Site icon The Bangladesh Chronicle

আইএমএফের সন্তুষ্টি বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির নাকি শঙ্কার

আইএমএফের সন্তুষ্টি বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির নাকি শঙ্কার

ফরিদ খান

করোনা–পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি আমদানির ব্যয় বেড়ে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে ব্যাপক টান পড়ে। এরপর বাংলাদেশকে অনন্যোপায় হয়েই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হতে হয় ঋণের আশায়।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার শর্তসহ অন্যান্য শর্তে আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয়।

বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ানো, জুন ২০২৩–এর মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত ০.৫ শতাংশ বৃদ্ধি এবং ডিসেম্বর ২০২৩–এর মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণে একটি সূত্রভিত্তিক মূল্য সমন্বয় ব্যবস্থা গ্রহণ এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের জন্য আইএমএফ বাংলাদেশকে নির্দেশনা দিয়েছিল।

এ ছাড়া ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রথম পর্যবেক্ষণে আইএমএফ দেশের চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এবং নমনীয় বিনিময় হার নীতি অবলম্বন করার পরামর্শ দেয়।

সরকার ২০২৪ সালের জানুয়ারি নির্বাচন সামনে রেখে সেগুলো বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকলেও ঋণের পরবর্তী কিস্তি পাওয়ার জন্য চলতি মাসে সুদহার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার পাশাপাশি নীতি সুদের হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে।

নমনীয় বৈদেশিক বিনিময় হার নীতি গ্রহণের অংশ হিসেবে ‘ক্রলিং পেগ’ বিনিময় হার ব্যবস্থার অধীনে দেশের ইতিহাসে ডলারের বিনিময় হার একবারে সর্বোচ্চ ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করেছে।

এ ছাড়া পেট্রোলিয়াম পণ্যের জন্য একটি সূত্রভিত্তিক জ্বালানি মূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করেছে। সরকারের গৃহীত এই আর্থিক সংস্কারে দাতা সংস্থা আইএমএফ কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট।

চলতি মাসে দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ শেষে আইএমএফ মিশনের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও সাংবাদিকদের তাঁদের এই সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের আরও সংস্কার আনতে হবে এবং কর–রাজস্ব সংগ্রহের ওপর জোর দিতে হবে। এ ছাড়া তিনি অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ভর্তুকি কমানোর ওপর আবারও জোর দিয়েছেন।

আইএমএফের এই সন্তুষ্টি দেশের জন্য কতটা স্বস্তি বয়ে এনেছে এবং যাদের জন্য এই ঋণ, সেই জনগণ তাদের এই সংস্কারে কতটুকু স্বস্তিতে আছে, সেটি মূল বিবেচ্য বিষয়।

আইএমএফের ঋণ নেওয়ার পর থেকে দেশের অর্থনীতিতে শুধু রেকর্ডের ছড়াছড়ি। রেকর্ড পরিমাণে জ্বালানির মূল্য বেড়েছে, রেকর্ড পরিমাণে ডলারের দাম বেড়েছে, রেকর্ড পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমেছে। আর সবকিছু ছাপিয়ে রেকর্ড পরিমাণে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। আইএমএফের সন্তুষ্টি দেশের মানুষকে স্বস্তি দিতে পারেনি; বরং তাদের অস্বস্তি বেড়েই চলেছে।

ঋণ পাওয়ার প্রাক্কালে ২০২৩ সালের  জানুয়ারি বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নম্বর অগ্রাধিকার এবং তাদের লক্ষ্য সে বছর জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। দ্রব্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।

আইএমএফের নির্দেশিত পথে হেঁটে এবং তাদের ব্যবস্থাপত্র মেনেও তাদের প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতির হার অর্জিত হয়নি, বরং আরও বেড়েছে। বাড়ার কারণ হিসেবে বলছে, বৈশ্বিক সংকোচনমূলক আর্থিক নীতি, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য এবং খাদ্যের অতিরিক্ত মূল্য এবং অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা।

এসব কারণে মূল্যস্ফীতি ক্রমাগত বাড়ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুত হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ছে এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আরও জটিল হচ্ছে।

অনিশ্চিত এবং টালমাটাল বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি যখন নাজুক; আর্থিক খাত ভঙ্গুর, তখন বিনিময় হার নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি এবং সূত্রভিত্তিক জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত চরম দুঃসাহসিক।

লাতিন আমেরিকার হাতে গোনা কয়েকটি দেশ বিনিময় হার নির্ধারণের এই কৌশল চালু করলেও তাদের অনেকেই পরে এই পদ্ধতি থেকে সরে এসেছে।

