- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৫৭
বাংলাদেশে আজ থেকে ৫০ বছর পর অর্থাৎ ২০৭৩ সাল নাগাদ দেশের জনসংখ্যা হতে পারে ২০ কোটি ৩০ লাখ। জাতিসঙ্ঘের করা বিশ্ব জনসংখ্যা প্রক্ষাপনের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যার এমন ধারণা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০৫৭ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৭ লাখের কিছু বেশি। সোমবার বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের তথ্য যাচাই বাছাইয়ের পর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস বলছে, এর আগে বিবিএসের জরিপে ৪৫ লাখের বেশি মানুষ বাদ পড়েছিল। সেগুলো যোগ করে বর্তমানে এই জনসংখ্যার পরিমাণ ১৬ কোটি ৯৭ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে।
এর কারণ হিসেবে বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, গ্রামের দিকে জনসংখ্যার হিসেবে ভুল কম হলেও নগরে এই ভুলের সংখ্যা বেশি। কারণ গ্রামের মানুষ সহজে তথ্য দিলেও শহরের বাসিন্দাদের কাছ থেকে অনেক সময় তথ্য পাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে।
কেমন হবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি বলা হলেও জাতিসঙ্ঘের প্রক্ষেপণ মডেল অনুযায়ী এই সংখ্যা আরো বেশি।
জাতিসঙ্ঘের প্রক্ষেপণ মডেল অনুযায়ী, বাংলাদেশে মধ্যম মেয়াদী প্রক্ষেপণ ধরা হয় এবং তা অনুযায়ী এখন থেকে ২৭ বছর পর ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৪০ লাখ।
জাতিসঙ্ঘের প্রক্ষেপণ মডেল অনুযায়ী এখন থেকে ৫০ বছর পর জনসংখ্যা কমবে। এই সংখ্যা হবে ২০ কোটি ৩০ লাখ।
কিন্তু কিভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম জানান, বর্তমানে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তা আরো ৩৪ বছর অব্যাহত থাকবে। ২০৫৭ সালে জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৭০ লাখ।
এটা হবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পিক বা সর্বোচ্চ সংখ্যা। পরের সাত বছর ধরে জনসংখ্যার এই ধারা স্থিতিশীল থাকবে। এর পরের বছর গিয়ে আবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধারাটিতে পরিবর্তন আসবে।
তার মতে, তখন থেকে জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। ২০৬৯ সাল নাগাদ জনসংখ্যা ২০ কোটি ৫০ লাখ এবং ২০৭১ সালে ২০ কোটি ৪০ লাখ হবে। এভাবে কমতে কমতে ২০৭৩ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০কোটি ৩০ লাখ। তবে ওই সময় বাংলাদেশে যুবকদের তুলনায় বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, বাংলাদেশ ২০৩৫ সাল নাগাদ বয়স্ক জনগোষ্ঠীর দিকে যাবে।
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, ১৫-৬৪ বছর বয়সীদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হিসেবে ধরা হয়। এ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য ২০৩৭-৩৮ সাল পর্যন্ত হবে অনুকূল সময়। অর্থাৎ এ সময় পর্যন্ত দেশে কর্মক্ষম মানুষ বেশি থাকবে। এর পর থেকে এই সংখ্যা কমতে শুরু করবে এবং বয়স্কদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করবে। আর কমে যাবে তরুণদের সংখ্যা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ২০৪৭-৪৮ সাল নাগাদ বয়স্ক মানুষের সমাজে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে জাপানে এমন একটি অবস্থা চলছে বলে জানান তিনি।
জনসংখ্যা কেন কমবে?
জনসংখ্যা বেড়ে তারপর একটি নির্দিষ্ট সময় পর তা আবার কমে যাওয়ার এই ধারাটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের আরো অনেক দেশেই এমন চিত্র দেখা গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চীনের কথা। চলতি বছর চীনে গত ৬০ বছর পর প্রথমবারের মতো জনসংখ্যার কমতি হার দেখা গেছে। দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, চীনে গত বছরের তুলনায় প্রায় আট লাখের মতো মানুষ কমেছে।
এছাড়া গ্রিস, পর্তুগাল, জাপান, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, ইতালি এবং ইউক্রেনেও জনসংখ্যা কমছে। যদিও ইউক্রেনে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে জনসংখ্যা কমছে।
জনসংখ্যার এমন পরিস্থিতি হওয়ার কারণ হিসেবে মঈনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে জনসংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হবে জন্মহার কমে যাওয়া। যাকে টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা মোট প্রজনন হারও বলা হয়। অন্যদিকে স্থূল মৃত্যুহারও বেড়ে যাবে। ফলে সব মিলিয়ে জনসংখ্যার হার কমে যাবে।
তার মতে, মৃত্যুহার বাড়ার একটি বড় কারণ হবে তখন সমাজে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। মূলত জন্মহার, মৃত্যুহার এবং স্থানান্তর বা অভিবাসন এই তিনটি বিষয় একটি দেশের জনসংখ্যার আকার নিয়ন্ত্রণ করে।
জনসংখ্যা পরিমিতি নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মহার কমে যাবে কারণ ওই সময়ে গিয়ে মানুষের প্রজনন হার কমবে। কারণ সেসময় মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র বাড়বে, অণু পরিবার বা একক পরিবারের সংখ্যা বাড়বে, জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়বে। যার কারণে মানুষ সন্তান জন্মদানে কম আগ্রহী হবে।
তাার বলছেন, এছাড়া নারীরা যদি বাইরের কাজে যুক্ত হয় এবং পড়াশুনাসহ নানা কারণে কম বয়সে বিয়ে না করে তাহলে তাদের প্রজননের যে সময় সেটিও কমে আসে। যার কারণে সন্তান জন্মদানের হারও কমে আসে।
তবে এই সবই নির্ভর করবে যে, সেই সময়ে সমাজে কী ধরণের সংস্কৃতি প্রচলিত থাকে তার উপর। যার মধ্যে রয়েছে বিয়ের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া, সন্তান জন্মদানে আগ্রহ কমে যাওয়া ইত্যাদি।
চীন, সিঙ্গাপুর ও জাপানে বর্তমানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানান মঈনুল ইসলাম। সেখানে দম্পতিদের সন্তান জন্মদানে উৎসাহিত করার জন্য নানা ধরণের প্রণোদনা দিয়ে আগ্রহী করা যাচ্ছে না।
আবার লিঙ্গানুপাত বাড়লে অর্থাৎ কোনো একটি সময়ে কোনো একটি দেশে যদি কোনো এক লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় বা কমে যায় সেটিও জনসংখ্যার কমতির উপর প্রভাব রাখে।
উদাহরণ হিসেবে পপুলেশন সায়েন্সের এই শিক্ষক বলেন, ছেলে শিশুর প্রত্যাশায় পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা অনেক বেশি কমে গেলে তাও জনসংখ্যার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তবে উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে আফ্রিকা অঞ্চলে যেখানে বর্তমানে জনসংখ্যার বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।
বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, জনসংখ্যার এই দিকগুলো এক বছর সময়ে ব্যাপ্তিতে নির্ভুলভাবে করা সম্ভব হলেও দীর্ঘ সময়ে তা নির্ভুলভাবে বলা কঠিন।
কারণ দীর্ঘ সময়ে নানা ধরণের পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। যেসব নিয়ামক এসব পরিস্থিতি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে তা বেশিরভাগ সময়েই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না বলে মনে করেন এই গবেষক।
সূত্র : বিবিসি