Site icon The Bangladesh Chronicle

আ’লীগে অর্থ জোগান দিচ্ছেন গাজীপুরের ২৬৭ শিল্পমালিক

logo

এস এম মিন্টু
মুদ্রিত সংস্করণ

শিল্প পুলিশের প্রতিবেদন

  • শ্রমিকদের অসন্তোষে ইন্ধন ও অস্থিরতার নেপথ্যে নেতারা
  • ঝুট ব্যবসা এখনো আ’লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে

গণ-অভ্যুত্থানের মুখে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ও তার দলীয় নেতাকর্মীরা পালিয়ে গেলেও আওয়ামীপন্থী ২৬৭ শিল্পকারখানার অর্থ জোগান এখনো বন্ধ হয়নি। কারখানাগুলো বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করছে নিষিদ্ধ দলের আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা। ওই সব কারখানার আয়ে আওয়ামী লীগকে অর্থ জোগানের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি শিল্প পুলিশের একটি প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পতিত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কারখানায় নেতাকর্মীরা এখনো ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।

শিল্প পুলিশের ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, শিল্পনগরী টঙ্গীর কারখানার ২৬৭ মালিক আওয়ামীপন্থী, আর বিএনপিপন্থী মাত্র পাঁচজন। রাজনীতি করেন না এমন কারখানামালিকের সংখ্যা ১১৫ জন। গাছা, বাসন, কোনাবাড়ি, কাশিমপুরসহ অন্যান্য এলাকার চিত্রও প্রায় একই রকম।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামীপন্থী ওই সব শিল্পমালিক দলীয় কাজে অর্থ জোগানের পাশাপাশি ঝুট ব্যবসায়ীদেরকেও বাঁচিয়ে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করছেন। আ’লীগ সরকারের পটপরিবর্তনের পর ঝুটসহ অন্যান্য ব্যবসা দখলে বিএনপির অনেকে হানা দিলেও মূলত আওয়ামীপন্থী মালিকদের কারণে বেশির ভাগই সফল হয়নি। উল্টো পরিকল্পিতভাবে বিএনপিসহ আওয়ামী সরকারবিরোধীদের গায়ে কলঙ্ক লাগানো হয়েছে, দখলদার-সন্ত্রাসী হিসেবে।

এ দিকে ঝুট ব্যবসা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ নানা অভিযোগে দলের সাঁড়াশি অভিযানের মুখে গাজীপুর বিএনপিতে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে মহানগর বিএনপির শীর্ষ একাধিক নেতা বহিষ্কার হয়েছেন। তাদের মধ্যে পাপ্পু সরকার, হালিম মোল্লা, জি এস শাহিন এবং মনিরুল ইসলাম অন্যতম। তাদের সবার বিরুদ্ধেই নানা অভিযোগ ছিল।

আওয়ামী সরকারের পটপরিবর্তনরে পর ঝুট দখল, চাঁদাবাজি, দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছিল। গত ২৮ জুন গাজীপুরা এলাকায় সাটার্ন নামে একটি গার্মেন্টসের ঝুট নামাতে গিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপে সংঘর্ষ হয়। এর একপক্ষে ছিলেন মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক হালিম মোল্লা আরেক পক্ষে ছিলেন টঙ্গী ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক কাজী হুমায়ন। সংঘর্ষে দুই পক্ষে প্রায় ১০ জন আহত হয়। এর আগেও প্রতিষ্ঠানটির ঝুট নিয়ে দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়। অভিযোগ আছে, বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা ও গাজীপুর শাখার সভাপতি দিলশান আরা বেগম প্রতিষ্ঠানটিতে ঝুট ব্যবসা করতেন। তার হয়ে গোপন যোগসাজশে বিএনপি নেতা হুমায়ন ঝুট ব্যবসা করছিলেন। লাভের একটি অংশ গোপনে আওয়ামী নেত্রী দিলশান আরার হাতে পৌঁছে দিতেন। বিষয়টি ঝুট ব্যবসা থেকে বঞ্চিতরা মানতে পারেননি। তারা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা হালিম মোল্লার সহযোগিতা চান। এরপর হালিম মোল্লা ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে গেলে দু’পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। একইভাবে পাগাড় এলাকায় কিছুদিন আগে বিএনপির দুই গ্রুপ ঝুট নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায়। ওমর ফারুক নামে আওয়ামী লীগ নেতা কারখানাটিতে ঝুট ব্যবসা করতেন। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বিএনপির একটি পক্ষ আওয়ামী লীগ নেতা ওমর ফারুকের সাথে হাত মিলিয়ে ঝুট ব্যবসা করছেন; কিন্তু এর বিরোধিতা করে বিএনপির আরেকপক্ষ। পরে ঝুট নামাতে গেলে দুইপক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। এতে বেশ ক’জন আহতও হয়। এভাবে পুরো গাজীপুরজুড়েই ঝুট ব্যবসার দৃশ্যমান দখলদার বিএনপি হলেও বাস্তবে নেপথ্য ভূমিকা রাখছে আওয়ামী লীগ ও ওই দলের সাথে সমর্থক নেতাকর্মীরা।

