Site icon The Bangladesh Chronicle

আড়ালে থেকেও বাংলাদেশের ক্রিকেটের বড় চরিত্র তাইজুল ইসলাম

তাইজুল ইসলাম। – ছবি : সংগৃহীত


তাইজুল ইসলাম এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টেস্ট উইকেট শিকারি। তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে কম সময়ে ১৫০টি টেস্ট উইকেট নিয়েছেন।

শনিবার ছয় উইকেট পাওয়ার পর তাইজুল ইসলামকে নিয়ে এই আলোচনাও হয়েছে যে, প্রথম টেস্টে তিনি দলে থাকলে ডারবান টেস্টের ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো।

ডারবানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসে কেশভ মহারাজের সাত উইকেটও একইদিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এবার পুরো ৫০ ওভার বল করে ১৩৫ রান দিয়ে ৬ উইকেট নেয়ার পর তাইজুল ইসলামকে নিয়ে আবারো আলোচনা হচ্ছে।

তাইজুল যে নিজের দক্ষতা নিয়ে কাজ করেন তার প্রমাণ মাঠেই পাওয়া যাচ্ছে, বলছেন বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগের ক্রিকেটার ও ক্রিকেট বিশ্লেষক সৈয়দ আবিদ হুসাইন সামি।

তাইজুলকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে ‘আন্ডাররেটেড চরিত্র’ বলে আখ্যা দিয়েছেন হুসাইন।

‘টেস্টে এমন একজন স্পিনার লাগে যিনি দীর্ঘসময় বোলিং করতে পারবেন। কিন্তু দেশের বাইরে এমন একজন ক্রিকেটারকেই বাংলাদেশ বাইরে রাখে শুধুমাত্র রক্ষণাত্মক মানসিকতার কারণে।’

তবে তাইজুল ঘরের বাইরেও বল টার্ন করানো নিয়ে কাজ করছেন, বলছেন এই ক্রিকেট বিশ্লেষক।

বাংলাদেশের উইকেটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যেটা দেখবেন স্পিনারদের কাজের বড় অংশই উইকেট করে দেয়। এতে যেটা হয় স্পিনারদের তুলনামূলক ধীরে বল করলেই হয়।’

কিন্তু দেশের বাইরে শুধু উইকেট থেকে তেমন সুবিধা পাওয়া যায় না। সেখানে জোরের ওপর বল করে টার্ন আদায় করতে হয়। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত খেলেন সৈয়দ আবিদ হুসাইন সামি, তার মতে মেহেদী হাসান মিরাজ যখন ঢাকায় বা চট্টগ্রামে বল টার্ন করাতে চান তখন খানিকটা ধীরে বল করতে হয়, এতে যথেষ্ট গ্রিপ পাওয়া যায় মাটি থেকে।

তবে তাইজুল বিদেশের মাটিতেও ভালো করার জন্য বাড়তি অনুশীলন করেছেন বল হাতে, বিদেশের মাটিতে জোরের ওপর বল করেছেন এবং তার ফলও পেয়েছেন তাইজুল।

২০০৮ সালে সাকিব আল হাসান ৯৯ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদের মাটিতে সেটাই বাংলাদেশের কোনো বোলারের সেরা বোলিং ফিগার।

তখন সাকিবের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার মাত্র দেড় কি দুই বছরের, সাকিব ব্লুমফন্টেইনে পাঁচটি এবং সেঞ্চুরিয়নে এক ইনিংসে ছয়টি উইকেট নিয়েছিলেন, হাশিম আমলা, জ্যাক ক্যালিস, মার্ক বাউচারদের বিপক্ষে।

গত বছর পাঁচেক ধরেই সাকিব আল হাসান টেস্ট ক্রিকেটে নিয়মিত নন। এই সময়টায় সাকিবের অভাব পূরণ করতে তাইজুল ইসলামের বিকল্প নেই বাংলাদেশের স্কোয়াডে।

কিন্তু সৈয়দ আবিদ হুসাইন সামির মতে, বাংলাদেশ কখনো কখনো বিদেশের মাটিতে এতোটাই রক্ষণাত্মক চিন্তা করে যে ৭ জন ব্যাটসম্যান খেলাতে গিয়ে তাইজুলকে বাদ দিয়েই দল গড়ে।

এর ফল বাংলাদেশ ডারবানে পেয়েছে, শেষ পর্যন্ত আরো একজন স্পিন বোলারের অভাব বোধ করেছেন অধিনায়ক মুমিনুল হক।

এক নজরে তাইজুল ইসলাম
তাইজুল এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেটে লংগার ফরম্যাট ক্রিকেটার হিসেবেই পরিচিত। ২০১১ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা শুরু করেন, বাংলাদেশের জার্সি গায়ে প্রথম ম্যাচ খেলেছিলেন ২০১৪ সালে।

মাঠে নামার তৃতীয় ম্যাচেই ৩৯ রানে ৮ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল বোলিং ফিগার অর্জন করেন তিনি।

৩৬তম টেস্টেই তিনি ১৫০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন।

সাকিব আল হাসান, যিনি এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি, তিনি ৪৩তম টেস্টে ১৫০ উইকেট নিয়েছিলেন।

