Site icon The Bangladesh Chronicle

আওয়ামী জাল পরিসংখ্যানে ভর করে এলডিসি উত্তরণ

সৈয়দ মিজানুর রহমান ও ইসমাঈল হোসাইন সোহেল
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮: ২১

আওয়ামী আমলের ভুয়া পরিসংখ্যান ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের ওপর ভর করেই স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে শেখ হাসিনা দেশের অর্থনীতি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়েছিলেন, যা তার আমলেই প্রকাশ্যে আসে।

এখন সেই জাল পরিসংখ্যানের ওপর ভর করেই এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে হাঁটছে সরকার। প্রক্রিয়াটি পেছানো না হলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন এখনো পেছানোর সুযোগ রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিল শেখ হাসিনার আমলা-মন্ত্রীদের নির্দেশে। পরিসংখ্যান জালিয়াতির বিষয়টি তখন বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফকেও জানানো হয়েছিল। তবে অদৃশ্য কারণে তখন দাতা সংস্থাগুলো বিষয়টি আমলে নেয়নি।

এখন দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ আসছে এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার। তারা বলছেন, ভুয়া পরিসংখ্যান দেখিয়ে বাংলাদেশের প্রকৃত অর্থনীতি আড়াল করা হয়েছিল। বিশেষ করে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), রপ্তানি আয়সহ নানা অর্থনৈতিক সূচকে শেখ হাসিনা সরকার যেসব তথ্য দিয়েছিল, তার ক্ষমতাচ্যুতির পর সেগুলো সংশোধন করতে হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভুল তথ্য-উপাত্তের ওপর দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক মহলে এক ধরনের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। তাদের দাবি, উন্নয়নের নামে আওয়ামী লুটপাটের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে বহির্বিশ্বের কাছে দেশের অবস্থান ভালো দেখাতে তথ্য ও পরিসংখ্যান জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের বাস্তব প্রস্তুতি ছিল না বললেই চলে। তাই এই ভুয়া ও জালিয়াতিপূর্ণ তথ্যের ওপর ভর করে এলডিসি উত্তরণ দেশের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হবে। এ কারণে তারা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন অন্তত তিন থেকে ছয় বছর পেছাতে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন।

বিবিএসের আওয়ামী আমলের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে যে কটি সূচকের অগ্রগতিকে ধরা হয়, সেগুলোর বেশিরভাগ তথ্যই ছিল জালিয়াতির শিকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাব। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৫-০৬ ভিত্তি বছরের সর্বশেষ সিরিজ ২০১৯-২০ অর্থবছরে চলতি মূল্যে জিডিপির আকার ছিল ২৭ হাজার ৩৯৩ বিলিয়ন টাকা। ২০১৫-১৬ ভিত্তি বছর অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি দাঁড়ায় ৩৫ হাজার ৩০২ বিলিয়ন টাকা, যেখানে ২৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়। তবে ভিত্তি বছর পরিবর্তনের নামে উন্নয়নের গল্প তৈরির জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই ‘মনগড়া প্রবৃদ্ধি’ ধরে জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও চলমান ছিল। এর ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে যখন মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় ১ লাখ ৭১ হাজার ৬০৮ টাকা ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় বেড়ে যায় ২৮ শতাংশ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ও অবাস্তব।

একেক প্রতিষ্ঠানের একেক হিসাব

রপ্তানি আয় নিয়ে আওয়ামী আমলেই হাসিনা সরকারের পরিসংখ্যান জালিয়াতির বড় ঘটনা নজরে আসে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১০ মাসের রপ্তানি আয় প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি দেখানোর ঘটনা বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। ইপিবির তথ্যে বলা হয়, দশ মাসে পণ্য রপ্তানি হয়েছে মোট ৪৭ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, ওই একই সময়ে রপ্তানি আয় এসেছে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তীব্র সমালোচনার মুখে তড়িঘড়ি করে সে সময় তথ্য সংশোধনের উদ্যোগ নেয় ইপিবি। এর জেরে তখন টানা তিন মাস রপ্তানির তথ্য প্রকাশও বন্ধ থাকে।

