Site icon The Bangladesh Chronicle

আমরা কাদের পরিচর্যা করছি?

Daily Nayadiganta (নয়া দিগন্ত) : Most Popular Bangla Newspaper


যৌবনের প্রারম্ভে, সে অনেক দিন আগের কথা, আমাদের শ্রদ্ধাস্পদ এক জ্যেষ্ঠ বা সিনিয়র কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, কচু গাছ কাটতে কাটতেই ডাকাত-খুনি হয়। সেদিন তার কথায় যতটা মনোযোগ দিয়েছিলাম ও যতটুকু বুঝেছিলাম, তখন সে কথাভেদ অনেক বেশি স্বচ্ছ ছিল না। সেদিন বয়স ও পরিবেশ পরিস্থিতিও এমন ছিল না। এখন অনেক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। তাছাড়া দেশের অবস্থা, সমাজ, রাষ্ট্রের যে হাল, তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দীর্ঘকাল পর ওই বাক্য এখন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। সেই কথার ব্যাখ্যা এখন অনেক হতে পারে, তবে এর ভেতর যে সরল তত্ত্বটি অন্তর্নিহিত রয়েছে, এখন মনে হয়, বয়োসন্ধিতে কোনো কিশোর যখন অপকর্মে লিপ্ত হতে থাকে, সে সময় তার প্রতিকার-প্রতিরোধ করা না হলে, শুদ্ধ-সিদ্ধ চলার পথটা যদি তাকে সযত্নে খুঁজে দেয়া না যায়, তথা পথটা তাকে ধরিয়ে দেয়ার কেউ সমাজে না থাকে তবে অনিবার্যভাবে ক্রমেই ওরা যৌবনে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে, সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা এদের পদচারণায় দূষিত-কলুষিত হয়ে পড়ে। আজ এমন পথহারাদের জন্য সৎ পথ দেখানোর কোনো সৎ প্রাণ মানুষ বা রাষ্ট্রীয় কোনো ব্যবস্থা দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। বরং তার উল্টোটা সমাজে বিদ্যমান, সেসব যুবকদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বহুজনকে দেখা যাবে। এদের ছায়াদানের বিনিময়ে ওদের কাছ থেকে ষোলো নয়, বত্রিশ আনা বিনিময় আদায় উসুল করে নেয়া হয়। যেমন তাদের অন্যায় স্বার্থ উদ্ধারে হেন কুকর্ম নেই, যা তারা তাদের দিয়ে করিয়ে নেয় না। ওই সব পথহারা হতভাগ্যের ওপর ভর করে বহু লোক এখন ‘সমাজপতি’ ও রাজনৈতিক অঙ্গনের ‘কেউকেটা’ হয়েছেন এবং হচ্ছেন। অবৈধ পথে অর্থসম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন। তাদের সব ধরনের প্রতিপক্ষ বা বিরুদ্ধবাদীদের শায়েস্তা করার জন্য এদের দিয়ে এমন নির্মম কাজটি পর্যন্ত করিয়ে নেন যা লোমহর্ষক। আর এরা নিজেদের এসব অন্যায় অপকর্ম ঢাকতে অহরহই উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার কাজে সিদ্ধহস্ত। এমন সব সমাজপতি ও রাজনীতিকের এমন নীতি বৈকল্যমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে প্রতিপক্ষের হেনস্তার সীমা পরিসীমা থাকে না। এমন শিকার হওয়া মানুষের উদাহরণ সমাজে বহু খুঁজে পাওয়া যাবে যা আঁধার ঘরে কালো বিড়ালের জ্বলন্ত চোখের মতো উজ্জ্বল ও জ্বল জ্বলে।

