Site icon The Bangladesh Chronicle

আরব-ইরান সম্পর্ক এক নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

এম কে ভদ্রকুমার : ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ১৩ নভেম্বর সৌদি আরব সফরে যাচ্ছেন। গত মার্চ মাসে চীনের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পর এ সফরকে মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক নতুন এক স্তরে পৌঁছেছে, যা আঞ্চলিক রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে আধিপত্য ছিল, তা এখন নাই বললেই চলে। গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য সর্বশেষ সোমবার চীন-আরব আমিরাত নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালায়। সেখানে সংবাদমাধ্যমের কাছে দুই দেশের প্রতিনিধিরা যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাও গুরুত্বপূর্ণ। বড় বিষয় হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানেও নেই।

পশ্চিমা আলোচনায় রাশিয়া-চীন-ইরান মিত্র সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারণা রয়েছে। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান তিনটি বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেছিল। এক. তাদের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয়; দুই. এ অঞ্চলের দেশগুলোকে অবশ্যই তাদের ভাগ্য নিজেদের হাতে নিতে হবে এবং আঞ্চলিক সমস্যাগুলোতে অন্যদের না জড়িয়ে নিজেদেরই সমাধান করতে হবে এবং তিন. মুসলিম ঐক্য গড়ে তুলতেই হবে, সেই পথ যতই দীর্ঘ ও কণ্টকাকীর্ণ মনে হোক না কেন।

পরিস্থিতির কারণে এই নীতির গুরুতর সীমাবদ্ধতা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো, বিভক্ত করা এবং শাসন করা। সেটাই বাস্তবে দেখা গেছে। যেমন ইরাক-ইরান যুদ্ধ বাধানো হয়েছে, যেখানে সাদ্দাম হোসেনকে সহযোগিতা করতে যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলের দেশগুলোকে প্ররোচিত করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী বিপ্লবকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালানো।

যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল হুমকির মুলা ঝুলিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যকে বিভক্ত করতে সফল হয়। তারা বেশ কয়েকটি উপসাগরীয় আরব দেশকে বোঝাতে সক্ষম হয়– ইরান সরাসরি হুমকি তৈরি করছে বা এমনকি ইরানি মিত্ররা তাদের ওপর আক্রমণ করবে। সেই সঙ্গে ভিন্নমতের আন্দোলন দমাতে ইরানের ভূমিকার বিষও সামনে আনে। এর মাধ্যমে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বিক্রি করতে সক্ষম হয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পশ্চিমারা ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে পেট্রোডলারকে পুঁজি করে। ফিলিস্তিনের দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ইরানকে অপরাধী বানানোর মাধ্যমে লাভবান হয়েছিল ইসরায়েল, যা মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মূল কারণ ছিল।

বলা যেতে পারে, ইরান-সৌদি-চীন চুক্তির ফলে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে বিরাজমান বৈরিতার অবসান ঘটেছে। একই সঙ্গে গত দুই বছরে উপসাগরীয় অন্য আরব দেশ ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্কেরও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে।  বাইডেন প্রশাসন এটা গ্রহণ করতে পারছে না যে, সৌদি আরব রাশিয়ার সঙ্গে ওপেক প্লাসের অতিরিক্ত তেল সরবরাহ কমানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ করুক। বিশেষ করে যে সময় সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে এবং একই সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও এগিয়ে নিচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কে সংঘাতের যে শঙ্কা, তা আমলে নিয়ে সৌদি আরব স্বস্তিতে রয়েছে, তেমনটি বলা যাবে না। অন্যদিকে সৌদি আরব ও ইরান উভয়ের উদ্বেগের বিষয় হলো, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা না থাকলে তাদের অগ্রাধিকারের নতুন পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যাবে।

তবে ওয়াশিংটন যেভাবে হিজবুল্লাহ, হামাস ও ইরানকে এক গোষ্ঠী হিসেবে বন্ধনীভুক্ত করছে, তাতে কিছুটা অনভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন সোমবার ইসরায়েলে তাঁর সর্বশেষ সফরের সময় বিষয়টি উল্লেখ করে একে বাকি অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। হিজবুল্লাহ ও হামাসকে যে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে রটানো হয়েছে, প্রশ্ন হলো, তারা কীভাবে সিন ফেইনের থেকে আলাদা, যা ঐতিহাসিকভাবে আইআরএর সঙ্গে যুক্ত ছিল?

যা হোক, অ্যান্টনি ব্লিংকেনের ইসরায়েল সফর এবং গত সপ্তাহান্তে জর্ডানে কিছু আরব দেশের সঙ্গে তাঁর শীর্ষ বৈঠক গাজা সংকটের নিষ্পত্তিমূলক মুহূর্তে পরিণত হয়েছে। তা যেভাবেই হোক না কেন, ইসরায়েলি বর্ণবাদী রাষ্ট্রকে থামানো এখন সময়ের ব্যাপার। কারণ মুসলিম দেশগুলো যখন একত্র হয়, তখন তারা উদীয়মান বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছে। ফিলিস্তিন সমস্যার মীমাংসায় তাদের দাবি ইতোমধ্যে পশ্চিম গোলার্ধে অনুরণিত হয়েছে।

এম কে ভদ্রকুমার: ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

Exit mobile version