Site icon The Bangladesh Chronicle

অর্থ সংকট তাই ভর্তুকি পরিশোধে স্পেশাল বন্ড ইস্যু করবে সরকার!

বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সারসহ বিভিন্ন খাতের ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। কিছু খাতে তা বকেয়া রয়েছে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে। এ অবস্থায় ভর্তুকি পরিশোধে বিকল্প পথ খুঁজছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রস্তাব উঠেছে ভর্তুকির অর্থ নগদে পরিশোধ না করে স্পেশাল ট্রেজারি বন্ডে রূপ দেয়ার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট অনুবিভাগের গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।

বৈঠকে অংশ নেয়া একাধিক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, সরকারের হাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা পরিশোধের মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ভর্তুকি ও প্রণোদনার অর্থ বকেয়া পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাংক ও গ্রাহকরা। এজন্য আপাতত স্পেশাল বন্ড ইস্যু করে এ বকেয়া পরিশোধ করা  যায় কিনা সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ বিষয়ে বাজেট অনুবিভাগ থেকে বন্ড ইস্যুর বিষয়ে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে। এরপর তা নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শও নেয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী সরকার এ অর্থ ছাড় করার পর সেটি বিপিডিবির হিসাবে যুক্ত হয়। তারপর বিপিডিবির হিসাব থেকে সেগুলো যায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর হিসাবে। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ঋণের কিস্তি ও অন্যান্য দায় সমন্বয় করে। বিদ্যুৎ খাতের মতো সার আমদানিতেও ভর্তুকি হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া পড়েছে। আবার কভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের সময় সরকার ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের সুদ-ভর্তুকিও এখনো বকেয়া রয়েছে। এ মুহূর্তে এত পরিমাণ অর্থ পরিশোধের অবস্থা সরকারের নেই।’

ওই কর্মকর্তা জানান, স্পেশাল বন্ড ইস্যু করা হলে সেটি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অনুকূলে প্রদান করা হবে। ব্যাংক সে বন্ডের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে সুদ পাওয়ার পাশাপাশি নিজেদের সিআরআর-এসএলআর সংরক্ষণ করতে পারবে। বৈঠকে ভর্তুকির বিপরীতে বন্ড ইস্যুর পরিকল্পনা করা হলেও এর পরিমাণ এখনো নির্ধারিত হয়নি।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ১ লাখ ১০ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরেও সরকার বিদ্যুৎ খাতে ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা, জ্বালানি খাতে ৬ হাজার ২৩২ কোটি, কৃষি খাতে ২৬ হাজার ৫৫ কোটি ও সারে ২৫ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকার ভর্তুকি দিয়েছে।

সরকারি দায়ের বিপরীতে স্পেশাল বন্ড ইস্যুর নজির আগেও রয়েছে বলে জানালেন সাবেক অর্থ সচিব এবং সাবেক মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌১৫-২০ বছর আগে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) দায়ের বিপরীতে ব্যাংকের অনুকূলে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হয়েছিল। যদিও এ ধরনের বন্ডে ব্যাংকের তারল্য সমস্যার সমাধান হয় না। কারণ ব্যাংক এর মাধ্যমে নগদ টাকা পায় না। বরং এর মাধ্যমে ব্যাংক একটি সম্পদ পায়, যেটায় সরকারের গ্যারান্টি আছে। সে সময় বন্ডের বিপরীতে ব্যাংকগুলো সুদ পেত, তবে সেটি বাজারদরে নয় বরং একটি নির্ধারিত হারে। তখন শুরুতে বন্ডের বিষয়টি ব্যাংকের এসএলআর হিসেবে গণ্য করা হয়নি। পরে এটিকে এসএলআরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’

মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘‌স্পেশাল বন্ডকে এসএলআর হিসেবে গণ্য করা হলে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা বাড়বে। কারণ এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে এসএলআর সংরক্ষণের জন্য সরকারি সিকিউরিটিজে যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হতো, ‌স্পেশাল বন্ডের ক্ষেত্রে সেখান থেকে বন্ডের সমপরিমাণ অর্থ বাদ যাবে। ফলে এ অর্থ তখন ব্যাংক অন্য খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে। তবে দিনশেষে এটি হলো সরকারের দায়কে বিলম্বিত করা।’

লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আয় না হওয়ায় সরকারের অর্থ সংকট বাড়ছে। ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে এ সংকট উত্তরণের চেষ্টা করছে সরকার। যদিও এখন পর্যন্ত এ প্রচেষ্টায় তেমন কোনো সাফল্য আসেনি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আহরণে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বাজেটের ঘাটতি সংস্থানে সরকার দেশী-বিদেশী উৎস থেকে উচ্চসুদেও ঋণ নিচ্ছে। এরই মধ্যে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার উঠে গেছে ১১ শতাংশে। তার চেয়ে বেশি মেয়াদি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার ১২ শতাংশ পর্যন্তও উঠেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ৭ লাখ ৯২ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৩১৭ কোটি টাকার ঋণ নেয়া হয়েছে ব্যাংক খাত থেকে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা।

