by Farhad Mazhar
নীচের লেখাটা লিখেছিলাম ম্যালাদিন আগে। ১৭ এপ্রিল ২০১৭। পড়ুন।
———————————
শুভ নববর্ষ। তবে একখানা আর্জি ছিল।
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে যারা হিন্দুদের সংস্কৃতি বলছে তারা নাকি সাম্প্রদায়িক? এর সঙ্গে নাকি ধর্মের কোনো সম্পর্ক নাই। পালটা দাবি হচ্ছে এটা ‘সার্বজনীন’, তদুপরি নাকি ‘জাতীয় ঐতিহ্য’! ইউনেস্কো খামাখা গ্যাঁড়াকলে পা দিল কি?
আচ্ছা বলুন তো, ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে অসুবিধা কি? মুসলমান যেমন, হিন্দুও নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠি হিসাবে ‘বাঙালি’ বটে । অতএব ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিন্দুর সংস্কৃতি হলেও সেটা বাঙালিরই সংস্কৃতি। অসুবিধা তো কিছু দেখি না। আরে বাবা তর্কটা তাহলে কীসের?
হোসেনি দালান থেকে তাজিয়া নিয়ে শিয়ারা শোভাযাত্রা বের করে আজ নয়, বহু বছর আগে থেকে। বাংলাদেশে ‘হিন্দুয়ানি ‘মণ্ডিত মঙ্গল শোভাযাত্রা তো এ কালের, বড় জোর দুই দশকের। তাজিয়া নিয়ে শোভাযাত্রা পুরানা, সেটা শিয়াদের ঐতিহ্য, কিন্তু সেটাও এই দেশেরই সংস্কৃতি। সেখানে অংশগ্রহণে কারুক্কে বাধা দেওয়া হয় না। এতে কি কোন অসুবিধা আছে? নাই। তাহলে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নিয়া আপত্তির জায়গাটা কোথায়?
অসুবিধা যখন আপনি বিশেষকে সর্বজনীন দাবি করেন। যখন একটি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যকে সকল সম্প্রদায়ের অর্থাৎ জাতীয় ঐতিহ্য বলে লাফালাফি শুরু করেন। তখন সমাজে সেকুলারিজম ও বাঙালি সংস্কৃতির নামে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আপনি নিজেই বপন করেন। তখন ‘মঙ্গল’ শব্দটিকেও খামাখা বিতর্কিত করে তোলেন এবং যে সামাজিক বোঝাবুঝির মধ্য দিয়ে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র মতো একটি ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়াকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যেতো, আপনারা, সেকুলার ব্রাদার্স এন্ড সিস্টার্স, তা করেন নি। একে ইসলাম বিদ্বেষ চর্চা ও ইসলামপন্থি রাজনীতির বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছেন। আবার ইসলামপন্থি আর হেফাজতিদের গালি দিয়ে প্রগতিবাদগিরি ফলাচ্ছেন।
মঙ্গল শোভাযাত্রা সর্বজনীন বাংলাদেশের সংস্কৃতি নয়, তাতে কি? সব সময় ধর্ম নিরপেক্ষ সংস্কৃতির জন্য চিৎকারেরই বা কী আছে? ধর্মীয় বা ধর্মীয় আবহে কিম্বা ধর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত অনুষ্ঠানে কী অসুবিধা? মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুয়ানি? তো হিন্দুয়ানিই হোক, অসুবিধা কি?
মুশকিলটা কোথায় খেয়াল করেন। যখন হিন্দু সংস্কৃতির ধারক ও বাহকরা দাবি করে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর সংস্কৃতিকেই বাঙালির সংস্কৃতি বলে আমাদের আজও মেনে নিতে হবে তখন তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা ছাড়া নিম্ন বর্ণের সনাতন ধর্মী ও অহিন্দুদের আর উপায় থাকে না।
আমরা কারা? আমরা বাংলাদেশে যারা রক্ত দিয়ে একাত্তরে নিজেদের ‘বাঙালি’ বলে প্রমাণ রেখেছি, সাতচল্লিশে দিল্লির সঙ্গে থাকি নি, ভারতীয় বাঙালি হই নি। একাত্তরে পাকিস্তানের সঙ্গেও না। তো সর্বজনীন বাঙালি সংস্কৃতির নামে বিশেষ সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি দয়া করে এই দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেবেন না। সমাজে যখন হিন্দু, মুসলমান বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আস্তিক নাস্তিক নানান প্রকার ‘বাঙালি’ আছে তখন তাদের আলাদা আলদা সংস্কৃতি থাকুক। কী অসুবিধা? সর্বজনীন বাঙালি বা বাংলাদেশী সংস্কৃতি নির্মাণ কিম্বা ‘জাতীয় ঐতিহ্য তৈয়ারি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বোঝাবুঝি ও নেগোশিয়েশানের ব্যাপার। নির্বিচারে হিন্দুর সংস্কৃতিকে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের ওপর চাপিয়ে দিতে গেলে উলটা ফল হতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, একে ‘জাতীয় ঐতিহ্য’ বলে দাবি করলে তা বিপদ ডেকে আনতে বাধ্য। সেই দাবি করতে হবে কেন?
