থানীয় সাংবাদিক মো. খোরশেদ আলম ওরফে বাবু মির্জা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমার মেয়ে কেজির মোড়ের আইসিএল স্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ে। স্থানীয় বখাটে আজিজুল হক হৃদয় আমার মেয়েকে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে উত্যক্ত করতো। মেয়ে আমাদের জানালে আমি নিজে হৃদয়ের অভিভাবকদের কাছে অভিযোগ করেছি। স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘গত মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মেয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে একজন নারীকে দিয়ে কৌশলে আমার মেয়েকে ডেকে নেয় হৃদয়। ওই দিন তার গায়েও হাত দেয়। মেয়ে দৌড়ে পাশে আমার ভাইয়ের ফার্মেসিতে গিয়ে ঘটনা জানায়। খবর পেয়ে আমি ছুটে যাই। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, বখাটেরা বসে আছে। আমি ঘটনার প্রতিবাদ করি। এর মধ্যে সেখানে আসেন খামারগ্রাম ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক ও এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রাশেদ উদ্দিন ভূঁইয়া। তিনি হৃদয়ের আত্মীয়। তার নির্দেশেই বখাটেরা আমাকে মারধর করে।’’

আমি অল্প দূরে আমার বোনের বাসায় আশ্রয় নিয়ে এসপিকে ফোন করি। তিনি দ্রুত ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠান। ঘটনাস্থল থেকেই পুলিশ রাশেদ, হৃদয় এবং রোকন ভূঁইয়া ও আশরাফুল ইসলামকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে আমি তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছি, যদিও মামলা প্রত্যাহারের জন্য অব্যাহতভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তাদের ভয়ে আমি বাড়িতে যেতে পারছি না।”

মঙ্গলবার বিকেলের এই ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও জড়িয়ে পড়েন। মামলা না করা, আসামীদের ছেড়ে দেওয়াসহ নানা ধরনের তদবির চলে রাতভর। কিন্তু পুলিশ তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় রাতে কোনো সমাধান হয়নি। সকালে স্থানীয় ছাত্রলীগের উদ্যোগে খামারগ্রাম ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীদের থানার সামনে আনা হয় বলে মনে করছেন কলেজের অধ্যক্ষ হায়দার আলী৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “ওই দিন আমি কলেজে ছিলাম না। আমার ধারণা, স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতারা শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করে থানায় নিয়ে গেছে। ওই দিন কলেজে টেস্ট পরীক্ষা ছিল। পরে আমরা পরীক্ষা বাতিল করেছি। এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতি সম্পৃক্ত হয়ে গেছে বলে আমরা দূরে আছি।”

‘অভিযুক্ত’ শিক্ষককে ছাড়াতে কেন আওয়ামী লীগের নেতারা ভূমিকা রাখলেন জানতে চাইলে এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বিষয়টি যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে, আসলে তেমন নয়। ওইদিন ইভটিজিংয়ের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। যে শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তিনি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক। এই ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। মধ্যস্থতা করার জন্য তিনি গিয়েছিলেন।” কোনো ঘটনাই যদি না ঘটে, তাহলে তাকে মধ্যস্থতার জন্য কেন যেতে হলো? এর জবাবে তিনি বলেন, “হৃদয় নামে ছেলেটার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ওই বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করছে ওই মেয়ে। এগুলো নিয়েই সামান্য তর্কাতর্কি হয়েছে। অথচ মেয়ের বাবা সাংবাদিক বলে প্রভাব খাটিয়ে উল্টো রাশেদকেই গ্রেপ্তার করিয়েছে। তিনি যেহেতু নির্দোষ, তাই জামিনে মুক্তির পর আমরা তাকে ফুলের মালা দিয়েছি।”

থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী অভিযুক্ত হৃদয়ের বিয়ের তথ্য দিলেও অন্যদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। হৃদয় খামারগ্রাম ডিগ্রি কলেজের ছাত্র। রাশেদ উদ্দিন ভূঁইয়ার আত্মীয় হলেও হৃদয়ের বিয়ের কথা তিনিই (রাশেদ উদ্দিন ভূঁইয়া) জানেন না। আজগর আলী ইভটিজিংয়ের কথা অস্বীকার করলেও আইসিএল স্কুলের প্রধান শিক্ষক শহীদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “মেয়েটিকে যে উত্যক্ত করা হতো এটা আমরাও জানতাম। শুধু ওই মেয়েটি নয়, আর কিছু মেয়েকেও উত্যক্ত করা হতো। যেহেতু ঘটনাস্থল স্কুল থেকে অনেক দূরে, ফলে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। আমাদের স্কুলে ১৫টি গ্রামের শিক্ষার্থীরা পড়ে। স্কুলের মধ্যে কিছু হলে তখন আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।” তবে এই উত্যাক্ত করার বিষয়টি অনেকেই জানতেন বলে স্বীকার করেন তিনি।

ঘটনাস্থলে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে খামারগ্রাম ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক ও এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রাশেদ উদ্দিন ভূঁইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমি অসুস্থ। হাসপাতালে ছিলাম। আমাকে মীমাংসার কথা বলে ডাকা হয়েছে। এখানে যে, নারীঘটিত বিষয় আছে, সেটাও আমি জানতাম না। ঘটনাস্থলে মোটর সাইকেল থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে পুলিশ আটক করে।” মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে কোনো বিরোধ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বলেন, “আমার সামাজিক অবস্থানের কারণে ঈর্শ্বান্বিত হয়ে তারা এই কাজ করতে পারে।” পরে আবার বলেন, “দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের জমি নিয়ে বিরোধ আছে।” তবে প্রধান অভিযুক্ত আজিজুল হক হৃদয় যে তার আত্মীয়, সেটা স্বীকার করেন রাশেদ উদ্দিন ভূঁইয়া।

মঙ্গলবার রাতে মামলা করার পর বুধবার দুপুরে গ্রেপ্তার ৪ জনকে আদালতে হাজির করা হয়। তাদের মধ্যে শিক্ষক রাশেদ উদ্দিন ভূঁইয়া জামিনে মুক্তি পান। অন্য তিনজনকে আদালত কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরই রাশেদকে থানা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে নিয়ে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। সেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

নবম শ্রেণির ওই শিক্ষার্থীর চাচাতো ভাই ও স্থানীয় একটি টেলিভিশনের সাংবাদিক স্বপন মির্জা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “রাশেদ ভূঁইয়াকে যখন থানা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় তখন তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এজাহারে থাকা ৫ নম্বর আসামী মো. মন্টু। থানা থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে আওয়ামী লীগের কার্যালয়। তারপরও পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেনি। এখন আমরাই চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছি। ওরা তো মামলার পর স্থানীয় লোকজন ও শিক্ষার্থীদের জোর করে এনে রাস্তা অবরোধ ও থানা ঘেরাও করে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ওরা আমাদের নামে এখন দুর্নাম ছড়াচ্ছে।”

ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে এনায়েতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবদুর রাজ্জাক ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ঘটনার খবরটি জেনে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছি। ঘটনাস্থল থেকে আমরা চারজনকে আটক করেছি। আমাদের প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা মিলেছে। এখন আমরা অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। এখানে কারো রাজনৈতিক পরিচয় আমাদের কাছে বিবেচ্য নয়। অভিযোগ যার বিরুদ্ধেই হোক তাদের আসামি করা হবে।” শিক্ষকের ফুলের মামলা দিয়ে বরণ করার অনুষ্ঠানে একজন আসামি উপস্থিত ছিলেন। তার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, “এই ধরনের কোনো তথ্য আমাদের কাছে ছিল না। আমরা তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।”

source : dw.com

Exit mobile version