রপ্তানির মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি খাতকে নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতির তথ্য প্রকাশের এমন ঘটনায় বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন অর্থনীতিবিদরা। এমন ডাহা মিথ্যা তথ্যের পর দেশের জিডিপি, মোট জাতীয় উৎপাদন (জিএনপি), বিদেশি বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ঋণ গ্রহণের নীতি লেনদেনের ভারসাম্যসহ অর্থনীতির অনেক সূচক এবং নীতির যথার্থতা নিয়েও তখন প্রশ্ন ওঠে।

কৃষি খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ভুয়া পরিসংখ্যান

বিবিএসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতি বছরই কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধির হার প্রায় একই। এই খাতের সবচেয়ে বড় উপখাত হলো শস্য উৎপাদন, যা বিবিএসের তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়। বিবিএসের মাঠপর্যায়ের প্রতিটি উপজেলা থেকে মাসিক ভিত্তিতে শস্য উৎপাদনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। তবে মাঠপর্যায়ের উপজেলা কার্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত জনবলের অভাব ও বছরব্যাপী বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় কৃষি পরিসংখ্যানের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রমও ছিল দায়সারা। আগের বছরের তথ্যের সঙ্গে মিল রেখে নিয়মিতভাবে পাঠানো হচ্ছে প্রায় শতাধিক কৃষিপণ্যের উৎপাদনের হিসাব। অন্যদিকে এসব ভিত্তিহীন তথ্য-উপাত্তের ওপর ভর করে প্রাক্কলন করা হচ্ছে জিডিপির হিসাবও। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ক্রমাগত দেশের আবাদযোগ্য জমি হ্রাস পাচ্ছে, কিন্তু কৃষি উৎপাদনে এই হ্রাসের কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।

বিবিএসের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে চাল আমদানি হয়েছিল ১২ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন। ঠিক এক বছর পরে আমদানি হয়েছে মাত্র ৯৩৪ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ধান উৎপাদনের পরিমাণ বাড়লেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ হ্রাস দেখানো হয়েছে। বিপরীত দিক দিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শস্য উপখাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে ৪ শতাংশ। বিবিএস কর্তৃক এসব ভিত্তিহীন তথ্য প্রস্তুতের ফলে সরকারের উৎপাদনের সঠিক তথ্য না থাকায় খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুত ও সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।

শিল্প উৎপাদন খাতের পরিসংখ্যানেও জালিয়াতি

বাংলাদেশের জিডিপির অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো উৎপাদনশিল্প, জিডিপিতে যার অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। এই খাতের তিনটি ভাগের মধ্যে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের জিডিপিতে অবদান ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ, মাঝারি, ছোট ও ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান ৭ দশমিক ৬১ এবং কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠানের অবদান ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এই খাতগুলোর বার্ষিক ও ত্রৈমাসিক হিসাব প্রাক্কলনের জন্য মাসিক শিল্প উৎপাদন সূচক (কিআইআইপি) ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের সামগ্রিক উৎপাদনশিল্প খাতের মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পের রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান, যা মোট জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ। অন্যদিকে বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান খাতের প্রায় ৫৯ শতাংশ অবদানই হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পের। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৮৫ শতাংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পের। সুতরাং তৈরি পোশাক রপ্তানির সঙ্গে উৎপাদনশিল্প খাতের মূল্য সংযোজন অনেকাংশে নির্ভরশীল।

বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত তৈরি পোশাক খাত ও বৃহৎ শিল্পে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সমান্তরালভাবে চললেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাপক তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। ওই অর্থবছরে কোভিড পরিস্থিতি চলাকালীন পোশাক খাতে রপ্তানি ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও এই খাতে দশমিক ১১ শতাংশ উচ্চপ্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