একদিকে করোনা অতিমারি–পরবর্তী দুর্বল অর্থনীতি এবং যুদ্ধাহত বিশ্ববাজার, অন্যদিকে অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস এবং তীব্র খাদ্যসংকটের শঙ্কা। তখন আইএমএফের দেখানো অচেনা ও অনিশ্চিত পথে দেশের অর্থনীতির গন্তব্য কতটা সুখকর কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ, সেটি গভীর বিশ্লেষণের সুযোগ রাখে এবং ভাবনার উদ্রেক করে।

সরকারের আর্থিক সংস্কারের এই সাহসী সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে আইএমএফ বলেছে, বিনিময় হার সংস্কারের ফলে মূল্যস্ফীতির যে চাপ সৃষ্টি হবে, সুদহারের উদারীকরণ এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ মূল্যস্ফীতির সে চাপ কমাতে সাহায্য করবে।

মূল্যস্ফীতির চাপে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো আর্থিক সংস্কারের ফলে নতুন চাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা স্পষ্ট। বিনিময় হার সংস্কারের ফলে ডলারের মূল্য ৬ শতাংশ বেড়েছে, যার প্রভাবে সরল গাণিতিক নিয়মে আমদানি করা এবং আমদানিনির্ভর পণ্যের মূল্যও সরাসরি ৬ শতাংশ বেড়ে যাবে এবং অনুসৃত সূত্র মোতাবেক জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্যও আনুপাতিক হারে বাড়বে, যা আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দেবে।

পাশাপাশি ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক ঋণের খরচ বেড়ে যাবে। ডলারের দাম বাড়ানোর এই বহুমুখী প্রভাব একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ওপরও চাপ বাড়াবে, অন্যদিকে এই সংস্কার চলতি মূল্যস্ফীতিকে আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দেবে।

পাশাপাশি যুদ্ধোত্তর পশ্চিমা দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দাভাব আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা চলছে, যা রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে, যার লক্ষণ ইতিমধ্যে স্পষ্ট হচ্ছে।

এ ছাড়া যেখানে দেশের আর্থিক খাত অস্থিতিশীল এবং ভঙ্গুর, সেখানে সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় এই খাত আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।

সুদহার বেড়ে গেলে ব্যক্তি খাতে ঋণ খরচ এবং বিনিয়োগ ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে বাজার থেকে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার শঙ্কা আছে। এর ফলে দেশ থেকে পুঁজি পাচার বেড়ে যেতে পারে, অনেক শ্রমিক কাজ হারাতে পারেন।

এভাবে বহুমুখী সংকোচনমূলক আর্থিক নীতি শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি হ্রাস এবং টেকসই বৈদেশিক খাতের আশার গুড়ে বালি হয় কি না, সেই শঙ্কা প্রকট।

আর্থিক খাত সংস্কারের আইএমএফের যে পরামর্শ বা নির্দেশনা, তা অনেকাংশে আমাদের জন্য অতিপালনীয়, সে বিষয়ে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নে যে সময়টিকে বেছে নেওয়া হয়েছে, সেটি কতটুকু যৌক্তিক; সে বিষয়ে বড় প্রশ্ন আছে। এর ফলে আমাদের সক্ষমতা এবং আর্থিক খাতের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

আইএমএফের শর্তে আমরা তরতর করে উতরে যাচ্ছি কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে আমরা কি উতরাতে পারছি? অতীত অভিজ্ঞতা খুব তিক্ত।

বিগত সময়ে আইএমএফ কারও প্রকৃত বন্ধু কিংবা অভিভাবক হয়ে উঠতে পারেনি। আন্তর্জাতিক সাহায্য গ্রুপ অক্সফামের একটি গবেষণায় দেখা যায়, যে দেশগুলো আইএমএফের ঋণ নিয়ে উচ্চ ঋণগ্রস্ত দেশে রূপান্তর ঘটেছে, সেসব দেশে ঋণ পরিশোধ করা এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক কল্যাণ ও উন্নয়নমূলক খাতে বিনিয়োগ ব্যয় একসঙ্গে মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।

শেষ কথা হলো, নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ একটি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মুখোমুখি। কেউ পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে আর তার হাত ধরে তোলার চেষ্টা না করে তাঁকে সাঁতারের কৌশল শিখিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা, আর একটি সংকটাপন্ন অর্থনীতিকে সংস্কারের শর্তের জালে আটকে টেনে তোলার চেষ্টা—উভয় ক্ষেত্রেই পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।

এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, সেটি একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। তবে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধি, কঠোর মিতব্যয়িতা, দুর্নীতি দমন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে অন্তত হালে কিছুটা পানি পেতে পারে।

  • ফরিদ খান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
  • prothom alo
Exit mobile version