Site icon The Bangladesh Chronicle

আইএমএফের ঋণ: এক কিস্তি দিয়েই শর্তের চাপ

ফারুক মেহেদী, ঢাকা

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঋণের এক কিস্তি দিয়েই ব্যাংকিং, আর্থিক, রাজস্ব খাতসহ অর্থনীতির সার্বিক বিষয়ে নজরদারি শুরু করেছে। খেলাপি ঋণ, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সুশাসন, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি, কর অবকাশসহ প্রায় প্রতিটি বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে কাজ করছে।

জানা যায়, ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট ৭ কিস্তিতে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ছাড় করবে আইএমএফ। ঋণের প্রথম কিস্তি হিসেবে গত ৩০ জানুয়ারি প্রায় ৪৭ কোটি ডলার ছাড় করে সংস্থাটি। ঋণের বিপরীতে তাদের ছোট-বড় প্রায় ৩৮টি শর্ত রয়েছে। এসব শর্ত ও সংস্কার প্রস্তাবের একটি দৃশ্যমান অগ্রগতি আগামী জুনের মধ্যেই বাংলাদেশকে অর্জন করতে হবে। জুনে সব বাস্তবায়ন না হলেও অন্তত আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে শর্ত মেনে অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। কারণ, নভেম্বরে দ্বিতীয় পর্যালোচনা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ওই সময়ে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করবে সংস্থাটি। দ্বিতীয় কিস্তি পেতে বেশ কিছু শর্ত মানতে হবে। সরকারের সংস্থাগুলোর জন্য এসব শর্তের অনেকগুলো মানা কঠিন হলেও ঋণ পেতে হলে তা না মেনে উপায় নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শর্ত যদি মানুষের জন্য কল্যাণকর হয়, তা মানতে সমস্যা কী? সরকার চাপ মনে করলে ঋণ নেবে কীভাবে? আসলে আমাদের রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক নয়। সব সূচক ইতিবাচক অথচ রাজস্ব আয় ঠিকমতো হচ্ছে না। তার মানে কোথাও সমস্যা আছে। সুতরাং সমস্যা থাকলে তার সংস্কার লাগলে করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আশপাশের দেশের সঙ্গে তুলনা করে, বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ও দাম পর্যালোচনা করে যেটা ভালো তার জন্য যদি বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হয়, তাতে যদি জনগণের ক্ষতি না হয়, সেটা করতে সমস্যা নেই। আর ভর্তুকি যদি আমরা দিয়ে যেতে পারি, তাহলে আইএমএফের মাথাব্যথা কী? সুতরাং যা করা হবে, জনগণের ভালো-মন্দ বিবেচনা করেই হবে।’

সূত্র বলেছে, আইএমএফের শর্ত হিসেবে আগামী জুনে বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের খবরদারি কমানো, গণহারে কর অবকাশ-সুবিধা তুলে দিয়ে কর রাজস্ব অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো, বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে ভর্তুকি কমানোসহ আরও বেশ কিছু বিষয় রয়েছে।

আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল ২৫ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ সফর করছে। প্রতিনিধিদলটি দফায় দফায় বৈঠক করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সঙ্গে। শর্তগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে, বৈঠকে তা যাচাই করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, সংস্থাটির শর্ত অনুযায়ী খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বরং এখনো রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের গড় খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের বেশি। সামনে ঋণ পেতে হলে খেলাপির হার কমাতেই হবে। নিট রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ধরে রাখার শর্ত বাস্তবায়ন এখনো সম্ভব হয়নি। যদিও রিজার্ভ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যে ইডিএফের আকার ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার করেছে। ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। নির্বাচন সামনে রেখে এটা সরকার না করতে চাইলেও শর্তের কারণেই করতে হবে।

আইএমএফ চায়, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবারের একাধিক ব্যক্তি থাকতে পারবেন না। এ ব্যাপারে অনমনীয় অবস্থানও জানিয়েছে আইএমএফ। বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইনের খসড়ায় এ-সংক্রান্ত পরিবর্তনের বিধান রাখা হয়েছে এবং দায়ীদের জন্য শাস্তির কথাও বলা হয়েছে। আইনটি এখনো পাস হয়নি।

সূত্র বলেছে, আইএমএফ প্রতিনিধিদল বিমা, মিউচুয়াল ফান্ড, ক্ষুদ্রঋণসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংবেদনশীল সব তথ্যও জানতে চেয়েছে। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তাদের পাশাপাশি এখন থেকে বিমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন সংস্থা (আইডিআরএ), ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন যৌথভাবে তাদের চাহিদামাফিক তথ্য সরবরাহ করবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আইএমএফ অনেক কথাই বলেছে। কিছু আমরা রাজি হয়েছি, তারাও একমত। এ নিয়ে কাজও হচ্ছে। যেমন সুদের হারের যে সংস্কার, সেটা আসছে মুদ্রানীতিতে থাকবে। রিজার্ভ আমরা কী পদ্ধতিতে হিসাব করব, সেটাও মুদ্রানীতিতে ঘোষণা করা হবে। তারা আর যেসব ইস্যুর কথা বলেছে, এগুলো অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে; সেগুলো আমরা সামনে সবশেষ বৈঠকে তাদের বলব।’

