৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ যা বলল
একটি দেশ যখন দেউলিয়া পর্যায়ে যায়, তখনই উদ্ধারে বেল আউটের প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে আইএমএফ বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে হাজির হয় ঠিকই, তবে সঙ্গে থাকে কঠিন সব শর্ত। কারণ, আইএমএফ মনে করে, অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হলে কঠোর কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এর মধ্যে থাকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন। পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকট বা ২০১০ সালের গ্রিসের সংকটের সময় এমনটাই দেখা গেছে। এখন যেমন পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে ঋণের শর্ত নিয়ে দর–কষাকষি শেষই হচ্ছে না।
১৯৯৭ সালের ৫ আগস্ট প্রথম থাইল্যান্ডের সঙ্গে ১৭ বিলিয়ন ডলারের (এক শ কোটিতে এক বিলিয়ন) ঋণচুক্তি করেছিল আইএমএফ। এ জন্য দেশটিকে ৫৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং ৩ হাজার কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করতে হয়। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে আইএমএফের ৪০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয় একই বছরের ৩১ অক্টোবর। এ জন্য দেশটি ১৬টি সংকটপূর্ণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণাসহ খরচ কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। আইএমএফের শর্ত পালন করতে গিয়ে দেশটিকে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে যেতে হয়েছিল। বিশেষ করে খাদ্যসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ায় খাদ্যসংকট বেড়ে গেলে আন্দোলন তীব্র হয়। তাতে ৩২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর পতন ঘটেছিল প্রেসিডেন্ট সুহার্তোর।
মানুষের ওপর চাপ বাড়িয়ে আইএমএফের শর্ত পূরণ
ওয়াশিংটন ঐকমত্য
সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক সংকট থেকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বের হতে পেরেছিল ঠিকই, তবে এ জন্য তীব্র যন্ত্রণাদায়ক সময় পার হতে হয়েছে তাদের। তখন বেকারত্বের হার ছিল উঁচু, আত্মহত্যার প্রবণতাও ছিল বেশি। আর কঠিন সব শর্তের জন্য আইএমএফের সমালোচনাও ছিল ব্যাপক। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ তখন ছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ। ১৯৯৮ সালেই তিনি বিভিন্ন বক্তৃতায় কাজের পদ্ধতি, সব দেশের জন্য একই শর্ত দেওয়াসহ নানা বিষয়ে আইএমএফের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ বা ওয়াশিংটন ঐকমত্যের কার্যকারিতা নিয়ে।
প্রশ্ন হতে পারে আইএমএফের শর্তের সঙ্গে ওয়াশিংটন ঐকমত্যের কী সম্পর্ক? তার আগে একটু আইএমএফের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক। সংস্থাটির জন্ম ৭৮ বছর আগে, ১৯৪৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একটা স্থিতিশীল বিনিময় হার বজায় রাখাই ছিল সংস্থাটির উদ্দেশ। এ জন্য কোনো দেশ লেনদেনের ভারসাম্যের সংকটে পড়লে তাকে ঋণ দিয়ে সহায়তা করাও ছিল আইএমএফের কাজ। আইএমএফের প্রথম ঋণ পেয়েছিল ফ্রান্স।
গবেষকেরা বলছেন, শুরুতে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির সাফল্য ছিল বেশি। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত সময়ে ৬৯টি দেশ আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছিল, যার ফলাফল ছিল ইতিবাচক। আইএমএফ নিয়ে মূল সমালোচনা শুরু হয় ১৯৯০ সালের পর, লাতিন আমেরিকায় অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে। এ সময় থেকে আইএমএফ ঋণ দেওয়ার পদ্ধতি বদল করে, শর্ত ঠিক করে ওয়াশিংটন ঐকমত্যের সঙ্গে সমন্বয় করে। ওয়াশিংটন ঐকমত্য মানেই বহুল আলোচিত কাঠামোগত সংস্কার।
আইএমএফের ঋণ কেন লাগছেই
ওয়াশিংটন কনসেনসাস বা ওয়াশিংটন ঐকমত্য ধারণার প্রবর্তক জন উইলিয়ামসন নামের একজন ইংরেজ অর্থনীতিবিদ, ১৯৮৯ সালে। তিনি ওয়াশিংটন ডিসি–ভিত্তিক ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসের একজন অর্থনীতিবিদ ছিলেন। এটি মূলত ওয়াশিংটনভিত্তিক তিনটি প্রতিষ্ঠানের একটি সংস্কার প্যাকেজ।