নাটোরের তাইজুল রাজশাহীতে লিগ খেলা শুরু করেন।

টেস্ট ক্রিকেট নিয়মিত খেললেও এখননো পর্যন্ত মাত্র দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ এবং মাত্র ৯টি ওয়ানডে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন তিনি।

বাংলাদেশে কেবল টেস্ট ক্রিকেটার হওয়াটা কষ্টের
বাংলাদেশে কেবলমাত্র টেস্ট ক্রিকেটার হলে বছরের একটা বড় সময় খেলাধুলার বড় সুযোগ-সুবিধার বাইরে থাকতে হয় ক্রিকেটারদের, অন্য ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট এমনিতেই কম খেলে।

যেমন ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক মুশফিকুর রহিমের পরে টেস্টে অভিষিক্ত হয়েছিলেন, কুক অবসরে গেছেন সাড়ে তিন বছর হয়ে গেছে।

মুশফিকুর রহিম তার ৮০তম টেস্ট ম্যাচ খেলছেন, আর কুক খেলেছেন ১৬১টি টেস্ট ম্যাচ।

অ্যালিস্টার কুক এখনো কাউন্টি দল এসেক্সের হয়ে ঘরোয়া লম্বা দৈর্ঘ্যের ফর‍ম্যাট ক্রিকেট চালিয়ে যাচ্ছেন, চলতি সপ্তাহেও সেঞ্চুরি করেছেন।

কিন্তু বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেটে টেস্ট খেলোয়াড় হয়ে ওঠার উপাদানগুলো অনুপস্থিত।

তাই শুধু টেস্ট ক্রিকেটার যারা, তারা নিজ আগ্রহেই তাইজুলের মতো নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করেন।

উদাহরণ হিসেবে হুসাইন বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেকটাই ঢাকা নির্ভর, এমনকি ঢাকাতেও একজন পেশাদার ক্রিকেটারের যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া উচিৎ তা নেই। মাস্কো সাকিব ক্রিকেট একাডেমি হওয়ার পর সেখানে কিছু ক্রিকেটার বিভিন্ন লেভেলে অনুশীলন করেন। সেখানে কিছু সুযোগ সুবিধা আছে যা জাতীয় পর্যায়ে নেই।’

টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে ভাবনা নেই
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ বরাবরই গড়পড়তার চেয়ে নিচু মানের ক্রিকেট খেলছে, মাঝেমধ্যে কিছু জয় আসে ব্যক্তিনির্ভর দক্ষতায়, কিন্তু দল হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটের মেজাজটা ধরতে পারছে না।

বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার সাথিরা জাকির জেসি বলেন, দেখেন বাংলাদেশের ডারবানে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে যেটা হয়েছে সেটা কিন্তু নিয়মিত ঘটনা।

মুমিনুল হক এর বড় উদাহরণ। বাংলাদেশের ক্রিকেটে অপার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিনে মুমিনুল হক।

তাকে মনে করা হতো বাংলাদেশের পরবর্তী ব্যাটিং স্তম্ভ। কিন্তু তিনি এতোটাই অনিয়মিত ব্যাটিংয়ে যে তার অধিনায়কত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে ইদানিং।

সাথিরা জাকির জেসি মনে করেন, টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে সিনিয়র ক্রিকেটারদেরও নিয়মিত পাওয়া যায় না। মুশফিক ফর্মে নেই, তিনি শেষ শতক হাঁকিয়েছেন দুই বছর আগে।

এছাড়া তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান টেস্ট ক্রিকেটে প্রায়ই খেলছেন না।

এমনকি একটা সময় সিনিয়র ক্রিকেটারদের একটা বড় অংশ অধিনায়কত্বই নিতে চাননি, তখন বোর্ড বাধ্য হয়ে তুলনামূলক সহজ অপশন হিসেবে মুমিনুল হককে অধিনায়কত্ব দেন।

কিন্তু তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটা টেস্ট জয় ছাড়া বাকি ম্যাচগুলোতে খারাপ পারফর্ম করেছে।

অনেক ম্যাচেই ৫০ রানের মধ্যেই চার উইকেট খুইয়েছে।

সাথিরা জাকির জেসি মনে করেন, বাংলাদেশ চতুর্থ ইনিংসে বরাবরই এমন নাজুক ব্যাটিং করে আসছে।

এতে করে অনেক সময় তাইজুল, মিরাজ, ইবাদত, খালেদরা বোলিংয়ে যেই সাফল্য পায় সেটার ফল নেয়া সম্ভব হয় না।

ডারবান টেস্টে হারের পর বাংলাদেশের ফেসবুক সেলিব্রিটি রাসয়াত রহমান জিকো নিজের একটি ফেসবুক পোস্টে মজার ছলে লিখেছিলেন, ‘বোলারদের ভালো বোলিংয়ের কারণে ড্র হতে যাওয়া টেস্টটি হেরে গেল বাংলাদেশ।’

সূত্র : বিবিসি

Exit mobile version