স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, গাজীপুর মেট্রোপলিটনের বাসন থানা এলাকার ম্যানাল ফ্যাশন লিমিটেড, কারখানার মালিক রাশিদুল হাসান চাঁদ। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান কচির ডান হাত ছিলেন। তার হয়ে বিজিএমইএ-সহ গার্মেন্টস ব্যবসায় একক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ৫ আগস্টের পর ব্যবসায়ী রাশিদুল হাসান চাঁদ তার ফেসবুকে থাকা সব ছবি মুছে ফেলে দিব্যি বিএনপির সাথে মিশে গেছেন। তবে গোপনে আওয়ামী নেতাদের সাথে সম্পর্ক রাখছেন। শুধু তাই নয়, বাসন এলাকায় সাততলা ফ্যাক্টরি নামে পরিচিত তার কারখানায় ৫ আগস্টের পরও আওয়ামী লীগ নেতা রিপন সরকার ও তার লোকজন ঝুট ব্যবসা করছেন। পটপরিবর্তনের পর অনেক কারখানার ঝুট ব্যবসায় হাত বদল হলেও ম্যানাল ফ্যাশনের ঝুট ব্যবসায় হাত বদল হয়নি। বরং ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত রিপন সরকারের অনুসারী আওয়ামী সন্ত্রাসী টাকলা মিনহাজ ও তার লোকজন নিয়মিত ঝুট নামাচ্ছিলেন। সাথে আপন চাচাত ভাই ওয়ার্ড বিএনপি নেতা বকুল ও হাতেম আলীকে নেন। অর্থাৎ নিকটাত্মীয় দুই বিএনপি নেতার সহযোগিতায় দিব্যি ঝুট ব্যবসা করছিলেন আওয়ামী সন্ত্রাসীরাই। কিন্তু বাদ সাধে স্থানীয় বিএনপির আরেকটি গ্রুপ। তারা মিনহাজ ও তার লোকজনকে ঝুট ব্যবসায় বাধা দিলে বিএনপিকে সামনে রেখে টাকলা মিনহাজ গ্রুপের হয়ে বকুল ও হাতেম আলী গ্রুপের সাথে সংঘর্ষ হয়। স্থানীয় বিএনপির একজন নেতা জানান, কারখানার মালিক রাশিদুল হাসান চাঁদ আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী, এটি তিনি গর্ব করেই বলেন। তিনি চান না বিএনপির লোক ঝুট ব্যবসা করুক।

একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও তার রাজনৈতিক মতাদর্শ উঠে এসেছে। রাশিদুল হাসান চাঁদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উপজেলায়। সেখানকার স্থানীয় এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চাঁদ ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি আব্দুল মান্নান কচির ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। তার নির্বাচনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ফেসবুকে দলীয় মিছিল মিটিংয়ের ছবি পোস্ট করতেন নিয়মিত; কিন্তু ৫ আগস্টের পর ফেসবুক থেকে সব মুছে ফেলেছেন।

বাসন থানার ইসলামপুরে অবস্থিত ওশান গ্রুপের অন্যতম মালিক মামুন জুবেরী মির্জা আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত। বাড়ি ফরিদপুরে। গত এক যুগ আওয়ামী পরিচয়ে ব্যবসায়ী মহলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছেন। অনেককে কোণঠাসা করে রাখতেন এমন অভিযোগও রয়েছে।