এখন সমাজে মূল্যবোধের যে অবক্ষয় তা জাতিকে শুদ্ধ-শূচিতার মূল চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। ক্ষয়রোগ যেমন মানুষের অন্তরকে সারশূন্য করে ফেলে, জাতিরও আজ তেমন অবস্থা। কখন যে, কোন ঝড়ো হাওয়া সব কিছু ওলট-পালট করে ফেলবে, তখন যে ক্ষতি জাতির হবে, তা আর কোনোভাবে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। নীতির ভ্রষ্টতার কারণে জাতির ধমনী থেকে কিভাবে রক্ত শুষে নেয়া হচ্ছে, অর্থ পাচার দুর্নীতির মাধ্যমে যা এ সময়ে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। জানি না, আমরা কোথায় কোন গন্তব্যে যাচ্ছি। এমন গন্তব্যহীন যাত্রা তো কখনোই নিরাপদ স্বস্তির হতে পারে না। আজকে একটি দিন যদি হেলায় অবহেলায় অর্থহীন হয়, তবে এভাবে কত অমূল্য দিন যে জাতির জীবন থেকে খসে গেছে, যাচ্ছে, তার হিসাব কে নেবে? ৫০ বছর তথা অর্ধশতাব্দী কোনো জাতির জন্য খুব কম নয়। কোনো জাতি এ সময়ের মধ্যে যদি তার সঠিক ‘ডেসটিনি’টা নির্ধারণ করতে না পারবে, এটা শুধুমাত্র হতাশাব্যঞ্জকই নয়, জাতির কর্ণধারদের পারঙ্গমতা সক্ষমতা নিয়ে শত প্রশ্নের সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাদের অক্ষমতার জেরের কারণে সমাজ এখন বদলে গিয়ে এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। অনেক দিন থেকে দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণে দেখা যাবে, নৈতিক দেউলিয়াত্বের জের হিসেবে মানুষের ভেতর বৈষম্য ঘৃণা হিংসা সমাজকে উচ্ছন্নের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সমাজে বৈষম্য বরাবর ছিল এখন তা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছে। কোনো সুস্থ সমাজে এমনটা বিরাজ করতে পারে না। সমাজে বিশৃঙ্খলা বৈপরীত্য শুধু বিপজ্জনকই নয়, বড় ধরনের বিপর্যয়ের অশনিসঙ্কেত।

আমাদের সমাজের হালের কথা বস্তুত কিঞ্চিত আভাস দিয়েছি। এর কিন্তু লোমহর্ষক চিত্র যে কত ভয়াবহ নির্মম নৃশংস তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতোমধ্যে যেসব দুর্বৃত্তের কথা বলেছি, তারা যে বকলম তাও উল্লেখ করেছি। কিন্তু অতি সম্প্রতি রাজধানীতে যে ‘কুরুক্ষেত্র’ দেখার দুর্ভাগ্য নগরবাসীর হয়েছে সেখানে যারা অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রলয় কাণ্ড ঘটিয়েছে এদের কেউই বকলম নয়, মহাবিদ্যালয়ের ‘শিক্ষার্থী’! এদের কারো অতীত হয়তো এমন ছিল না, তাদের চারিত্রিক স্খলন ঘটেছে কুসঙ্গে, সান্নিধ্যে। ওরা দলান্ধ বিবেকশূন্য ‘বড় ভাই’দের কাছ থেকে যা তাদের কাছে ‘এলহাম’ হয়, বিনা বিচার বিবেচনায় ওই বার্তাকে শিরোধার্য করে সেই নির্দেশকে প্রতিপালন করতে বেপরোয়া দুর্ধর্ষ হয়ে উঠে খুন জখমে লিপ্ত হয়। এসব ক্যাডার ঢাকা কলেজের মুষ্টিমেয় ছাত্র, যারা ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কিছু ভয়ঙ্কর সদস্য। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এদের দ্বারা সংঘটিত জঘন্য ঘটনার পরপরই, এক ভাঙ্গা রেকর্ড বাজানো শুরু হয়েছিল, ‘এই কুরুক্ষেত্রের সব পাত্র-মিত্র ক্ষমতাসীনদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগোষ্ঠীর সদস্যরা ঘটিয়েছে কিন্তু বেশিক্ষণ সে ভাঙা রেকর্ড বাজানো সম্ভব হয়নি। স্বল্প সময়ের মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তদন্তে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। কুরুক্ষেত্রের সব পাত্র-মিত্ররাই ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের দুর্ধর্ষ সদস্য। তখন একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল ‘ঢাকা কলেজের হেলমেট বাহিনী ২০ শনাক্ত,’ সাব হেডিং ছিল, ওদের টার্গেট ছিল নিউমার্কেট ও চাঁদনী চকের জুয়েলারির দোকানগুলো লুট। খবরের বডিতে রয়েছে ‘ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে নিউমার্কেটের দোকান কর্মচারীদের সংঘর্ষের সময় কম্পিউটার দোকানের কর্মচারী নাহিদকে পিটিয়ে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ছয়জন শনাক্ত হয়েছে। উল্লেখ্য, এরা সবাই ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। অপর এক জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম ছিল, রক্ত খেলায় ঢাকা কলেজ ছাত্র লীগের ‘হিটার গ্রুপ’। খবরে হাইলাইট করা হয়েছে ‘বছরজুড়েই মার্কেট এলাকায় ছাত্রনেতাদের চাঁদাবাজি।’