এই তিন প্রতিষ্ঠান হলো বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় বা ইউএস ট্রেজারি বিভাগ। এই তিন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের সংস্কার কর্মসূচির কথা বলে থাকে। ওয়াশিংটন কনসেনসাস হলো, এসব শর্তের একটি প্যাকেজ, যাতে তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই একযোগে স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। সেখানে মূলত ১০টি সুপারিশ রয়েছে। যেমন—
১. আর্থিক নীতিতে শৃঙ্খলা আনা, ২. শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়িয়ে অন্যান্য খাতে ভর্তুকি হ্রাস, ৩. কর খাতের সংস্কার, ৪. বাজারের ওপর সুদের হার নির্ধারণ ছেড়ে দেওয়া, ৫. প্রতিযোগিতামুখী বিনিময় হার, ৬. বাণিজ্যব্যবস্থাকে উদার করা, ৭. বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ উদার করা, ৮. রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া, ৯. বিনিয়ন্ত্রণকরণ, অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ নিয়মনীতি শিথিল করা, যাতে বাজারে কারও প্রবেশ বাধাগ্রস্ত না হয় এবং ১০. স্বত্বাধিকারের (প্রোপার্টি রাইটস) ক্ষেত্রে আইনি নিরাপত্তা দেওয়া।
আইএমএফ কি উদ্ধারকর্তা
প্রথমে কোভিড–১৯ এবং পরে ইউক্রেন রাশিয়ার হামলা। এর ফলে বিশ্বের অনেক দেশই চরম অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে আছে। আর এ সময়ে আইএমএফের গুরুত্ব ও প্রভাব অনেক বেড়েছে। ফলে সমস্যায় থাকা দেশগুলোকে দেওয়া ঋণও রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ৪৪টি দেশ আইএমএফ থেকে ১৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ নিয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, ঋণ চাওয়া দেশের সংখ্যা এবং ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। ।
সাধারণত যেসব দেশ দেউলিয়া হয়ে বেল আউটের জন্য আবেদন করে, তাদের জন্য তুলনামূলক কঠিন শর্ত দেওয়া হয়। আর অন্যদের জন্য সাধারণ কিছু শর্ত পালন করতে হয়। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে যে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাচ্ছে, তা বেল আউটের অংশ নয়। তা হলে শর্তের মধ্যে অবশ্যই দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে কথা থাকত। সুতরাং এখন শর্তের মধ্যে থাকছে ব্যাংক খাতের সুশাসন বৃদ্ধি, সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমানো, জিডিপির অনুপাতে কর বৃদ্ধি ইত্যাদি। আর বাজারের ওপর সুদহার ও বিনিময় হার ছেড়ে দেওয়া কিংবা ভর্তুকি কমানো—সব তো ওয়াশিংটন ঐকমত্যেই বলা আছে।
আইএমএফের ব্যয় সংকোচনের শর্তে মানুষের ভোগান্তি বাড়ে
সুতরাং বাংলাদেশকে অনেকটা নরম শর্তই পূরণ করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে,আইএমএফের দেওয়া সংস্কার মানলেই কি বাংলাদেশের অর্থনীতির সব সংকট কেটে যাবে? আইএমএফ কি বাংলাদেশের অর্থনীতির উদ্ধারকর্তা। ভারত যে এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে,তার সূচনা হয়েছিল ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক সংকট থেকেই।
দেশটি যখন আইএমএফের কাছ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ২২০ কোটি ডলার ঋণ নেয়, তখন তাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল মাত্র তিন সপ্তাহের আমদানি ব্যয়ের সমান। চরম অর্থনৈতিক সংকটে চন্দ্রশেখর সরকারের পতন ঘটলে নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী আর মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন। বড় ধরনের রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে তারা তখন ব্যাপকভাবে সংস্কার করেছিলেন।
সংস্কারের ফলও দ্রুত পায় ভারত। আইএমএফের বড় সাফল্য হিসেবে এখনো ভারতকে উদাহরণ হিসেবে দেওয়া হয়। তবে ভারত আইএমএফ থেকে পুরো ঋণ নেয়নি। অর্থনীতি ভালো অবস্থায় গেলে ১৯৯৩ সালে তারা বাকি ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ভারত আর আইএমএফের মুখাপেক্ষী হয়নি।
আইএমএফের ঋণ অর্থনীতিকে উদ্ধার করতে পারবে না, সাময়িক স্বস্তি দেবে হয়তো। অর্থনীতিকে ঠিক করতে হলে সংস্কার করতে হবে নিজেদের মতো করে, নিজেদের প্রয়োজনে। এ জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সদিচ্ছা। বাংলাদেশ এতদিন সেই অঙ্গীকার দেখাতে পারেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, এবার কি পারবে, বিশেষ করে নির্বাচনী বছরের আগে ও পরে? নাকি সাময়িক স্বস্তি পাওয়াই আপাতত উদ্দেশ্য।