এদিকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা শনিবার সন্ধ্যায় গণভবনে অনুষ্ঠিত এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে দলীয় নেতাকর্মীকে রাজপথে সর্বাত্মক অবস্থানের নির্দেশনা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের তিন নেতার সঙ্গে ওই বৈঠককালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে উস্কানিদাতা মন্ত্রীদের দ্রুত মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীকে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ১৪ দলীয় জোটের পাঁচ নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে গতকাল দিনভর তৎপর ছিলেন তারা। নিজেদের মধ্যে তারা বৈঠক করেছেন। তবে গতকাল রাত পর্যন্ত আলোচনায় বসার জন্য সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুরো দেশ উত্তাল থাকার পরিস্থিতিতে শনিবার বিকেলে আওয়ামী লীগের পরবর্তী কর্মসূচির কথা জানা যায়। রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি জানান, আওয়ামী লীগ রোববার (আজ) সারাদেশে জমায়েত ছাড়াও সোমবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন পর্যন্ত শোক মিছিল করবে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ শোক মিছিল করবে তারা। যদিও এর আগেই শুক্র ও শনিবার রাজধানীতে শোক মিছিলের কর্মসূচি দিলেও পরে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং প্রবল বর্ষণের কারণে তা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছিল।
পরিস্থিতি মোকাবিলার পদক্ষেপ জানালেন প্রধানমন্ত্রী
গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এবং জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথমে মেনন ও বাদশা, পরে ইনুর সঙ্গে পৃথক বৈঠকে দেশের বিদ্যমান সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন তিনি।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, ১৪ দলীয় জোটের নেতা রাশেদ খান মেনন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উস্কানি দিয়ে সহিংসতার পথে ঠেলে দেওয়ার জন্য দায়ী মন্ত্রীদের সরিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি অবশ্য কোনো মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করেননি। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছু বলেননি।
বৈঠকে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা বিষয়েও জানতে চান ১৪ দল নেতারা। জবাবে তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। আর মাঠের পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। রোববার কর্মসূচি পালনকালে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী যাতে সর্বাত্মকভাবে রাজপথে থাকেন, সেজন্য নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। তবে প্রধানমন্ত্রী এ-ও বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি সহনশীলতার সঙ্গে মেনে নিয়েছেন তিনি। শিক্ষার্থীরা যেন হয়রানির শিকার না হন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন খুলে দেওয়া যায়, সে বিষয়ে চেষ্টা করছেন।
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন জানিয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান আরও বলেন, আলোচনার জন্য শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। তারা তো আলোচনায় এলো না। এখন দেশে যে পরিস্থিতি চলছে, তা থেকে উত্তরণে জাতীয় সংহতি রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
পুলিশকে ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ঢুকে যারা সন্ত্রাস-সহিংসতা করেছে, তাদের প্রধান টার্গেট পুলিশ। তারা তো পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছে, পুলিশকে হত্যা করেছে। আজও (গতকাল) তারা গাজীপুরে মাওনায় পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়েছে। এর পরও পুলিশকে ধৈর্য ধরতে আহ্বান জানাই।
বৈঠক শেষে রাশেদ খান মেনন সমকালকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের কোটা আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে। পরিস্থিতি উত্তরণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা বলেছি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নিয়েছেন এবং তাদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করছেন। তাদের যদি কোনো দাবি পূরণ হওয়া বাদ থাকে, সেগুলোও মেনে নেবেন তিনি। মেনন বলেন, এমনকি তারা (আন্দোলনকারীরা) এক দফা দাবি নিয়ে আলোচনা করতে চাইলেও প্রধানমন্ত্রী রাজি আছেন বলে জানিয়েছেন।
সমন্বয়কদের আলোচনায় বসাতে তৎপরতা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আলোচনায় বসাতে গতকাল তৎপর ছিলেন আওয়ামী লীগসহ জোটের নেতারা। আলোচনার জন্য আওয়ামী লীগের তিন নেতার পাশাপাশি ১৪ দলের শরিক দুই নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের তিন নেতা হচ্ছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। ১৪ দলের অন্য শরিকদের মধ্যে যুক্ত হয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। পাঁচ নেতা শনিবার নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছেন। আওয়ামী লীগের তিন নেতা সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার এরই মধ্যে আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। শনিবার গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘এখন আর আলোচনার সুযোগ নেই। সিদ্ধান্ত আসবে রাজপথ থেকে।’
গত শুক্রবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দলের তিন নেতাকে দায়িত্ব দেন। এ আলোচনায় ১৪ দলের নেতাদেরও যুক্ত করার জন্য নির্দেশনা দেন তিনি।
সূত্র জানায়, গতকাল সকালে রাশেদ খান মেননের ন্যাম ফ্ল্যাটের বাসায় বৈঠকে বসেন পাঁচ নেতা। এ সময় মেনন ও ইনু আওয়ামী লীগের তিন নেতাকে সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আলোচনার সময় ও স্থান নির্ধারণের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন। বৈঠকে মেনন ও ইনু উভয়েই সমন্বয়কদের সঙ্গে যে কোনো আলোচনার জন্য প্রস্তুত আছেন বলেও জানান।
রাশেদ খান মেনন সমকালকে বলেন, আমরা তো আগে থেকেই আলোচনার আহ্বান জানিয়েছি। তবে জানতে পারলাম, সমন্বয়করা আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই অবস্থায় দেখা যাক আলোচনার সুযোগ হয় কিনা।
এদিকে, আলোচনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের তিন নেতা গতকাল সন্ধ্যায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কর্মপন্থা ঠিক করেছেন। ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ নিয়ে আলোচনা করেন তারা। এ সময় দলের অন্য কেন্দ্রীয় নেতারাও ছিলেন। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে কারও সঙ্গেই যোগাযোগ হয়নি আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাদের।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনায় বসার অগ্রগতি প্রসঙ্গে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আমরা তো সারাদিনই এটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি। কাজেই বিষয়টিতে অগ্রগতি তো অবশ্যই আছে। সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যোগাযোগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আশা করি, সমন্বয়কদের সঙ্গে দ্রুতই যোগাযোগ করতে পারব।
সমকাল