ক্ষমতাসীন দলের এমন সব ‘সুসন্তান’, এহেন মাস্তানি, খুন-খারাবি নতুন কোনো ঘটনা নয়, নিশ্চয়ই সহৃদয় পাঠক আপনারা ভুলে যাননি বুয়েটের সেই মেধাবী ছাত্র আবরারের কথা, কী নির্মমভাবে তাকে তার রুম থেকে বের করে ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মী বেদম পিটিয়ে হত্যা করেছিল। তাকে হত্যার পর তার কনিষ্ঠ ভাই দুঃখ কষ্টে ভয়-ভীতিতে ঢাকা কলেজ ছেড়ে কুষ্টিয়া চলে গেছে। এর আগের ছাত্রলীগের এমন মারদাঙ্গা বাহিনীর উন্মাদ প্রায় সদস্যদের ভয়ঙ্কর রোষে পথচারী বিশ্বজিতের মৃত্যু ঘটেছে। তাকে রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে লাঠিসোটা রড চাপাতি দিয়ে ছাত্রলীগের সদস্যরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। এমন সব ‘সুসন্তানদের’ লংকাকাণ্ড দেশব্যাপী এখানে সেখানে ক্রমাগত ঘটছেই। অপমৃত্যুর এই মিছিল থামবে কবে? যারা ক্ষমতায় আসীন তাদের অনুগামীর এমন কীর্তিকলাপের দায়িত্ব তাদের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সাবেক কেয়ারটেকার সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ঢাকা কলেজের ঘটনার পর ফেসবুকে একটি পোস্টে ঢাকা কলেজে তার ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ করে কিছু কথা লিখেছেন। সেই লেখাটি একটি স্বনামখ্যাত ইংরেজি দৈনিকে মুদ্রিত হয়েছে। সে লেখার শিরোনাম ‘কী ধরনের পৈশাচিকদের আমরা প্রতিপালন করছি।’ তার ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকাকালীন দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, বাইরে থেকে সেসব উজ্জ্বল ছাত্ররা সেকেন্ডারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ছাত্রাবাসে বাস করত। এটা ভেবে ভয়ে কম্পিত হয়ে উঠি যখন ভাবি তাদের সম্পর্কে, যারা এখন সেখানে অস্ত্র নিয়ে বসবাস করে রুমে। আজকে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এদের মধ্যে অধিকাংশ ছাত্র অসহায়; তারা পরিস্থিতির শিকার।’ … এটা বেশি দিনের কথা নয়, বুয়েটে ছাত্র আবরারকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে তার রুমের ভেতর একটি রাজনৈতিক দলের অনুগামী অ্যাক্টিভিস্টরা। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন তোলেন, ছাত্রদের মধ্যে কি এমন সব ভয়ঙ্কর পৈশাচিকদের আমরা পৃষ্ঠপোষকতা করছি? আর তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখছি, এরা দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে।’

