সে যাই হোক। রাত পোহালেই ভোট। প্রচার-প্রচারণা এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। সহিংসতার কিছু ঘটনাও ঘটেছে। তবে ভোট নিয়ে যে খুব বেশি উত্তেজনা আছে তা নয়। বিএনপিসহ বেশকিছু প্রধান রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করেছে। জাতীয় পার্টি ভোটে থাকলেও দলটির অন্তত ৬০ জন প্রার্থী এরইমধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ যে ফের ক্ষমতায় আসছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোথাও। তবে প্রধান বিরোধী দল কারা হবেন এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির ২৬টি আসনে সমঝোতা রয়েছে। তবে এরমধ্যে ১৬ থেকে ১৮টি আসনে জাপার প্রার্থীরা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন। একশ’ এর মতো আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেন এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে অন্তত ১৫ জন প্রার্থীকে জয়ী করানোর ব্যাপারে বিশেষ তৎপরতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তারা কেউ কেউ বিএনপি’র সাবেক নেতা, কেউ বিএনপি’র সাবেক জোট সঙ্গী, কেউ রওশন এরশাদের অনুসারী আবার কেউবা কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত দলের নেতা। এ সমীকরণকে সামনে রেখে সরকারি দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
আওয়ামী লীগের কিছু সূত্র বলছে, আগামী সংসদে বিভিন্ন মতাদর্শের লোকের সম্মিলন ঘটানোর তৎপরতা চলছে। এ প্রেক্ষাপটেই কোনো কোনো বিশ্লেষক স্মরণ করছেন ১৯৭৯ সালের নির্বাচনকে। যদিও সে নির্বাচনের সঙ্গে বর্তমান নির্বাচনের একটি বড় অমিল রয়েছে। সে নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিয়েছিল। জিয়াউর রহমান তখন ক্ষমতায়। ১৯৭৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হয়। নির্বাচনে বিএনপি ২০৭টি আসন পেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসনে জয়ী হয়। অন্যদিকে, মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অন্য গ্রুপটি দুটি আসন পায়। ফলে আওয়ামী লীগ (মালেক) মূলধারার আওয়ামী লীগ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আইডিএল-মুসলিম লীগের জোট গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ২০টি এবং জাসদ আটটি আসনে জয়ী হয়। প্রদত্ত ভোটের ৪১ শতাংশ পায় বিএনপি। আওয়ামী লীগ, গণতান্ত্রিক ইসলামী ফ্রন্ট ও জাসদ পায় যথাক্রমে ২৫, ১০ ও ৫ শতাংশ ভোট। ১৬ জন নির্দলীয় প্রার্থী জয়ী হন।
সেই নির্বাচনের একটি চিত্র পাওয়া যায় মহিউদ্দিন আহমদ এর ‘বিএনপি: সময়-অসময়’ বইয়ে। লেখককে দেয়া সাক্ষাৎকারে যাদু মিয়ার সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়টি উল্লেখ করেন মোখলেসুর রহমান (সিধু) ভাই। সাক্ষাৎকারের বিবরণটি এমন, যাদু মিয়াকে বলেছিলাম ‘আর যাই করো না করো, দেয়ার ক্যান নট বি এনি ডেমোক্রেসি উইদাউট অ্যান অপজিশন।…. তোমরা আমাকে একটা কথা দাও যে দেশে একটা অপজিশন বা বিরোধী দল থাকবে।’
ও বলেছিল ‘থাকবে মানে থাকবে।’ সাক্ষাৎকারে আরও বলা হয়, আমি বললাম, ‘বিরোধী দলকে আসতে দিতে হবে, বলতে দিতে হবে।’
যাদু বললো, ‘ তারা যদি ভোট না পায়।’
আমি বললাম, ‘ভোট তো তারা পাবে যাদু মিয়া, তোমরা যদি ভোটারের ভোট কেড়ে না নাও।’ তারা আমার এই কথাটা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিল, অ্যান্ড দে অ্যালাউড দ্য অপজিশন টু কাম।
কিছু লোক সত্যিকারভাবে নিজেদের জোরে এসেছিলেন আর কিছু জায়গায় ব্যাপার একটু অন্যভাবে ঘটেছিল। যেমন খান সবুর সাহেবের কথাই ধরুন। তিনি মুসলিম লীগার। এই মর্মে চুক্তি হয়েছিল যে তাকে তিন জায়গা থেকে পাস করিয়ে আনা হবে। তাকে তিন জায়গা থেকেই পাস করিয়ে আনা হয়েছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের সঙ্গে ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের কিছু মিল রয়েছে আবার কিছু অমিলও রয়েছে। যেমন এবারই প্রথম ভোটারদের কেন্দ্রে নেয়ার জোরদার তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। এমনকি কেন্দ্রে না গেলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বাতিলের হুমকির খবরও পাওয়া গেছে। শুক্রবারও সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, ভোটের হার সন্তোষজনক হবে। অনেক এলাকায় তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলেও সরকারি দলের প্রার্থীরা জোর প্রচারণা চালিয়েছেন। এটি মূলত করা হয়েছে ভোটের হার বাড়ানোর জন্যই। দ্বিতীয়ত, এবারই প্রথম স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এতটা আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনো এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩০ বা তার বেশি আসনে জয়ী হলেও তা বিস্ময়কর হবে না এমন আলোচনাও রয়েছে। আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বাইরেও কিছু প্রার্থী নিয়ে আলোচনা রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, তৃণমূল বিএনপি শমসের মবিন চৌধুরী, শাহীনুর পাশা চৌধুরী, বিএনএম এর শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, সাবেক বিএনপির নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, সৈয়দ একে একরামুজ্জামান, জিয়াউল হক মোল্লা, সরকার বাদল, মো. শোকরানা, জাতীয় পার্টির রওশনপন্থি নেতা মসিউর রহমান রাঙ্গা, রুস্তম আলী ফরাজী ও জিয়াউল হক মৃধা।
রোববার আরেকটি নির্বাচন। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতো বিশ্লেষকদের মতে, বিশেষ নির্বাচনী তৎপরতা। যে নির্বাচনে বেশি ভোটার উপস্থিতিই শাসক দলের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। ক্র্যাকডাউনের মুখে বিরোধী শক্তি আপাতত বিপর্যস্ত। ভারত, রাশিয়া, চীন দৃশ্যত সমর্থন জানিয়েছে এ নির্বাচনকে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব। ফের শপথের অপেক্ষায় আওয়ামী লীগের নেতা। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের সামনে কী অপেক্ষা করছে।
মানব জমিন