স্পেশাল বন্ডের বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরের মত হলো যে নামেই হোক, এটি সরকারের ঋণ। সামগ্রিক অর্থনীতিতে এ ধরনের ঋণের বিরূপ প্রভাব আছে।

বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সরকার লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ কারতে পারছে না। এ কারণে সরকারের বাজেট ঘাটতি বড় হচ্ছে। সরকার চারটি উৎস থেকে অর্থের সংস্থান করতে পারে। প্রথমটি হলো রাজস্ব। সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে পারছে না। উল্টো এ খাতে ঘাটতি বড় হচ্ছে। দ্বিতীয় উৎস হলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া। গত বছর নতুন টাকা ছাপিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিয়েছিল। আমরা দেখেছি, এ ঋণের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি উসকে উঠেছে। এখন টাকা ছাপিয়ে ঋণ নেয়ার সুযোগ নেই। তৃতীয় উৎস হলো সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে ঋণ নেয়া। নানা শর্তের কারণে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ছে না। আর চতুর্থ উৎস হলো ব্যাংক খাত থেকে ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়া। এ ধরনের ঋণ সরকার প্রতিনিয়তই নিচ্ছে। এখন নতুন করে স্পেশাল বন্ড ইস্যু করা হলে ব্যাংক খাত আরো বেশি তারল্য সংকটে পড়বে। আর বেসরকারি খাত ঋণবঞ্চিত হবে।

বস্ত্র খাতের রফতানিতে নগদ সহায়তা বাবদ প্রাপ্য বকেয়া ৪ হাজার কোটি টাকা চেয়ে এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে খাতটির উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএ। আবার বকেয়া বিদ্যুৎ বিল চেয়ে সরকারের কাছে এক বছরের বেশি সময় ধরে চিঠি দিয়ে আসছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ)। ব্যাংকগুলোও নিজেদের বকেয়া অর্থ চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ বিল, বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি ও প্রণোদনাসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের মোট দেনা বকেয়া রয়েছে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা। সরকার এ অর্থ পরিশোধ করলে সেটি দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য হিসেবে যুক্ত হতো। এতে বিরাজমান তারল্য সংকট অনেকাংশেই কেটে যেত।

রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের বিপরীতে সরকারের কাছে ব্যাংকগুলোর প্রাপ্য প্রণোদনার অর্থ বকেয়া রয়েছে প্রায় ছয় মাস ধরে। সার আমদানিতে ভর্তুকি বকেয়া প্রায় দুই বছরের। এছাড়া সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ও পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের ভর্তুকিও যথাসময়ে পরিশোধ করা হচ্ছে না। বিভিন্ন খাতে সরকারের কাছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির বকেয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। রেমিট্যান্স, রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ও অন্যান্য খাতের প্রণোদনা বা ভর্তুকি হিসেবে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রায় ২৬০ কোটি টাকা পাবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) পিএলসি। ঢাকা ব্যাংক পিএলসির সরকারের কাছে পাওনা বকেয়া ৪৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু সার আমদানির ভর্তুকি হিসেবেই ৪৩৭ কোটি টাকা পাবে ব্যাংকটি। এভাবে দেশের সবক’টি ব্যাংকেরই সরকারের কাছে কোনো না কোনো পরিমাণে পাওনা অর্থ বকেয়া রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের প্রণোদনার অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকদের পরিশোধ করে। নগদে পরিশোধ করে দেয়া সে অর্থ পেতে যদি তিন-চার মাস লেগে যায়, সেটি দুঃখজনক। এক বছর আগে রেমিট্যান্সের প্রণোদনার অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অগ্রিম পেতাম। এখন বকেয়া অর্থ চেয়েও আবেদন করতে হচ্ছে। ইডিএফসহ বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার অর্থ চেয়ে আবেদন করেছি। ‌দেশের ব্যাংক খাতে এখন তারল্য সংকট চলছে। ঋণগ্রহীতারা যথাসময়ে ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করছে না। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোয় নগদ প্রবাহ (ক্যাশ ফ্লো) কমে যাচ্ছে। সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে বকেয়া অর্থ পরিশোধ করলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে পারত।’

বন্ড ইস্যু করে ব্যাংকগুলোকে ভর্তুকির টাকা পরিশোধের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌কোন প্রক্রিয়ায় ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ করা হবে, সেটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু করার নেই। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে স্পেশাল বন্ড ইস্যুর বিষয়ে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। যেকোনো প্রক্রিয়ায় ভর্তুকির টাকা পরিশোধ করা হলে ব্যাংক খাত উপকৃত হবে।’

বনিক বার্তা

Exit mobile version