আসলে এমন সব নৃশংস ঘটনা লাগাতার ঘটে যাওয়ার পর আমরা লক্ষ করছি নৃশংস ঘটনার এমন খলনায়কদের নিয়ে মূল সংগঠনের নীরব নিস্তব্ধ হয়ে থাকাটা তাদের অপকর্মের প্রতি মৌন সমর্থনেরই লক্ষণ। পৃথিবীর এটাই স্বাভাবিক; ক্ষণে ক্ষণেই সব কিছুর পরিবর্তন ঘটছে অনবরত। আমরা কাল হয়তো থাকব না। এটাই দুনিয়ার চল, এখন বিভিন্ন সংগঠন সংস্থার দায়িত্বে যারা আছেন দূর ভবিষ্যতে তারাও থাকবেন না। এ বিবেচনা থেকেই সব সংগঠন, সংস্থা তাদের যোগ্য সক্ষম উত্তরসূরি তৈরির প্রক্রিয়া সবসময় জারি রাখা, তাদের মনো ছবি এমনই থাকতে হয়। এমন উদাহরণ রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। আজকের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে ৩০-৩৫ বছর আগে যারা ছিলেন, তারা তো সব কিছু উত্তরাধিকারীর হাতে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেছেন। এখন যারা রাজনৈতিক মঞ্চের পুরোধা তাদের একদিন তাদের পূর্বসূরিদের মতোই উত্তরসূরিদের কাছে সব দায়দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে। আমাদের আজকের রাজনৈতিক নেতারা তেমন প্রক্রিয়া কি শুরু করেছেন? বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল কি তাদের উত্তরসূরিদের নিয়ে ভাবছে? ঢাকা কলেজের ঘটনার পর এমন প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক। অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতোই দেশে বোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, চিন্তক এবং সেসব অগ্রসর নাগরিকের প্রশ্ন, যাদের নিয়ে সবাই স্বপ্ন দেখছেন তারা সেভাবে গড়ে উঠছে? তাদের দিয়ে তো মারদাঙ্গা বাঁধানো সম্ভব। কিন্তু দেশ গড়ার জন্য যে দূরদৃষ্টি, ধৈর্য, শৌর্য, সংযমী, নিরপেক্ষ, সক্ষম, যোগ্য, দক্ষদের ছাড়া আর কারো ওপর আস্থা রাখা কি সম্ভব?

প্রকৃতপক্ষে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যোগ্য ও সক্ষম করে গড়ে তোলার বিষয়টি দেশের নেতৃবৃন্দের কাছে কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে+তা আমাদের বোধগম্য নয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব তো আছেই। সেই সাথে সংগঠনের ভেতর দেশ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন গুণের অধিকারী হিসেবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া থাকার গুরুত্ব সমাধিক। সেই নেতৃত্ব তৈরির জন্য নিষ্ঠাবান কর্মী গড়ার অব্যাহত প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকা এবং কর্মীদের মনমগজে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দেয়ার কোনো উদ্যোগ আছে বলে আমরা জানি না। সততা নিষ্ঠার সাথে দেশের জন্য নিবেদিত হওয়ার জন্য অনেক গুণকে আয়ত্তে নিতে হয়। সেই বিষয়গুলো আমাদের মনমগজে প্রোথিত হয়ে আছে, তা বিশ্বাস ও উপলব্ধি করার কোনো যৌক্তিক কারণ তো খুঁজে পাই না। কেননা এমন কার্যক্রম বর্তমান থাকলে কিছু ‘রিটার্ন’ তো পাওয়া যেত। প্রতিটি বড় দলে গবেষণা, প্রশিক্ষণ না থাকার অর্থ হচ্ছে, তাদের পক্ষে দেশকে দেয়ার বিশেষ কোনো আকাক্সক্ষা নেই; তাদের শুধু চাই ক্ষমতা। এসব সংগঠনকে বাইরে থেকে শিখে নেয়া উচিত, তারা কোন পদ্ধতি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দলকে যোগ্য করে তোলে। আমরা বরং এমনটাই লক্ষ করি, কর্মীদের দিয়ে হুজ্জত হাঙ্গামা গোল বাঁধানো, প্রতিপক্ষকে অকারণে নিন্দা-বিদ্বেষ পোষণ করতে পারা, শায়েস্তা করতে সক্ষম অনুসারীদের বাহবা মারহাবা জ্ঞাপন করাই হয়। অথচ আজকে বিশ্বে প্রতিযোগিতা করে করে এগিয়ে যেতে সৎনীতি, নিষ্ঠা, যোগ্য সক্ষম কর্মী সমর্থকদের অবদান থাকে অনন্য। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শান্ত সমাহিত পরিবেশে সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষা গ্রহণ করে বাস্তব জীবনে এসে দেশ সেটাকে উজাড় করে দিচ্ছে। সেখানকার শিক্ষকরা জ্ঞানসমৃদ্ধ পণ্ডিত নীতিবান এবং ছাত্রদের সুশিক্ষা দিতে নিবেদিতপ্রাণ। তাই তাদের ছাত্ররা বর্তমান সময়ের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম। অবশ্যই এক দিনে সেখানে তারা পৌঁছেনি। দীর্ঘ চেষ্টা সাধনা তাদের এই জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে।