একই সঙ্গে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী থাকা সত্ত্বেও যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩৮ ও ১ দশমিক ০২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রপ্তানির সংশোধিত হিসাব অনুসরণ করার কথা বলা হলেও, ২০২২-২৩ ও তার পূর্ববর্তী অর্থবছরের জিডিপির হিসাব সংশোধন করা হয়নি, যার ফলে এই খাতে জিডিপির আকার ও প্রবৃদ্ধি উভয়ই ক্রমাগতভাবে বেশি দেখানো হয়।

২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত এই ৩টি খাতের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার প্রায় সমান্তরালভাবে বৃদ্ধি পেয়ে আসছে, অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৃহৎ শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির হার ১.০২ হওয়া সত্ত্বেও মাঝারি ও কুটিরশিল্পের হার যথাক্রমে ৪ দশমিক ৬৬ ও ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানির নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি ও গ্যাস সংকটের দরুন দেশের শিল্প খাত ছিল নিম্নমুখী। এই ৩টি খাতের জিডিপি প্রাক্কলনের জন্য মূলত বিবিএস কর্তৃক পরিচালিত শিল্প উৎপাদন সূচক ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বিবিএসের এসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সংকলনের প্রতিটি ধাপেই তথ্যের ম্যানুপুলেশন ঘটানো হয়। জিডিপির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরের তথ্যও ম্যানুপুলেট করে প্রবৃদ্ধির হার ক্রমাগতভাবে বেশি দেখানো হচ্ছে। বিবিএস কর্তৃক পরিচালিত প্রায় সব জরিপের ক্ষেত্রেই সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি না করে কতিপয় কর্মকর্তার টেবিল ওয়ার্কের মাধ্যমে ভিত্তিহীনভাবে তথ্যের হ্রাস-বৃদ্ধি করে রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়ে থাকে।

অভিযোগ রয়েছে, দুটি আন্তশুমারি বা আন্তজরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সঠিক চিত্র তুলে ধরার পরিবর্তে জিডিপির সংশ্লিষ্ট সেক্টর এবং এ সংক্রান্ত আগের জরিপের সঙ্গে মিল রেখে বিবিএসের তথ্য প্রকাশ করা হতো। এ কারণে বাস্তব চিত্র যাই থাকুক, কিছু ব্যক্তির ‘টেবিল ওয়ার্কের’ মাধ্যমে তা পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া হাসিনার সময়ে দুটি আন্তশুমারি বা আন্তজরিপের প্রবৃদ্ধির হার ব্যবহার করে বার্ষিক জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়, যে কারণে কিছু সেক্টরের একটানা ৫ থেকে ৬ বছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার প্রায় একই রকম হতে দেখা গেছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ হাসিনা সরকারের পরিসংখ্যান জালিয়াতিকে ‘এক বিস্ময়কর টপ টু বটম দুর্নীতির উন্নয়ন’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তার মতে, বিগত দেড় দশকে আর্থিক খাতকে যেভাবে জালিয়াতি তথ্যের ওপর দাঁড় করানো হয়েছিলÑতা দেশের ইতিহাসে তো বটেই দুনিয়াতেও বিরল।

পরিসংখ্যান জালিয়াতির এমন প্রেক্ষাপটে দেশের এলডিসি উত্তরণ বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজের (সিএসপিএস) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মিজানুর রহমান আমার দেশকে বলেন, আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরো একটা ভুয়া তথ্য তৈরির কারখানা। আমাদের মাথাপিছু আয় ও জিডিপি এতটাই বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল যে দাতা সংস্থাগুলো তা মেনে নেয়নি। বিবিএসের ভুয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা যদি এলডিসি উত্তরণে যাই তবে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। মনে রাখতে হবে আমরা জিএসপি থেকে বঞ্চিত হব, অনেক ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে। আমাদের ব্যাংকিং খাত, পুঁজিবাজার, ইস্যুরেন্স খাত, শিল্পের জ্বালানি নিরাপত্তার মতো আর্থিক খাতের সব খানেই দুর্বল ভিত্তি। গোঁজামিল দেখিয়ে অন্তত এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তে যাওয়া মোটেও কাম্য নয়। এলডিসি উত্তরণ ২ থেকে ৩ বছর পিছিয়ে আর্থিক খাতের সব সংস্কার আগে শেষ করা উচিত।