মুশকিলটা এই জায়গায়। তখনই মনে হয় ব্যাপারটা পরিকল্পিত। উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈয়ার করা। যেহেতু মুসলমানরা বাঘ ভাল্লুক, হনুমান, পেঁচা, অসুর, খোক্কস, ডাইনি, পেত্নি ইত্যাদি সেজে শোভাযাত্রা করতে রাজি না তাই তাদের গাধা, সাম্প্রদায়িক, ওহাবি, জঙ্গি, বর্বর, পশ্চাতপদ ইত্যাদি বলে গালি দেবার সুবিধা তৈরি করা। তাই না? মুসলমানদের এতো বেকুব ভাবেন কেন?
হিন্দু সম্প্রদায় কিম্বা হিন্দু সংস্কৃতি ভাবাপন্ন ভাই বোনেরা আপনারা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করতেই পারেন। শুভ নববর্ষ। আপনারা বাঙালি, ফলে সেটা বাঙালির সংস্কৃতি অবশ্যই। কিন্তু দয়া করে তাকে বাংলাদেশের জনগণের সর্বজনীন সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য বলে দাবি করবেন না।
ভাইরে, এই দেশের মুসলমানরা আরব দেশ থেকে খোরমা খেতে খেতে উঠের পিঠে চড়ে আসেনি। তারা বাঙালি, এই দেশেরই সন্তান। ভাববেন না সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের কোন ধারনা নাই, ইতিহাস, প্রগতি কিছুই তারা বোঝে না, তাই তাদের ওজর আপত্তি মানা যাবে না। গায়ের জোরে আপনার ব্যাখ্যা সবার ওপর চাপিয়ে দেবেন, তাকি হয়? অতএব দাবি করবেন না ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ সর্বজনীন বাঙালির ঐতিহ্য? এর ইতিহাস দু দশকের বেশী নয়। বানানো জিনিস।
আমরা সাতচল্লিশ আর একাত্তর পার করে এসেছি। এখনও শুধুমাত্র হিন্দুর সংস্কৃতিকে সর্বজনীন বাঙালির সংস্কৃতি বলে মেনে নিতে হবে কেন? আপনি বাঘ, ভাল্লুক, পেঁচা, পেত্নি যা খুশী সাজুন, কোন অসুবিধা নাই, কিন্তু দয়া করে যা সর্বজনীন নয় তাকে বাঙালির জাতীয় ঐতিহ্য বলবেন না।
ফলে ব্যাকল্যাশ হিসাবেই ইসলামপন্থিরা ‘হিন্দুয়ানি’র প্রতিরোধ করছে। এটা অনিবার্য ভাবেই ঘটছে। ঘটবেই। এর জন্য সেকুলাররাই একশ এক ভাগ দায়ী। যারা শাহবাগের বাইরে বাংলাদেশ নামে একটা দেশ আছে তার কোন হদিস রাখে না, তারাই পরিস্থিতিকে খামাখা অস্থিতিশীল করে তুলছে। লিখে রাখুন আর জেনে রাখুন, এই দেশে হাঙ্গামার জন্য দায়ী হতে যাচ্ছে ইউনেস্কো। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি দেওয়া স্রেফ সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়া মাত্র।
আপনি যেমন খুশি সাজুন, বৈশাখে লাল পেড়ে শাড়ি পরুন –কোনই অসুবিধা নাই। আমরা ফটো তুলে রাখবো। কিন্তু তাকে সার্বজনীন বাঙালি সংস্কৃতি বা সার্বজনীন ঐতিহ্য প্রমাণ করবার চেষ্টা করবেন না।
যান খোরমা খেয়ে আসুন।
তবু আবারও বলি, শুভ নববর্ষ!