অবশ্য বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী কারাবন্দি হওয়ায় নেতাকর্মীকে আইনি সহায়তা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে দাবি করছেন দলের শীর্ষ নেতারা। এদিকে দলের সংশ্লিষ্ট স্থানীয় শাখার নেতারাও গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মী ও সমর্থকের খোঁজ রাখেন না বলেও অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীর স্বজনরা। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে নানা অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করেন স্থানীয় শীর্ষ নেতারা।
নাম প্রকাশ না করে ভুক্তভোগী নেতাকর্মীর স্বজনরা সমকালকে জানান, কারাভুক্ত নেতাকর্মীর স্বজনদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য দলের সংশ্লিষ্ট শাখার শীর্ষ নেতারা কোনো খোঁজখবরই রাখেন না। এ ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা দলীয় আইনজীবী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে নিজেরা ধারদেনা করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে পুলিশকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিচ্ছেন। আবার পরিবারের পক্ষ থেকে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। কেউ কেউ স্বজনকে জামিন করানোর আশায় লাখ লাখ টাকাও উকিলের মাধ্যমে ঘুষ দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে কেউ জামিন পাচ্ছেন, আবার কেউ পাচ্ছেন না। জামিন পেলেও কাউকে কাউকে অন্য মামলায় অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাবন্দি করে রাখা হচ্ছে। এতে টাকাও গেল এবং জামিনও কার্যকর হলো না।
বিএনপির কারাবন্দি কর্মী-সমর্থকদের স্বজনরা আরও জানান, দলের ওয়ার্ড থেকে প্রতিটি ইউনিটের শীর্ষ নেতাদের তত্ত্বাবধানে ওই শাখার আইনবিষয়ক সম্পাদকের নেতৃত্বে ‘আইনি সহায়তায় উপকমিটি’ গঠন করে স্থানীয় নেতাকর্মীকে সহায়তা দেওয়ার জন্য নিয়মিত মনিটর করা উচিত। অথচ স্বজনরা যোগাযোগ করলেও ইউনিটের নেতারা আইনি সহায়তার কোনো দায়দায়িত্ব নেন না। নানা অজুহাতে তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ঝুঁকি নিয়ে দলের জন্য কাজ করা নেতাকর্মী-সমর্থকের সংখ্যা আরও কমে যাবে।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিএনপির দাবি, সারাদেশে তাদের ২৭ হাজার ৪৮৫ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের কর্মীদের হামলায় আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৩০০ জন এবং মারা গেছেন এক সাংবাদিকসহ ২৮ জন। এ ছাড়া এই সময়ে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৭৫টি। এসব মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ১ লাখ ৫ হাজারের বেশি।
বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পুরোনো মামলাও রয়েছে। দলটির দাবি, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৩৪ মামলায় বিএনপির ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ৪৯২ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। নতুন-পুরোনো এসব মামলায় নেতাকর্মীকে আইনি সহায়তা দিতে ভীষণ চাপে পড়েছে বিএনপি। আবার অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। মামলাগুলো পরিচালনায় বিএনপির আইনজীবীর পাশাপাশি ব্যক্তিগত আইনজীবী নিয়োগ করতে হচ্ছে। কিন্তু এটি করতে গিয়ে অর্থ সংকটে অনেক নেতাকর্মী।
বিএনপি নেতারা জানান, ৭ জানুয়ারি ভোটের পর রাজপথের কঠোর কর্মসূচি থেকে তারা সরে এসেছেন। দল গুছিয়ে আবারও মাঠের আন্দোলনে ফিরতে চান। আর এ সময়ের মধ্যে কারাবন্দি, নির্যাতিত, আহত ও নিহত নেতাকর্মীর পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলা হয়েছে দলের হাইকমান্ড থেকে। তাই আটক নেতাকর্মীকে আইনি সহায়তা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে একসঙ্গে আইনি সহায়তা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন বিএনপির আইনজীবীরা। অনেক আইনজীবী পকেটের টাকা খরচ করে নেতাকর্মীর জামিনের চেষ্টা করছেন, অনেকে নামমাত্র খরচ নিয়ে কাজ করছেন। তবে ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। অনেক আইনজীবীর বিরুদ্ধে কারাবন্দি নেতাকর্মীর পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