এলডিসি উত্তরণে প্রস্তুত নয় দেশ

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশ-এর সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশের হাতে মাত্র ১৪ থেকে ১৫ মাস সময় রয়েছে। ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণ করবে। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে এত বড় প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব নয়। এলডিসি উত্তরণের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যসহ বড় বড় বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে, যা রপ্তানি ৬ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।

মাহবুবুর রহমান আরো বলেন, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যেসব সুবিধা পাচ্ছে—যেমন রপ্তানিতে ভর্তুকি, বাণিজ্যবিষয়ক মেধাস্বত্ব চুক্তির শিথিলতা; উত্তরণ হলে সেগুলো উঠে যাবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ওষুধশিল্পে। পেটেন্টের নিয়ম কঠোর হবে, উৎপাদন খরচ বাড়বে, ফলে ওষুধের দামও বাড়বে। পাশাপাশি কাঁচামালের উৎসবিধি কঠোর হবে, যা তৈরি পোশাক খাতকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সহজ শর্তের ঋণ সুবিধাও বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বাজারমূল্যভিত্তিক ঋণ নিতে হবে এবং তাতে দেশের ওপর ঋণ শোধের চাপ অনেক বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের আওতাধীন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (আইডিএ) নমনীয় ঋণের সুবিধাও হারাবে।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট এনামুল হক খান বলেন, আমরা গ্র্যাজুয়েশন চাই, তবে এখনই নয়। আমাদের রপ্তানিকারকরা এই মুহূর্তে প্রস্তুত নন। অন্তত তিন বছরের সময় দরকার। কারণ আমরা যদি বাজারে আমাদের অবস্থান হারিয়ে ফেলি, তা পুনরুদ্ধার করতে অনেক সময় লাগবে। প্রস্তুতি ছাড়া এগোলে দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের ব্যাকফুটে চলে যেতে হবে।

নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যবসায়ীদের অন্ধকারে রেখে সরকার এলডিসি উত্তরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি, কোনো প্রস্তুতিও নেওয়া হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান আইনে গ্র্যাজুয়েশন হলে বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস সুবিধা হারাবে। আমাদের দাবি, এলডিসি উত্তরণ কমপক্ষে তিন বছর পিছিয়ে দেওয়া হোক।

তবে সম্প্রতি ঢাকায় ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের এক সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, এলডিসি উত্তরণ এখন আর সরকারের হাতে নেই। এটি জাতিসংঘ নির্ধারিত প্রক্রিয়া। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ, নেপাল ও লাওসকে নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। আমাদের পেছানোর সুযোগ নেই, কারণ নেপাল ও লাওস থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালে, কোভিডের কারণে তা ২০২৬-এ পিছিয়েছে।

এ নিয়ে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ওই সেমিনারে বলেন, আনিসুজ্জামান চৌধুরীর প্রবন্ধেই বলা হয়েছে, আগের সরকার ভুল পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে অর্থনীতিকে উপস্থাপন করেছিল। এটা দেখেই বোঝা যায়, অর্থনীতি লাইফ সাপোর্টে ছিল। এ ধরনের ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া আত্মঘাতী।

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ২০৩২ সাল পর্যন্ত স্থগিতের দাবি

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই), আইসিসি-বিডি, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, বিকেএমইএ, বিজিএমইএ, বিটিএমএ, বাপি, এফআইসিসিআইসহ ১৬টি ব্যবসায়িক সংগঠন সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়ে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ২০৩২ সাল পর্যন্ত স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়েছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এলডিসি উত্তরণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যসহ প্রধান রপ্তানি গন্তব্যে ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে, যদি বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তি না হয়। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি ৬ থেকে ১৪ শতাংশ কমতে পারে। একই সঙ্গে এলডিসি হিসেবে পাওয়া রপ্তানি ভর্তুকি ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক আইনি চুক্তি ট্রিপসের শিথিলতা উঠে যাবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট, জ্বালানি খরচ এবং উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়াটাও বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে।

