Site icon The Bangladesh Chronicle

ইতিহাস ও সমাজ স্থির কিছু নয়, বদলায়।

Farhad Mazhar 12 June 2022
ইতিহাস ও সমাজ স্থির কিছু নয়, বদলায়। মানুষের চিন্তা ভাবনা বদলায়, বদলায় জীবন ও জগত সম্পর্কে ধারণা। তেমনি নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী এবং নারী-পুরুষ সম্পর্ক। একসময় সতীদাহ প্রথা ছিল। জীবন্ত নারীকে সহমরণে তার মৃত স্বামীর সঙ্গে চিতায় চড়তে হোত। কিন্তু সতীদাহ বা সহমরণই হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য বলার অর্থ হিন্দুর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ চর্চা করা। হিন্দু শাস্ত্রের ধূয়া তুলে হিন্দুর প্রতি ঘৃণা ও সহিংসতা একালে কেউ প্রদর্শন করে না। কারণ, সমাজ, আইন, সংস্কৃতি ও ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের চেতনা উপলব্ধি ও বিচার ক্ষমতা অনেক বিকশিত হয়েছে। আগের মতো নাই।
রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে।
“মা কেদে কয় ‘মঞ্জুলী মোর ঐ তো কচি মেয়ে
ওরি সঙ্গে বিয়ে দেবে বয়সে ওর চেয়ে
পাঁচগুণো সে; বড়ো
তাকে দেখে বাছা আমার ভয়েই জড়ো সড়ো
এমন বিয়ে, ঘটতে দেবো নাকো।
                      (“নিষ্কৃতি,” ‘পলাতকা’)
 ভাল কবিতা। নারীবাদী।
এই কবিতা পড়ে এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরও জেনে আমরা বুঝি তিনি বাল্যবিবাহের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু তাই কি?
তাঁর নিজের বিয়ে এবং নিজের মেয়েদের তিনি যে বয়সে তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়েছেন তার সঙ্গে ‘মঞ্জুলী’কে নিয়ে তাঁর কাব্যে উদ্বেগ স্ববিরোধী মনে হয়। কিন্তু আমরা রবীন্দ্রনাথকে অযথা নীচে নামিয়ে আনি না। এই না করাটা কাণ্ডজ্ঞান যেমন, একই সঙ্গে আবেগেরও বিষয়। কাণ্ডজ্ঞান এবং আবেগ বর্জিত সমাজ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু সমাজ দেশকালপাত্রের বাইরের কিছু না।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে পাত্রস্থ করেননি। ছেলে রথীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সেটা হয় নি। কিন্তু তিন মেয়েকেই রবীন্দ্রনাথ বাল্য বিবাহ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও বাল্যবিবাহ করেছেন ৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। যশোহরের দক্ষিণ ডিহি গ্রামের শুকদেব রায় চৌধুরীর বংশের ঠাকুর এস্টেটের গোমস্তা বেনীমাধবের কন্যা ভবতারিনী দেবীর সাথে রবীন্দ্রনাথের যখন বিয়ে হয় তখন তাঁর বয়স ছিল ২২ বছর এবং ভবতারিনী দেবীর বয়স ছিল ১০/১১ বছর।  ভবতারিনী দেবী যশোহরের মেয়ে। এ বিয়ে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কোন খেদ ছিল না। ঠাকুর বাড়িতে ভবতারিনীর নাম মধূর করে রাখা হয় মৃনালিনী। রবীন্দ্রনাথের দাম্পত্য জীবন মাত্র ১৮ বছর ১১ মাস ১৪ দিন।  মৃনালিনী দেবী মারা যান ১৯০২ সালের ২৩শে নভেম্বর তারিখে, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র উনত্রিশ বছর। সংসার জীবনে পাঁচ সন্তানের জনক-জননী হয়েছিলেন তাঁরা। বড় মেয়ে মাধবীলতা (বেলা) (১৮৮৬-১৯১৮) রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮৮-১৯৬১), রেনুকা (রানী) (১৮৯০-১৯০৩) মীরা অতশী (১৮৯৪-১৯৬৯) এবং শমীন্দ্রনাথ (১৮৯৬-১৯০৭)।
মাধবীলতা বেলা। বয়স তের পেরিয়ে কেবলই চৌদ্দতে পা দিয়েছে কবি তাকে বিয়ে দিয়ে দেন।  কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে যখন বিয়ে তখন বেলার বয়স শরতের চেয়ে অনেক কম। পাত্র পক্ষ থেকে দশ হাজার টাকা যৌতুক দাবী করে। রবীন্দ্রনাথ তাতে রাজি হলেন। বিয়ের সময় বেলার বয়স ছিল ১৪ বছর এবং  শরৎ চক্রবর্তীর বয়স ছিল উনত্রিশ বছর। স্বামীর সাথে বেলার বয়সের ব্যবধান ছিল ১৫ বছর।
কবি সেজ মেয়ে রেনুকা (১৮৯০-১৯০৩), ডাক নাম রানী। এবার পাত্র সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পেশায় ডাক্তার। কবি বিয়ের পর সত্যেন্দ্রনাথকে বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য পাঠাবেন এমন শর্তে সত্যন্দ্রনাথ নাবালিকা মেয়েকে বিয়ে করতে সম্মত হলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ও রানীর বিয়ে সম্পন্ন হল ২২শে শ্রাবণ ১৩০৮ বঙ্গাব্দে। বিয়ের সময় রানীর বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। বিয়ের এক বছর পরে যক্ষ্মা রোগে রানী মারা যান। তার বয়স তখন মাত্র ১২ বছর।
রবীন্দ্রনাথের সর্বকনিষ্ঠ কন্যা মীরা (১৮৯৪-১৯৬৯), ডাক নাম অতসী। বরিশালের বাহ্মসমাজের অন্যতম পুরোধা বামন দাশ গাঙ্গুলির পুত্র নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলির সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়। নগেন্দ্রনাথকে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন। শান্তিনিকেতনের মন্দিরে এ বিয়ে সম্পন্ন হল ১৯০৭ সালে। মীরার বয়স তখন ১৩ বছর। কবি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জামাতাকে প্রতিশ্রুতি অনুসারে আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মীরার সুখে সংসার করা হয় নি। এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান জন্মের পরে স্বামী নগেন্দ্রনাথ খ্রিস্টান হয়ে ঠাকুর বাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যান।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) বিয়ে করেছিলেন ১৪/১৫ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রী সারদা দেবীর বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর, শিবনাথ শাস্ত্রী বিয়ে করেছিলেন ১২/১৩ বছর বয়সে, তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ১০ বছর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিয়ে করেছিলেন ১৪ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ৮ বছর। বঙ্কিমচন্দ্র বিয়ে করেছিলেন ১১ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। রাজনারায়ণ বসু বিয়ে করেছিলেন ১৭ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ১১ বছর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ১৯ বছর বয়সে, তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ১৭ বছর বসে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ২২ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ১১ বছর। – এই ইতিহাসগুলো আমাদের ভুলে যাওয়া ঠিক না।
ইতিহাস ও সমাজ স্থির কিছু নয়, বদলায়। ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু দেশ ও কাল বিবেচনায় না নিয়ে  রবীন্দ্রনাথকে দোষী করলে সেটা কাণ্ডজ্ঞানের অভাব হবে। তাই না?
Exit mobile version