বিএনপির আইনজীবীরা অবশ্য এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, দলের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তারা কাজ করছেন। যেসব নেতাকর্মী আর্থিকভাবে সচ্ছল, শুধু তাদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক ছাড়া মামলার খরচ নিচ্ছেন; অসচ্ছলদের কাছ থেকে তাও নেওয়া হচ্ছে না। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতারা জানান, সারাদেশে মামলা পরিচালনার জন্য তাদের ৬৩টি কমিটি রয়েছে। জেলাভিত্তিক ওই কমিটির নেতারা বিএনপি নেতাকর্মীর মামলা দেখভাল করছেন। এ ব্যাপারে ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঢাকার নিম্ন আদালতে তাদের ৩৩০ সদস্যের কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে যারা রাজনৈতিক মামলা পরিচালনায় দক্ষ, তাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু অনেক নেতাকর্মী আইনি সহায়তা পাচ্ছেন না– এমন অভিযোগের বিষয়ে তারা বলেন, কেউ কেউ তাদের পরিচিত আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা চালাচ্ছেন। আবার অনেকে দলের আইনজীবীদের ঠিকমতো চেনেন না কিংবা রাজনৈতিক মামলা সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই বলে বিভিন্ন মাধ্যম হয়ে অন্য আইনজীবীদের শরণাপন্ন হন। এ মুহূর্তে দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছেন। তাই কেউ কেউ সঠিকভাবে আইনি সহায়তা নাও পেতে পারেন।
বিএনপির এক আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিগত দিনে যেসব আইনজীবী বিএনপির সমর্থনে নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের অনেককে দলের নেতাকর্মীর মামলা পরিচালনায় দেখা যাচ্ছে না। এ তালিকায় সিনিয়র আইনজীবীও রয়েছেন। তারা শুধু বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের ক্ষেত্রে দৌড়ঝাঁপ আর ক্যামেরার সামনে ফটোসেশন করেন। আর মধ্যম সারি ও জুনিয়র অনেক আইনজীবী অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সমন্বয়ের অভাবে মামলার শেষ পর্যায়ের শুনানিতে অভিজ্ঞ আইনজীবীর সংকটে পড়তে হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা মন্তব্য করতে রাজি নন। তবে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম সজল সমকালকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের নির্যাতন শুরু করেছে। তাই এবারের ঘটনা নতুন কিছু নয়। কারাগারে থাকা নেতাকর্মীকে আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তির ব্যাপারে কাজ করছি। সমন্বিতভাবেই সেটা হচ্ছে। জ্যেষ্ঠ থেকে শুরু করে একেবারে কনিষ্ঠ আইনজীবীও কাজ করছেন।’
বিএনপির আরেকজন আইনজীবী বলেন, মামলার ওকালতনামা, পিটিশনসহ বিভিন্ন কাগজ কিনতে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা খরচ হয়। সেই টাকার জোগান কীভাবে হবে, তা কেউ বলেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা আইনজীবীর পকেট থেকে যাচ্ছে। তবে বিভিন্ন সংগঠন থেকে যৎসামান্য খরচ দেওয়া হচ্ছে।
নিম্ন আদালতে বিএনপিপন্থি আইনজীবী নিহার হোসেন ফারুক বলেন, ‘দলের আইনজীবীরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করে কাজ করছেন। মামলা পরিচালনায় তারা পারিশ্রমিক নিচ্ছেন না। ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ছাড়াও অন্যান্য সংগঠনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।’
বিএনপির আরেক আইনজীবী আবদুস সালাম হিমেল বলেন, ‘কারাবন্দি নেতাকর্মীর মামলা পরিচালনায় দলের আইনজীবীদের খাওয়া-ঘুম নেই। এর পরও চাই, যত দ্রুত সম্ভব কারাবন্দি নেতাকর্মী মুক্তি পাক।’
সমকাল