আওয়ামী সরকারের ‘টাইম বোমা’

বাংলাদেশ আগামী বছরের নভেম্বরেই এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে, তবে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং এর ফলে উদ্ভূত অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার বিষয়ে বিভ্রান্তি ও বিতর্ক ক্রমেই বাড়ছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন সম্প্রতি এলডিসি উত্তরণকে ‘পূর্ববর্তী সরকারের রেখে যাওয়া টাইম বোমা’ হিসেবে বর্ণনা করে আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। অথচ চলতি বছরের ১৩ মার্চ উপদেষ্টা পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরণকে সমর্থন জানিয়েছিল।

এদিকে, জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি), যারা এলডিসি উত্তরণের সিদ্ধান্ত নেয়, তারা একটি চিঠির মাধ্যমে উত্তরণে থাকা ও সদ্য উত্তীর্ণ দেশগুলোর প্রস্তুতি সম্পর্কে বার্ষিক প্রতিবেদন চেয়েছে। এনহেন্স মনিটরিং ম্যাকানিজমের (ইএমএম) আওতায় এই চিঠি পাঠানো হয়। ২৫ আগস্ট সিডিপির চেয়ার হোসে আন্তোনিও ওকাম্পো এই চিঠি পাঠান।

বাংলাদেশকে স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজির (এসটিএস) বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কে বার্ষিক প্রতিবেদন আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে একটি ভার্চুয়াল পরামর্শ সভায় অংশ নিতে সরকারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

এখনো সুযোগ দেখছেন ব্যবসায়ীরা

গ্র্যাজুয়েশনের পর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে প্রভাব পড়ার শঙ্কার কথা তুলে ধরে এটি পেছানো সম্ভব বলে মনে করেন ব্যবসায়ী নেতারা। জানতে চাইলে নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান আমার দেশকে বলেন, এখনো সময় আছে, অবশ্যই আছে। কিন্তু আমাদের সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে চিঠি দিই আমরা আসলেই প্রস্তুত কি না- এবং জাতিসংঘ যদি একটি সার্ভে করে তাহলে টিম আসার পর এমনিতেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে আমরা প্রস্তুত না। কারণ হলো, একটা ক্লজ আছে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর ওই দেশে আর্থসামাজিক অবস্থা আগের থেকে খারাপ হবে কি না। শঙ্কা থাকলেই গ্র্যাজুয়েশন হবে না।

বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক ও বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, তথ্যবিভ্রাট সব সময় ছিল, রাজনৈতিক সিচুয়েশন আমাদের ভালো না, তাছাড়া আন্তর্জাতিক সমর্থনও আমাদের থাকবে। সে কারণে আমি মনে করি এখনো গ্র্যাজুয়েশন পেছানোর সুযোগ রয়েছে।

বিশ্বব্যাংক ও এডিবিকে সতর্ক করেছিলেন আমার দেশ সম্পাদক

হাসিনার বানোয়াট পরিসংখ্যানের বিষয়ে প্রথম বারের মতো বিশ্বব্যাংক ও এডিবিকে সতর্ক করেছিলেন আমার দেশ সম্পাদক। ২০২০ এবং ২০২৩ সালে আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান এ নিয়ে বিস্তর তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশের প্রধান দুই উন্নয়ন সহযোগী, বিশ্বব্যাংক ও এডিবিকে চিঠি দিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংক দায়সারাভাবে চিঠির উত্তর দিলেও, এডিবি ছিল চুপ।

পরিসংখ্যান জালিয়াতির সুস্পষ্ট তথ্য তুলে ধরা ২০২৩ সালের ১১ অক্টোবরের সেই চিঠির একটি কপি সংগ্রহ করে দেখা যায়, সেখানে সাতটি বিষয়ে বিশ্বব্যাংককে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তুলে ধরা হয়। এর প্রথমটিই ছিল অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান জালিয়াতির বিষয়ে।

Source: https://www.dailyamardesh.com/amar-desh-special/amduzihj3g4kx

Exit mobile version