Site icon The Bangladesh Chronicle

আমিও মুক্তিযোদ্ধা হতে চাই

উপসম্পাদকীয়

প্রফেসর ড. এম এ মান্নান

আমিও মুক্তিযোদ্ধা হতে চাই – নয়া দিগন্ত

নিবন্ধের শিরোনামটি অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। জাতি যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে তখন এটা হাস্যকরই বটে। কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়লাম, এখনো নাকি ৪২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদ নতুন করে যাচাই করা হবে। তারা দেশের ভেতরে যুদ্ধ করেছিলেন, ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যাননি। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের স্বীকৃতি স্থায়ী করতে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, এমন তিনজন সহযোদ্ধার সাক্ষ্য জোগাড় করতে হবে। আরো জানা গেল, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতাপ্রাপ্তদের তালিকা ডিজিটালাইজড করার পর সুবিধাভোগী ২১ হাজার কমে গেছে। অন্য খবরে বলা হয়েছে, সনদপ্রাপ্ত দুই হাজারের বেশি মুক্তিযোদ্ধার বয়স নাকি পঞ্চাশের কম। বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে এরকম নানা অনিয়মের কথা প্রায়ই শোনা যায়। ভুয়া সনদ নিয়ে সরকারের শীর্ষ আমলা পদে আসীন থাকার কথাও আমরা শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধকে এভাবে বাণিজ্যিক পণ্য বানানোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া জরুরি। পাশাপাশি ভারতে গেছেন বা যাননি এমন লোকদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও যারা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জনমত গঠন করতে এবং নানাভাবে চেষ্টা চালাতে গিয়ে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের চিহ্নিত ও খুঁজে বের করা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও পরিপূর্ণ ইতিহাস সংরক্ষণ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তা জানানোর জন্য সত্যিকারের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করা যে অপরিহার্য তাতে কারো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।

ষাটের দশকের শেষের দিকে তৎকালীন পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের ফিসক্যাল মনিটরিং সেকশনে অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ হিসেবে কাজ করেছি। ফলে দেশের দুই অংশের আর্থিক ও অন্যান্য বৈষম্যের বিষয়টি ছিল আমার কাছে একেবারে স্পষ্ট। এই বৈষম্য তুলে ধরে আমি সরকারি চাকরি খোয়ানোর ঝুঁকি নিয়েও ‘ইকোনমিক প্রবলেমস অ্যান্ড প্লানিং ইন পাকিস্তান’ শীর্ষক একটি বইও লিখি (এ বিষয়ে ইতঃপূর্বে নয়া দিগন্তের কলামে বিস্তারিত বলা হয়েছে)। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে পিএইচডি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। সেখানে গেলেও দেশের পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছিলাম। তা ছাড়া সিরাজগঞ্জ কলেজে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে রাজনীতির প্রতি ঝোঁক ছাত্রাবস্থা থেকেই আমার ছিল (এ প্রসঙ্গেও আগে লেখা হয়েছে)। ফলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমি সচেতনভাবেই অনুধাবন করি যে, এখানে ঠিক একটি দেশের মানুষে-মানুষে যুদ্ধ হচ্ছে না, এটা হচ্ছে বাঙালির সাথে পাঞ্জাবির যুদ্ধ যা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। অবশ্য পাকিস্তান সরকারের সুপারিশে স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। প্রথম এক বছর ইউএসএআইডি ও পরে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ মিলিয়ে পাঁচ বছরের প্রোগ্রাম।

আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে যাই তখন সরকারি চাকরির বেতন, ফেলোশিপের বৃত্তি, বাসাভাড়া, বই কেনার জন্য ভাতা, স্ত্রী-সন্তানদের জন্য ভাতা ইতাদি সব মিলিয়ে ৯০০ ডলারের ওপরে মাসে পেতাম। ডলারের দাম ছিল সাড়ে চার টাকার মতো। মানে বিশাল আর্থিক সুবিধা। তখন যুক্তরাষ্ট্রে জীবনযাত্রা এমন ছিল যে, একটি পরিবারের ভালোভাবে চলার জন্য ১০০ ডলারই যথেষ্ট। তিন বছরের মেয়ে ও দুই বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী তখন নারায়ণগঞ্জে আমার শ্বশুরবাড়িতে। ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ার পর খবর পেলাম, নারায়ণগঞ্জে আর্মি অপারেশন চালিয়েছে। আমি ভাবি, পরিবারের কেউ আর বেঁচে নেই। তখন পশ্চিম পাকিস্তানে আমার পরিচিত এবং আল্লøামা ইকবালের ছেলে জাভেদ ইকবালের শ্বশুর ড. আবদুুল ওয়াহিদকে চিঠি লিখি পরিবারের খবর জানতে। তিনি ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে এক জেনারেলের শরণাপন্ন হন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান, যাকে ‘বুচার অব বেঙ্গল’ বলা হতো। সেনাবাহিনীর ব্যাপার। তাই খবর নিতে টিক্কা খান একজন ব্রিগেডিয়ারকে পাঠালেন। তার মাধ্যমে আমার কাছে খবর আসে, পরিবারপরিজন ভালো আছে। আমি সরকারি কর্মকর্তা থাকার কারণে এই খবর নেয়া সম্ভব হয়েছে।

তখনো প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়নি, বিভিন্ন স্থানে ক্র্যাকডাউন হচ্ছে। ফলে আমি পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেই। ওরা যাওয়ার পরপরই পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ওই সময় সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকে পক্ষত্যাগ করতে শুরু করেছেন। তখন ওয়াশিংটন পূর্ব পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি আমাকে কল করে বলেন, আমাকে দেশে ডেকে পাঠানো হয়েছে। বলা হলো, আমার পদোন্নতি হয়েছে, ডেপুটি চিফ করা হয়েছে। জবাবে জানাই, আমি যে কাজে এসেছি তা শেষ হয়নি। ভেবে দেখি।

তখন আমার মনে ভাবনার উদয় হলো, এই পাকিস্তানের স্বপ্ন তো আমরা দেখিনি। আমার বাবা, চাচারা এই পকিস্তানের স্বপ্ন দেখেননি। তারা মুসলমানদের জন্য একটি দেশ চেয়েছিলেন। এখন মুসলমানই মুসলমানকে হত্যা করছে। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি তো আমার ভালোভাবেই জানা ছিল। তা ছাড়া অর্থনীতিবিদ গুনান মিরডাল ১৯৬২ সালেই বলেছিলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে উন্নয়নের বৈষম্যের ফলে যে টানাপড়েন সৃষ্টি হচ্ছে তা সমাজ সহ্য করতে পারবে না। তিনি বলেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সব বৈশিষ্ট্যই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে রয়েছে।’ যুদ্ধ আমাকে মানসিকভাবে আঘাত করার আগেই, অর্থনীতির ছাত্র হওয়ায় এই বৈষম্যগুলো আমাকে যৌক্তিকভাবে আঘাত করে। ফলে খুব সচেতনভাবে পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে না ফেরার সিদ্ধান্ত নিই। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মনোভাব আমার শৈশব থেকেই ছিল। ইসলামেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তান ভাঙতে চাননি। তিনি বৈধ অধিকার বলেই প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। তাই আমি মেনে নিতে না পেরে অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছি। অন্যায়কে সমর্থন না করা ছিল আমার জোরালো নৈতিক অবস্থান। দেশে ফিরতে অস্বীকার করলে আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। ফলে রাতারাতি আমার আয় ৯০০ ডলার থেকে শূন্য ডলারে নেমে আসে। আমার পরিবার রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে। ডক্টরাল প্রোগ্রামে ছিলাম। দ্রুত মাস্টার্স প্রোগ্রামে চলে আসি। এই অবস্থার মধ্যেও মিশিগানে আমরা প্রথম ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়্যার ডিফেন্স লিগ’ গঠন করি।