সূত্র বলেছে, এনবিআরের শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর খাতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকেও রাজস্ব খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বলেছে আইএমএফ। বিশেষ করে গণহারে বিভিন্ন খাতে দেওয়া করমুক্ত-সুবিধা তুলে দিয়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে বলেছে। পাশাপাশি আগামী বাজেটে করপোরেট কর আর না কমাতে বলেছে। একই সঙ্গে তারা সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বিশেষ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বকেয়া থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে। বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে নগদ আয় করলেও শুল্ককর ও ভ্যাট রাজস্ব খাতে জমা দেয় না।

জানা যায়, প্রতিবছর জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ২৮ শতাংশ ক্ষতি হয় করমুক্ত-সুবিধার কারণে। এনবিআর পর্যায়ক্রমে এ করমুক্ত-সুবিধা তুলে দিতে চায়। বৈঠকে উপস্থিত এনবিআরের একজন সদস্য নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘আইএমএফ মিশন কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে ও কর অবকাশ তুলে দিতে বলেছে। আমরাও বাস্তবতা তুলে ধরে সম্ভব সব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছি।’

সূত্র বলেছে, সংস্থাটির শর্ত মেনে আগামী অর্থবছরে নিয়মিত শুল্ককর আদায়ের অতিরিক্ত অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে হবে এনবিআরকে। আইএমএফ এ ব্যাপারে এনবিআরকে আরও কঠোর হতে বলছে। আর এটা করতে হলে আসছে বাজেটে অনেক খাতে করমুক্ত-সুবিধা তুলে দিতে হবে। অজনপ্রিয় হলেও করের বোঝা বাড়াতে হবে।

আইএমএফ ঋণের সুদের হার ও ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার শর্ত দিয়ে এখন এর বাস্তবায়ন দেখতে চাইছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব শর্ত পূরণে বেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলেছে।

আইএমএফ ভর্তুকি কমাতে চায়। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকি কমিয়ে আনতে তারা দাম সমন্বয় করার পক্ষে। এই শর্ত পূরণ করতে হলে আগামী জুনে বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়াতে হতে পারে। চলতি বছরে সরকার ইতিমধ্যে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। প্রতিবার ৫ শতাংশ করে এ পর্যন্ত ১৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভর্তুকি কমানো হয়েছে। জানা যায়, শর্ত মেনে সামনে দাম বাড়ানোর সুপারিশ করা হবে বলে আইএমএফকে আশ্বস্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

এদিকে সফররত মিশন গতকাল আবারও অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে বৈঠক করেছে। সূত্র বলেছে, রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যাবতীয় লেনদেন একটি আলাদা হিসাবের (ইস্ক্র অ্যাকাউন্ট) মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে বলে বৈঠকে ইআরডির পক্ষ থেকে আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়। এ ছাড়া বিদেশি ঋণের তথ্য জানতে চেয়েছে সংস্থাটি; বিশেষ করে কোনো উন্নয়ন সহযোগীর ঋণের কিস্তি পরিশোধ বাকি আছে কি না। জবাবে ঋণ পরিশোধ করার বিষয়টি জানানো হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধিরা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ থেকে পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদ বাদ দিয়ে দেখাতে বলেছেন। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ভর্তুকি কমিয়ে সে অর্থে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রকৃত দরিদ্রদের সহায়তা বাড়াতে বলেছে আইএমএফ; যাতে যাদের প্রয়োজন তাদের কাছেই অর্থ যায়। তবে অর্থ বিভাগ এখনই সামাজিক নিরাপত্তা খাত থেকে পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদ আলাদা করতে রাজি নয়।

ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফের চাপের বিষয়ে সংস্থাটির সাবেক কর্মকর্তা ও গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আসলে সরকার গত বছর কোনো সংস্কার করেনি। এবার করতে হবে। তবে অনেকগুলোই করতে পারবে না। রাজস্ব আদায়ের শর্ত মানতে পারবে না। রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণ নিয়েও সন্দেহ আছে। ভর্তুকি কমবে তবে যেটুকু কমানোর কথা, সেটা পারবে না। তবে আইএমএফ যা চায়, এটা অর্জন করা প্রয়োজন। না হলে বাজারে বাংলাদেশ সম্পর্কে আস্থাহীনতা কাটবে না। তখন ডলার সংকটও দূর হবে না।’

Exit mobile version