তিনি আওয়ামী লীগকে নিয়মিত অর্থ জোগান দিতেন। বর্তমানেও সেটি গোপনে অব্যাহত রেখেছেন। প্রতিষ্ঠানটির এমডি রায়হান আরো একধাপ এগিয়ে। মূলত তার হাত দিয়েই আর্থিক লেনদেন হয় এবং তিনি-ই সব ম্যানেজ করেন। ফরিদপুরের বাসিন্দা রায়হানের রক্তেমাংসে আওয়ামী গন্ধ। এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের যেমন আর্থিক জোগান দিতেন, তেমনি বাসনে অবস্থিত কারখানা এলাকায় আওয়ামী লীগকে এখনো পুনর্বাসনে গোপনে জোগান দেন বলে সূত্রটি জানিয়েছে।

বাসন থানা এলাকায় একক ঝুট ব্যবসার দখলদার থানা বিএনপির সভাপতি তানভীর সিরাজ। তবে মাঠপর্যায়ের তথ্য বলছে, তানভীর সিরাজ ঝুট ব্যবসার বড় অংশ ভাগবাটোয়ারা করেন আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার পরিবারের রিপন সরকার ও রাকিব সরকারদের সাথে। তাদের হয়ে মাঠ থেকে কমিশন উঠান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগও রয়েছে তানভীর সিরাজের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে মিছিল মিটিং, বিক্ষোভ, সভা-সমাবেশও হয়েছে। তবে দল কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

একইভাবে গাছা থানার ইস্ট ওয়েস্ট নামক একটি কারখানায় মালিকপক্ষের ছত্রছায়ায় এখনো ঝুট ব্যবসা করছেন তৎকালীন সরকার দলীয় সমর্থকরা। যদিও বহিষ্কৃৃত বিএনপি নেতা ফারুক খান ও রাজুর সংশ্লিষ্টতা দেখানো হচ্ছে। জানা গেছে, এই দু’জনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের আগের যারা ঝুট ব্যবসা করতেন, তারাই নিয়ন্ত্রণ করছেন। এতে বাধা দিতে গিয়ে উল্টো সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। সেখানে রুখে দাঁড়ান দল থেকে বহিষ্কৃৃত এবং সন্ত্রাসী ফারুক খান। বিনিময়ে ফারুক খান ও রাজু একটি কমিশন পান।

গাছা থানার সাইনবোর্ড এলাকায় একাধিক কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ বিএনপি নেতা পাগলা মোহাম্মদের দেখানো হলেও বাস্তবে আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান মশি এবং আব্দুল্লাহ আল মামুন মণ্ডল, আমিন উদ্দিন সরকার, তৌহিদুল ইসলাম দীপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে পাগলা মোহাম্মদ ঝুট ব্যবসার বৈধতা দিয়ে যাচ্ছে।

কোনাবাড়ি এবং কাশিমপুর এলাকায় দৃশ্যত ঝুট ব্যবসার দখলদার স্থানীয় বিএনপি। মহানগর বিএনপির এক শীর্ষ নেতার বাড়ি এই এলাকায় হওয়াতে তার একক নিয়ন্ত্রণ। তবে গোপনে গোপনে অর্থ চলে যায় আওয়ামী লীগের হাতে। এমন তথ্যও রয়েছে মাস শেষে শুধু কমিশনের টাকা বুঝে নেন স্থানীয় বিএনপির নেতারা। অনেক কারখানার ঝুট ব্যবসায় হাতও বদল হয়নি ওই নেতার কারণে। তার নিজের পুরো পরিবার আওয়ামীপন্থী হওয়ায়, বিশেষ সুবিধা পান এই এলাকার আওয়ামী নেতারা। অন্তত দেড়হাজার শিল্পকারখানার একক নিয়ন্ত্রক এই নেতা ঝুট ব্যবসা থেকে আয় করা টাকার একটি বড় অংশ দলের শীর্ষ নেতাদের হাতে তুলে দেন। সাথে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কিছু সদস্যকেও দেয়া হয় মাসোহারা।

Exit mobile version