তখন মুহিত সাহেব (সাবেক অর্থমন্ত্রী) ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে কাউন্সিলর ছিলেন। আমরা ডিফেন্স লিগের সদস্যরা মিলে তাকে পক্ষত্যাগে রাজি করাই। তার জন্য আলাদা বাড়ি ভাড়া করতে আমি নিজে ৩০০ ডলার চাঁদাও দিয়েছি। ১৯৭১ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে জেনেভা গিয়েছিলেন। তাকে পক্ষত্যাগে রাজি করাতে ডিফেন্স লিগের সদস্যরা জেনেভা গেলেন। আমারও যাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু পরিবার ও আর্থিক সঙ্কটে থাকায় তা হয়নি। আবু সাঈদ চৌধুরীর পক্ষত্যাগের নেপথ্যে এটাও ছিল যদিও তিনি সরকারকে লেখা পত্রে বলেন, ‘নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। তাই তার আর ভিসি থাকার যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।’ মুহিত সাহেব ও আবু সাঈদ চৌধুরী দু’জনেই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। কিন্তু নিজে আমলা থাকার সুবাদে জানি, সব আমলার মধ্যেই চাকরি হারানো ভয় কাজ করে। তাই পক্ষত্যাগ করাটা তাদের জন্য অনেক বেশি সাহসের। তাদের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল যে, আমরা হয়তো তাদেরকে পোলাও-কোরমা খাওয়াতে পারব না, কিন্তু ডাল-ভাত খাওয়াতে পারব। মুহিত সাহেব যখন ইসলামাবাদে ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন তখনই আমার পরিবারের সাথে তার পরিচয়। ওনার বাসায় আমাদের যাওয়া-আসা ছিল। ফলে তিনি ভালোভাবেই আমাকে চিনতেন। ১৯৭৩ সালে তার স্বাক্ষরেই আমি ও আমার পরিবারের সবাই স্বাধীন বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি যখন রাষ্ট্রহীন, তখন আরেকজনকে রাষ্ট্রহীন হতে বলার জন্য কতটা ঝুঁকি ও সাহস সঞ্চয় করতে হয়েছিল, ভাবা যায়?

পাসপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে কেমন জীবন কাটাতে হয়েছে সে কথা আমার অনেক লেখায় রয়েছে। মেয়ের জন্য ছয় ডলার দিয়ে একটি বার্বি পুতুল কিনতে পারিনি। বহু দিন ছেলেমেয়েকে কোলে তুলে আদর করতে পারিনি। কারণ যখন কাজের জন্য বের হতাম তখন ওরা ঘুমিয়ে থাকত। আবার যখন ঘরে ফিরতাম তখনো ওদেরকে ঘুমে পেতাম। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে আমি নিজেই মরার মতো ঘুমাতাম। এমন অবস্থায় পড়তে হবে, সেটি ভালোভাবে উপলব্ধি করার মতো ক্ষমতা আমার ছিল। এরপরও কেন পক্ষত্যাগ করেছি? কারণ আমার দেশপ্রেম ছিল। এই মাটির প্রতি দরদ, ভালোবাসা ছিল। আমার আয় যখন শূন্য, তখনো ডিফেন্স লিগকে ৩০০ ডলার চাঁদা দিয়েছি। ওই টাকা দরকার ছিল বাঙালি কর্মকর্তাদের পক্ষত্যাগে রাজি করাতে; যেন তারা আর্থিক কষ্টে না পড়েন সে আশ্বাস দিতে।

তখন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস চেরিলেনের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম। বিদেশী শিক্ষার্থীরা সেখানে থাকত, অনেক বাঙালি আসতেন। বাঙালি কেউ এলে বাংলাদেশের আর কেউ আছে কি না তার খোঁজ করতেন। ডিফেন্স লিগ সদস্যদের মধ্যে আমি বেশ সোচ্চার ছিলাম। তখন প্রফেসর এ আর মল্লিক, যিনি পরে অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন, বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগঠনের জন্য আমেরিকা আসেন। তিনি সম্পর্কে স্ত্রীর দিক থেকে আমার মামা হন। তিনি এসে বললেন, ‘এই যুদ্ধ কত দিন চলবে তা তো বলা যায় না, দেখো তো মান্নান, কোনো ভিজিটিং প্রফেসরের চাকরি পাওয়া যায় কিনা।’ যুদ্ধের একটি পর্যায়ে সবকিছু অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায়। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিছিলেন। ফলে আমরাও শঙ্কিত ছিলাম শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা নিয়ে। তবে ৬ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘে বৈঠকের পরই চূড়ান্ত হয়ে যায়, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে।