সেই সব দেশের সাথে যদি তুলনা করা হয়, তবে বলব, আমরা তো পাতালে পড়ে আছি। সম্প্রতি দৈনিক নয়া দিগন্তে বিশিষ্ট মেডিক্যাল শিক্ষাবিদ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা: মোজাহেরুল হক এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ মেডিক্যালে শিক্ষার বিভিন্ন দুর্বল দিকের বিষয় তুলে ধরেছেন। আমরা সে সাক্ষাতের কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরছি এ লক্ষ্যে যে, আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার একটা মৌলিক খণ্ডের হালহকিকত বোঝার জন্য এটা জরুরি। দেশের মেডিক্যাল শিক্ষার মান নিয়ে সেই বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কিছু সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া এখানে মেডিক্যাল শিক্ষার মান সর্বনিম্ন। মেডিক্যাল কলেজে প্রতিটি বিষয়ে প্রতি দশজন ছাত্রের জন্য সে বিষয়ে একজন করে শিক্ষক থাকতে হবে। অন্য দিকে একজন ছাত্রের জন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঁচটি বেড থাকতে হবে। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে এটা মানা হলেও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে মানা হয় না। ছাত্র অনুপাতে শিক্ষক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে তো নেই, এমনকি সরকারি মেডিক্যাল কলেজেও সে অনুপাত মানা হয় না।

মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের আধুনিক ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের জন্য ক্লিনিক্যাল স্কিল ল্যাবরেটরি স্থাপনের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মেডিক্যাল কলেজে এ ধরনের ল্যাবরেটরি নেই। প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজেও নেই। এসব কারণে আমি বলে থাকি, বাংলাদেশে মেডিক্যাল শিক্ষার মান সর্বনিম্ন। ভালো মানসম্পন্ন মেডিক্যাল কলেজের মান উন্নয়নের জন্য কী করা উচিত? জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, একটি ভালোমানের মেডিক্যাল কলেজের জন্য, তার শিক্ষকদের জন্য একটি মেডিক্যাল এডুকেশন ইউনিট থাকা উচিত। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য এ ধরনের ইউনিট থাকতে হবে, কিন্তু কোনো কোনো কলেজে নামে মাত্র এ ধরনের ইউনিট রয়েছে। শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য সব ধরনের যন্ত্রপাতি সংবলিত মেডিক্যাল ল্যাবরেটরি থাকতে হবে। প্রত্যেক মেডিক্যাল কলেজে একটি ল্যাবরেটরি থাকলেও তাতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে, তারপর আর কত মেডিক্যাল কলেজের প্রয়োজন রয়েছে? সে প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, আমাদের দেশে আর কোনো মেডিক্যাল কলেজের প্রয়োজন নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৭টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও ছয়টি ডেন্টাল কলেজ রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছয়টি মেডিক্যাল কলেজ। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি কলেজেরও স্বীকৃতি নেই। দেশের বাইরে গিয়ে বিশেষত পশ্চিমের কোনো দেশেই আমাদের এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসা করার লাইসেন্স পাবেন না। আর বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ বেশুমার।

