Site icon The Bangladesh Chronicle

আমদানি-রপ্তানির আড়ালে পাচার হচ্ছে টাকা

আহমেদ তোফায়েল
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৩, ০৭:০১

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যেসব চ্যানেলে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মূল কারণ চিহ্নিত করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। এর মধ্যে পণ্য আমদানির সময় কাগজপত্রে বেশি দাম উল্লেখ করা। আরেকটি হচ্ছে পণ্য রপ্তানিতে কাগজপত্রে দাম কম দেখানো। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে বিশাল একটি অঙ্ক পাচার হচ্ছে।

নতুন করে রপ্তানি পণ্যের আড়ালে অর্থপাচারে তথ্য দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।  গতকাল মঙ্গলবার আইডিইবি ভবনে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম জানিয়েছেন সম্প্রতি চারটি প্রতিষ্ঠান রপ্তানি অনুমতিপত্র জালিয়াতি করে বিদেশে পণ্য রপ্তানি করে ৩৮২ কোটি টাকা পাচার করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি করা পণ্য থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আর দেশে ফেরেনি।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বলছে, ঐ চারটি প্রতিষ্ঠান হলো—সাবিহা সাইকি ফ্যাশন, এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন, ইমু ট্রেডিং করপোরেশন ও ইলহাম ট্রেডিং করপোরেশন। এসব প্রতিষ্ঠান টি শার্ট, টপস, লেডিস ড্রেস, ট্রাউজার, বেবি সেট, ব্যাগ, পোলো শার্ট, জ্যাকেট, প্যান্ট, হুডিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব ও নাইজেরিয়ায় রপ্তানি করেছে।

শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক বলেন, রপ্তানি দলিল জালিয়াতি করে বিদেশে পণ্য রপ্তানির অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত করে অর্থপাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গায় অভিযান চালিয়ে সাবিহা সাইকি ফ্যাশনের জালিয়াতির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। সেখানে সাতটি ৪০ ফিট কনটেইনারে রক্ষিত ৯টি পণ্য চালান পরীক্ষা করে ঘোষণা বহির্ভূত একাধিক পণ্য পাওয়া যায়। রপ্তানিকারকের ঘোষণা অনুযায়ী, টি শার্ট ও লেডিস ড্রেস রপ্তানির কথা। কিন্তু পাওয়া গেছে বেবি ড্রেস, জিনস প্যান্ট, লেগিংস, শার্ট, শালসহ ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য। পরে শুল্ক গোয়েন্দার চট্টগ্রামের যুগ্ম-পরিচালককে আহ্বায়ক করে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

তদন্তে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, সাবিহা সাইকি ফ্যাশন বিভিন্ন সময়ে ৮৬টি পণ্য চালান রপ্তানি করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি করা পণ্যের বিনিময় মূল্য ১৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ কোটি টাকা। পণ্যের চালানগুলোর নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তারা যে রপ্তানির অনুমতিপত্র (ইএক্সপি) দিয়েছিল, সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। একটি অনুমতিপত্র একাধিক রপ্তানির চালানে ব্যবহারের সুযোগ নেই। ফলে এসব ইএক্সপির কার্যকারিতা নেই। এতে বৈধপথে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই।

মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, তদন্তে সাবিহা সাইকি ফ্যাশনের পাশাপাশি আরো তিনটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান একই ধরনের জালিয়াতি করেছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। চারটি প্রতিষ্ঠান একই কৌশলে ১ হাজার ৭৮০টি পণ্য চালানে এমন জালিয়াতি করেছে। এসব চালানের বিপরীতে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৮ হাজার ২৬৫ মেট্রিক টন পণ্য, যার ঘোষিত মূল্য ৩৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাবিহা সাইকি ফ্যাশন ২১ কোটি টাকা, এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন ২৮২ কোটি টাকা, ইমু ট্রেডিং করপোরেশন ৬২ কোটি টাকা ও ইলহাম করপোরেশন ১৭ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, টাকা পাচার নিয়ে শুধু আলোচনাই হয়। এটা রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সরকার কোনো তথ্য প্রকাশ না করলেও প্রতি বছর মোটা অঙ্কের টাকা যে পাচার হয় এটা নিশ্চিত। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী প্রায় সবার ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তারা টাকা সরানোর চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে এ দেশে বিনিয়োগ বা টাকা রাখায় কোনো আস্থা নেই। তিনি বলেন, সুশাসন না থাকলে টাকা পাচার হবেই। টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িতরা সমাজের উঁচু স্তরের লোক। দেশে টাকা ধরে রাখার জন্য তাদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। সবার আগে দেশকে ভালো করতে হবে।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বিভিন্ন দেশের অর্থপাচার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ৪ মার্চ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। তাতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ  প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকার মতো। একটি দেশ অন্য দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি করার সময় প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে কম-বেশি দেখানো হয়। মূল্য ঘোষণার বাড়তি অংশের অর্থ বিদেশে পাচার করে দেয়া হয়। এমন তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে জিএফআই প্রতিবেদনটি তৈরি করে।

Exit mobile version