এই সুখবরের মধ্যেও আমার জন্য দুঃখের বিষয় ছিল, মিশিগানে ছিলাম একমাত্র বাঙালি যার জে-ভিসার আওতায় ইউএসএআইডির ফেলোশিপ ছিল। বাকি সবার ছিল ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ। আমি যখন পিএইচডি করতে আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই তখন বলা হয়েছিল- ফোর্ড ফাউন্ডেশনের স্কলারশিপ পেতে হলে আমাকে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ঝড়ের আভাস টের পাচ্ছিলাম। ফলে অপেক্ষা না করেই যুক্তরাষ্ট্র চলে আসি। ভেবেছিলাম, ইউএসএআইডির ফেলোশিপে এক বছর পার করতে পারলে পরে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের স্কলারশিপ পেয়ে যাবো; কিন্তু পাকিস্তান সরকার যখন লিখল- আমি আর তাদের অফিসার নই, তখন আমার স্কলারশিপ কেটে দেয়া হয়। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলল, তুমি সরকারের কাছ থেকে চিঠি আনতে পারলে আমরা তোমার ফেলোশিপ পিএইচডি শেষ না হওয়া পর্যন্ত চালাব। তুমি এখন দেশে গিয়ে আবার আসো। আমি বলতাম, আমি তো আসতে পারব না। তখন বলা হলো, ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাস আমার ফিরে আসার সব ব্যবস্থা করবে। তবে একটি শর্তে যে, তাদের জন্য কাজ করতে হবে। তখন আমার চরম অভিমান হয়েছিল। দেশে না ফেরায় আমার হোম কান্ট্রি (পাকিস্তান সরকার) আমাকে স্বীকৃতি দিলো না। প্রশাসনে আমার অনেক বাঙালি কলিগ ছিলেন। তাদের কারো কাছ থেকে সাড়া পাইনি। তাদের নাম এখানে উল্লেখ করছি না। তাই বলে আমেরিকার পক্ষে কাজ করব? ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। এরা আমাকে অপমান করছে।

এ অবস্থার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে আমেরিকাতে আমরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছিলাম যে, পাকিস্তান দূতাবাসকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে খবর ছাপাতে হতো। আমার বাবা, চাচাদের লড়াই করে অর্জন করা পাকিস্তানের ইমেজ এতটা খারাপ হতে দেখে দুঃখই হতো। সচেতনভাবে এরকম জীবন বেছে নেয়া কি স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই নয়? আগ্নেয়াস্ত্রের বদলে কলমের অস্ত্র দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে লড়াই; আয়েশি জীবন থেকে দুর্ভোগের জীবন বেছে নেয়ার মধ্যে কি কোনো ত্যাগ নেই? হ্যাঁ, আছে, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমার কোনো মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেই। আমার মতো আরো অনেকে তখন বিদেশের মাটিতে দেশের পক্ষে কাজ করেছেন। তাদের সবার কি সার্টিফিকেট আছে? যখন তারা দেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তারা ভাবেননি যে, একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট দেয়া হবে। তারা সার্টিফিকেটের জন্য লালায়িত ছিলেন না।

বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে সব কিছু করছে। যারা দেশের বাইরে থেকে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন তাদের খুঁজে বের করে যথাযথ সম্মান জানানো কি সরকারের উচিত নয়? আমার মতো যারা এখনো বেঁচে আছেন তারা অবদানের স্বীকৃতি পেলে গর্ব বোধ করবেন। সার্টিফিকেট দেখিয়ে সরকারি সুবিধা নেয়ার প্রয়োজন আমার নেই। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম তো জানবে, তাদের নানা বা দাদা দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। যারা বেঁচে নেই; তাদের মরণোত্তর সম্মান দেয়া হলে সেটি তার উত্তরসূরিদের জন্য গৌরবের। আর সবাই জানবে, এই দেশ অর্জনের পেছনে তাদের অবদানটুকু জাতি মনে রেখেছে।

আমি এখন জীবনের গোধূলিলগ্নে অবস্থান করছি। আমাকে সম্মাননা দিলে খুশি হবো। এটা ঠিক; কিন্তু আমার সাথে যারা বেঁচে আছেন তাদের দিলে আরো বেশি খুশি হবো।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com

Exit mobile version