সেই একই বিতর্ক। যে আলোচনা আগের দুই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও হয়েছে, এবারও হচ্ছে। একটি সংসদ শেষ না হতে আরেক সংসদ গঠন আইনসিদ্ধ কিনা, সেই পুরোনো প্রশ্ন আবারও উঠেছে। আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এ বিতর্ক। সংসদ সচিবালয় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দশম ও একাদশ সংসদের শুরুতে একই আসনের দুই সংসদ সদস্য (এমপি) একই সময়ে বেতন-ভাতাও পেয়েছেন।
আইন বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, এখানে সাংবিধানিক কোনো জটিলতা নেই। তবে প্রচলিত রীতি বদলের সুযোগ রয়েছে। বিদায়ী সংসদের মেয়াদে নতুন সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের প্রয়োজন ছিল না। দ্বাদশ সংসদের যাত্রা শুরুর পরই নতুন সরকার গঠন করলে বিষয়টি শোভনীয় হতো।
সম্প্রতি আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল হকও বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ থাকা অবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচিত এমপিদের শপথ-সংক্রান্ত সব বিষয় সাংবিধানিকভাবে হয়েছে। তারপরও নীতিনির্ধারকরা সংবিধানের এ-সংক্রান্ত বিষয়ে স্পষ্ট করার প্রয়োজন মনে করলে উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে সংবিধানে অস্পষ্টতা কোথায়, তা তিনি উল্লেখ করেননি।
সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ হিসেবে পাঁচ বছর মেলানো কঠিন হবে। কারণ, ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি একাদশ সংসদের ২৯১ এমপি শপথ নেন। আর দ্বাদশ সংসদে ২৯৮ এমপি শপথ নেন গত ১০ জানুয়ারি। সংসদের (অর্থ শাখা-২) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এমপিদের বেতনের ক্ষেত্রে এতদিন তারা নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনের শুরুর দিন থেকে পাঁচ বছর হিসাব করেছেন। ২০২৩ সালের ১ আগস্ট আপিল বিভাগের রায়ের পরে স্পিকারের অফিস থেকে নতুন কোনো নির্দেশনা এখনও তারা পাননি।
সংসদ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নবম সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনে একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠনের চেষ্টা ছিল। প্রয়াত সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান এবং প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারম্যান করে ওই কমিটি গঠন করা হয়। যদিও নবম সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল বিএনপি ও জামায়াত কমিটিতে নামই দেয়নি।
সংবিধান সংশোধনে গঠিত ওই কমিটি দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সাবেক বিচারপতিসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মতামত নেয়। ওই কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশর ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সমকালকে বলেন, সংবিধান সংশোধনে গঠিত ওই কমিটি আদালতের নির্দেশনা এবং বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে। তখন সংবিধানের প্রায় প্রতিটি অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করা হয়। এ বিষয়ে ওই সময় কোনো বিতর্ক ওঠেনি।
নবম থেকে দ্বাদশ– চার সংসদেরই সদস্য রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর শেষ হওয়ার পরের ৯০ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান ছিল। এরপর বাহাত্তরের সংবিধান অনুসরণ করা হয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানেও একটি সংসদের মেয়াদ থাকতেই আরেকটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ছিল। তিনি বলেন, একই আসনের জন্য দু’জন এমপির বেতন-ভাতা পাওয়ার বিষয়টি আমি এখন মনে করতে পারছি না। কারণ, আমার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি।
একই সময়ে দুটি সংসদ নিয়ে বিতর্ক আদালতেও গড়িয়েছে। এ-সংক্রান্ত আদালতের রায় নিয়ে সম্প্রতি মন্তব্য করায় গত ২৩ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের বিএনপিপন্থি আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে সতর্ক করেছেন আপিল বিভাগ। নতুন সংসদ সদস্যদের শপথকে ‘অসাংবিধানিক’ ব্যাখ্যা দেওয়া ও এ-সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়ে ‘অস্পষ্টতা রয়েছে’ মর্মে তিনি গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছিলেন। ওই আইনজীবীর উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ বলেছেন, আপিল বিভাগের রায়ের ব্যাখ্যা দেওয়ার আপনি (মাহবুব উদ্দিন) কে? ব্যাখ্যা দেবে শুধু সুপ্রিম কোর্ট। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোনো রায়ের বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকলে রিভিউ করতে পারেন। পাবলিকলি রায় নিয়ে এসব কী বলে বেড়ান? এভাবে বলতে পারেন না।’
একাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৯৯ সংসদ সদস্যের শপথ ও এমপি হিসেবে পদে থাকার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী হাইকোর্ট বিভাগে রিট করেন। ওই রিটে যুক্তি দেওয়া হয়, দশম সংসদ নির্বাচন হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। সে কারণে দশম সংসদের মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। তবে একাদশ সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা আগের সংসদের মেয়াদ পূরণের আগেই ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি শপথ নিয়েছেন। ফলে ওই সময়ে জাতীয় সংসদের সদস্যসংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৬০০ (সংরক্ষিত মহিলা আসন ছাড়া), যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক; দুটি সংসদের অস্তিত্ব একসঙ্গে থাকতে পারে না। আদালত রিট পিটিশনটি সরাসরি খারিজ করে দেন। রিটকারী রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যান। সম্প্রতি আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতিসহ আট সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ওই মামলার শুনানি হয় এবং ২০২৩ সালের ১ আগস্ট মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ সমকালকে বলেন, সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আগের সংসদের মেয়াদ পূরণের আগে নতুন সংসদের যাত্রা শুরুর সুযোগ নেই। এমন নজির প্রতিবেশী দেশ ভারতেও রয়েছে। সেখানেও মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে তারা শপথ না নিয়ে আগের সংসদের মেয়াদ পূরণের জন্য অপেক্ষমাণ থাকে। এমনকি ভারতে এমন নজির রয়েছে, নতুন সংসদের ভোটের পরও আগের সংসদের অধিবেশন বসেছে। পরাজিত এমপিরা ওই অধিবেশনে অংশ নিয়েছেন।
অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদের মতে, নির্বাচনের পরে আগের সংসদের মেয়াদ পূরণের জন্য নতুন সংসদ অপেক্ষমাণ থাকাবস্থায় নতুন সরকার গঠন জরুরি ছিল না। ১০ জানুয়ারি এমপিদের শপথ নেওয়ার পরই ১১ জানুয়ারি সরকার গঠন করা হয়েছে। নতুন সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ ৩০ জানুয়ারির পরে অর্থাৎ দ্বাদশ সংসদের যাত্রা শুরুর পরে করা যেত। কারণ সংবিধানেই নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিয়ে রেখেছে।
সংসদের মেয়াদ সম্পর্কে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭২(৩)-এ উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি আগে ভেঙে না দিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর পার হওয়ার পরে সংসদ ভেঙে যাবে। একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সে হিসেবে একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি।
গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ৯ জানুয়ারি গেজেট প্রকাশ করা হয়। ১০ জানুয়ারি নতুন এমপিরা শপথ নেন। ১১ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভার শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে।
সূত্র : সমকাল