Site icon The Bangladesh Chronicle

আকু’র লেনদেনে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও

কূটনৈতিক রিপোর্টার

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন বা আকু’র লেনদেনে যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোল (ওএফএসি) যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তার প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও। এমনটাই আশঙ্কা করছেন বহুপক্ষীয় অর্থনৈতিক বিষয়াবলী দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশি কর্মকর্তারা। তাদের মতে, ওএফএসি’র ওই নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে ভারতের ব্যাংকগুলো দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বা আরবিআইয়ের দ্বারস্থ হয়েছে। ভারত, বাংলাদেশ ছাড়াও ভুটান, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা আকু’র সদস্য। ভারতীয় ব্যাংকারদের বরাতে দেশটির প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম ইকোনমিক টাইমস জানায়, আকু’র লেনদেন বিশেষত অর্থ পরিশোধ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখতে সব সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোল (ওএফএসি)। আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে ১৯৭৪ সালের ৯ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা এসকাপের উদ্যোগে আকু গঠিত হয়। এর প্রধান কার্যালয় ইরানের রাজধানী তেহরানে। ভারতের সঙ্গে আকু’র সদস্য দেশগুলোর লেনদেনের ভিন্ন মাধ্যম নেই। সে কারণে ভারতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আরবিআইয়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। তারা এই সমস্যার সমাধান চায়।

তবে ইকোনমিক টাইমস এ বিষয়ে আকু ও আরবিআইয়ের মন্তব্য চাইলেও সাড়া মিলেনি।

রিপোর্ট মতে, ভারতের সমস্যা হলো দেশটি আকু’র সদস্য দেশগুলোতে যত পণ্য রপ্তানি করে, তাদের কাছ থেকে আমদানি করে কম। সে কারণে ভারতের বড় অঙ্কের অর্থ আটকা পড়ে গেছে। ২০২০ সালে আকু’র মাধ্যমে ভারতের লেনদেন হয়েছে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৮৪০ কোটি ডলার। এ বাস্তবতায় ২০২২ সালে আরবিআইয়ের এক প্রতিবেদনে ভিন্ন প্রস্তাব দেয়া হয়। তারা রুপির আন্তর্জাতিকীকরণের অংশ হিসেবে আকু’র সদস্য দেশগুলোর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের পরামর্শ দেয়। ভারতের এক সরকারি কর্মকর্তা ইকোনমিক টাইমসকে জানান, আকু ইতিমধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের দিকে যাচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য প্রভাব ঠেকাতে ইতিমধ্যে একক মুদ্রার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে আকু’র সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যমত হয়েছে।  সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে ইকোনমিক টাইমসের রিপোর্টে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্দেশনার কারণে ভারত ভুক্তভোগী হতে পারে। বাংলাদেশ, ইরান সহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আছে, সেটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। আকু হচ্ছে একটি আন্তঃআঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিকারী সংস্থা। এর মাধ্যমে আন্তঃআঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তি হয়। আকু’র মাধ্যমে লেনদেনের সুবিধা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে লেনদেনের পুরো অর্থ পরিশোধ করতে হয় না, বরং পরস্পরের কাছে তাদের ঠিক কী পরিমাণ দেনা আছে, তা বাদ দিয়ে বাকি অর্থ পরিশোধ করে তারা। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে আকু’র সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক লেনদেন আরও জটিল হয়ে যেতে পারে।

ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেন কেন হচ্ছে: এদিকে চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে ভারতীয় রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য নিষ্পত্তি কার্যকর করার মানসে ন্যাশনাল পেমেন্ট করপোরেশন অব ইন্ডিয়া (এনপিসিআই) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে ডিজিটাল পেমেন্ট মেকানিজমগুলোয় সহযোগিতার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক সই হয়। অবশ্য সমঝোতা সইয়ের আগে থেকেই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে রুপিতে লেনদেন চলছে। চলতি বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে রুপির ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারত থেকে বছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। বিপরীতে দুই বিলিয়ন বা দুইশো কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। আর শুধুমাত্র এই রপ্তানির অঙ্কটাই রুপিতে লেনদেন করা যাবে, এর বাইরে আমদানির বাকি অর্থ শোধ করতে হবে ডলারে। কিন্তু রুপিতে লেনদেনের এই ব্যবস্থা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কতোটা কাজে আসছে? এমন প্রশ্ন রেখে বিবিসি বাংলার এক রিপোর্টে বলা হয়, ব্যবসায়ীরা মনে করেন, রুপিতে লেনদেনের ব্যবস্থা হওয়ায় আপাতত তাদের ডলার নির্ভরতায় খুব কম পরিমাণে হলেও চাপটা কিছুটা কমেছে। এ ব্যবস্থা কিছুটা হলেও তাদের জন্য ডলারের একটা বিকল্প তৈরি হয়েছে। তবে এর পুরো সুবিধা নিতে ভারতে রপ্তানি আরও বাড়াতে হবে। প্রথমবারের মতো রুপিতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রাণ গ্রুপ ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড-ইবিএলের মাধ্যমে লেনদেন করে। ইবিএলের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ শাহীন নতুন ব্যবস্থাকে একটি ‘ব্রেকথ্রু’ বলে বর্ণনা করেন।

বলেন, খুব সামান্য পরিমাণ হলেও এটা ডলার থেকে বের হওয়ার একটা সুযোগ। তার মতে, বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশের উপরে লেনদেন হয় ডলারে। এখন পরিবর্তিত বৈশ্বিক অবস্থায় এটার একটা বিকল্প দরকার। আবার হঠাৎ করে ডলার থেকে সরা যাবে না। সেক্ষেত্রে এটা (রুপিতে লেনদেন) একটা উইন্ডো ওপেন হলো বলা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বিবিসিকে বলেন, প্রথমে দুটি, পরে বাংলাদেশের আরও দুটি ব্যাংকে ভারতের ব্যাংক ভস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খোলে এবং আরও বেশক’টি ব্যাংক এক্ষেত্রে পাইপলাইনে আছে। জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের এক রিপোর্টে বলা হয়, এশিয়ান ক্লিয়ারিং সিস্টেমের (আকু) মাধ্যমে এশিয়ার দেশগুলো তাদের আমদানি-রপ্তানি দায় পরিশোধ করে। সেখানে ডলার মধ্যস্থতাকারী মুদ্রা। কিন্তু সেটা থাকলেও এর অধীনেই দুই দেশ তাদের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করতে পারে।

যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন মনে করেন, কারেন্সি বাস্কেটের বাইরে যেকেনো দুই দেশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দুই দেশের মুদ্রায় লেনদেন করতে পারে। কিন্তু সেখানে দেখার বিষয় ট্রেড ব্যালেন্স কেমন। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও চীনের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি আছে। চীনে ও ভারতে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলার করে রপ্তানি করে। কিন্তু প্রতিটি দেশ থেকে আমদানি করে ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আমাদের পক্ষ থেকে ওই দুই দেশে যা রপ্তানি হয় তার বিবেচনায় অনেক বেশি আমদানি হয়। ফলে দুই দেশের মধ্যে যদি ওই পরিমাণ নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন হয় তাতে বাংলাদেশের তেমন লাভ নেই।  স্মরণ করা যায়, ডলার সংকটের সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিনে দিনে কমছে। এ অবস্থায় এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধে বাংলাদেশকে সতর্কতার সঙ্গে পথ চলতে হচ্ছে বহুদিন ধরে।

 

Exit mobile version