আমাদের সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল একই রকম। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। পক্ষান্তরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি আর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক বলয়ে সুনাম রয়েছে। আরো শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং আরো এমন প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বস্তুত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান যে কতটা নিম্নমানের তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এদের বড় অবদান বলতে গেলে, কিছু ডিগ্রিধারী বেকার সৃষ্টি করা। সরকার উচ্চকণ্ঠে উন্নয়নের কথা বলছেন। শিক্ষা সেক্টরের অন্যতম একটা বিষয় হচ্ছে যোগ্য দক্ষ ‘ম্যান পাওয়ার’ জোগান দেয়া। কিন্তু এখন এ কথা বললে বেশি বলা হবে না যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান বলতে কিছু থাকুক আর না থাকুক, এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের জন্য তা মানি মেকিং মেশিন বৈ তো আর কিছু নয়। এ বিষয়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজন নিয়ে ভাবতে আর কত কালক্ষেপণ করা হবে। শিক্ষা আর তার সময়ের উপযোগিতার মধ্যে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে সব কিছুর ‘রিনোভেশন চলেছে, যা উন্নত দেশে ‘কন্টিনিউয়াস প্রসেস’, তাই তারা সব সময় আপটুডেট থাকে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমবিন্যাস-এর ধারণা চিন্তাকে এক পাশে ফেলে রেখে আমরা চলছি। তার অর্থ, কেবলই পেছনে পড়ে থাকা।

কিছুকাল আগে দেশের প্রধান নির্বাহী দেশের গবেষণা কার্যক্রমের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিলেন। আমরা মনে করি, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্বাহী আদেশ হিসেবে ধরে নিয়ে সবাই এ ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া একান্ত অপরিহার্য। গবেষণা কতটা আমাদের জন্য জরুরি উদাহরণ, তাতে আমাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এ সংক্রান্ত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম যদি পর্যালোচনা করা হয় তবে তাদের অবদান সম্পর্কে অবহিত হওয়া যাবে। দেশের যারা ঘুরেফিরে ক্ষমতায় আসেন, বললে বেশি বলা হয়তো হবে না, তাদের রাজনীতি যতটা দেশভিত্তিক তার অধিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক। ক্ষমতাভিত্তিক না হওয়ার কারণে তাদের কাছে ক্যাডারদের প্রয়োজন মূল্য যতটা, দেশের মানুষের সামগ্রিক বিষয়টা সে তুলনায় ‘সেকেন্ডারি’ হয়ে রয়েছে। ক্যাডার যে দৌরাত্ম্য, তাদের আচার অনাচার সাধারণের জন্য যত অপছন্দের আর দুর্ভোগেরই হোক না কেন ক্যাডারের আদর যত্ন করার ক্ষেত্রে এসব কোনো ধর্তব্য বিষয় নয় কর্তৃপক্ষের কাছে। এমন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ও পুনর্বিন্যাস চিন্তাটা যত দূরে সরিয়ে রাখা হবে আমাদের পিছন হাঁটার গতিটা ততই দ্রুত থেকে দ্রুততর হবে। পক্ষান্তরে এগিয়ে যাওয়া তথা সম্মুখের চলার পথটা ততই স্থবির হয়ে পড়বে। আমরা বহু কথা শুনি, ছেলে ভুলানোর মতো অনেক গল্পও শুনি। তা শুধু সব অসার বক্তব্য। এসব কথায় চমক থাকে কিন্তু তাতে গায়ে বস্ত্র, পেটে অন্ন, সব কিছু বোঝা ও জানার জন্য শিক্ষা, রৌদ্র ঝড়ে মাথার ওপর ছাউনি, অসুখে ওষুধ আর পথ্য কোনোটাই তো জুটছে না। ধৈর্য আর কত ধরতে হবে? ৫০ বছর ধরে মানুষ ধৈর্য ধরেই তো আছে। আর কতকাল ধৈর্য ধরে থাকবে? ওপরতলার লোকদের জন্য তো চিন্তা।

ndigantababor@gmail.com

Exit mobile version