আলী রীয়াজ দেখিয়েছেন, কিভাবে নিপীড়নের মাধ্যমে এবং আইনি প্রক্রিয়ায় নিপীড়নের হুমকি দিয়ে মিডিয়াকে পরানুগত্য করায় ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তবে, এই পরানুগত্য একচেটিয়াভাবে জোরপূর্বক ছিল না। মিডিয়ার মালিক এবং সাংবাদিকদের আদর্শগত সখ্যতা এবং পক্ষপাতমূলক সম্পর্ক এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা কিছুটা গণতন্ত্রের “স্বেচ্ছা মৃত্যুদণ্ডের” মতো।
আলী রীয়াজ উদাহরণ দিয়ে যুক্তি দিয়েছেন- বাংলাদেশের স্বৈরাচারীকরণ প্রক্রিয়া সামগ্রিক বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু, এটা জোরদার হয়েছে- সম্ভবত সফল হয়েছে ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবেশি ভারতের অন্যায্য সমর্থনের কারণে। এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে ভারতের সাথে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা সত্ত্বেও দেশটি উল্লেখযোগ্যভাবে হাসিনা সরকারের পক্ষে রয়েছে। উপরন্তু, নানান কারণে গণতন্ত্রকে অগ্রাধিকার দিতে পশ্চিমা দেশগুলোর অনিচ্ছা পরিস্থিতিকে নিম্নগামী হতে দিয়েছে।
অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে সুস্পষ্ট গণতান্ত্রিক অবক্ষয় সত্ত্বেও চারটি দিক বিবেচনায় হাসিনা সরকারের প্রতি ভারতের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন পরিচালিত হয়েছে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ লিখেছেন, এটা আশ্চর্যজনক নয় যে চীন হাসিনা শাসনের সমর্থক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে৷ এই বিবেচনায় যে, এটি নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থার চীনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে খাপ খায় এবং কর্তৃত্ববাদের আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। চমকপ্রদ বিষয় হলো, ভারতের সাথে প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও দেশটি সেটা করেছে, যেখানে ভারত বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রাথমিক সমর্থক। এখানে চীন স্বৈরাচারী রূপান্তরের সহায়ক হয়ে উঠেছে।
আলী রীয়াজের ভাষ্যঃ বাংলাদেশের নির্বাচন কাছাকাছি আসার সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট এবং সঠিক পথে আসতে বাইরের ‘অ্যাক্টর’গুলোর চাওয়ার প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীনরা আরও বেশি অভ্যন্তরীণ চাপের সম্মুখীন হতে পারে। এই নির্বাচন যদি আগের দুটি নির্বাচনের মতো অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সেটা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে আইনি ও সাংবিধানিক ক্ষমতার দিক থেকে কেবল শক্তিশালীই করবে না বরং বিরোধীদের ধ্বংস করার সুযোগ দিয়ে (বাংলাদেশকে) কম্বোডিয়ার মতো একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করবে। কারচুপির নির্বাচন অস্থিতিশীলতার জন্ম দেবে, অবিলম্বে সহিংসতা দেখা যেতে পারে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও খুবই সম্ভাব্য।
অতএব, আগামী নির্বাচন যদি গণতন্ত্রের জন্য একটি সম্ভাব্য চাবিকাঠি হয়ে থাকে, তাহলে এমন নির্বাচন দেশকে একটি ‘ক্লোজড অটোক্রেসি’তে পরিণত করতে পারে এবং দেশটি দীর্ঘমেয়াদী সংকটে নিমজ্জিত হতে পারে। এভাবে, বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে। দেশটি সংকটসীমা অতিক্রম করবে কি না তা এই নির্বাচনই ভালোভাবে নির্ধারণ করতে পারে।
আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট আলী রীয়াজের ১০০ পৃষ্ঠার বইটির প্রথম সংস্করণ গত ২০ ডিসেম্বর বিশ্বখ্যাত বৃটিশ মাল্টিন্যাশনাল পাবলিশার ‘রুটলেজ’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ‘রুটলেজ এডভান্সেস ইন সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’ সিরিজের বইটির বর্ণনায় রুটলেজ বলেছে:
‘প্যাথওয়েজ অফ অটোক্রেটাইজেশন’ বইটি সমসাময়িক বৈশ্বিক রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর একটি নিয়ে আলোচনা করেছে: কীভাবে কোনো দেশ গণতন্ত্র থেকে স্বৈরাচারে পশ্চাদগমন করে?
গণতন্ত্র বিনষ্টকারী এবং স্বৈরাচারের দিকে পরিচালিতকারী প্রক্রিয়াগুলো বোঝার জন্য বইটি এক অভিনব কাঠামো প্রদান করেছে এবং বিশ্বের অষ্টম সর্বাধিক জনবহুল দেশ- বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের নির্দিষ্ট উদাহরণকে ব্যাখ্যা করেছে।
বিশেষ করে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির ঘটনা ও প্রবণতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে, বইটি বৈশ্বিক প্রবণতার মধ্যে দেশের স্বৈরাচারীকরণ প্রক্রিয়া কিভাবে প্রাসঙ্গিক সেটি তুলে ধরেছে এবং বলিভিয়া, কম্বোডিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, ফিলিপাইন ও তুরস্ক সহ সাম্প্রতিক দশকগুলোতে একই পথে চলা অন্যদের সাথে তার তুলনা করেছে।
সংক্ষিপ্ত, সূক্ষ্ম, এবং চিন্তা উদ্দীপক বইটি তাত্ত্বিক দৃঢ়তা এবং অভিজ্ঞতামূলক বিবরণে সমৃদ্ধ। গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের গতিশীলতা এবং এই প্রবণতাকে উল্টানোর সম্ভাবনাসমূহ বুঝতে আগ্রহী যে কারো এ বইটি অবশ্যই পড়া উচিত।