১. ৫ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো রিপোর্ট করেছে, আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ২০.৯০ বিলিয়ন ডলার এবং নিট রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এহেন পতনের ধারা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভ শূন্যেও নেমে আসতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের যে ধারা আমাদের অর্থনীতিকে চরম টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে, তা সামাল দিতে পারছে না সরকার। প্রতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংককে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রয় করতে হচ্ছে। রিজার্ভের এহেন পতনের ধারা অব্যাহত থাকলে কয়েক মাসের মধ্যে অর্থনীতি ‘মেল্টডাউন’-এর পরিস্থিতিতে পড়বে।
২. ২০২১ সালের আগস্টে দেশে এক ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। গত দু’বছরে ডলারের দাম হুহু করে বেড়ে ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বাজারে এক ডলারের দাম দাঁড়িয়েছে ১১০.৫০ টাকায়। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম এখন ১২০-১২২ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। এর মানে, এই দুই বছরে টাকার বৈদেশিক মান কমপক্ষে ২৭ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে।
৩. কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতন থামাতে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কারণ, হুন্ডি ব্যবসা চাঙ্গা হওয়ায় ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। গত আগস্টে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স আগের বছরের আগস্টের চেয়ে ২১ শতাংশ কমে গেছে। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৪.৩৬ কোটি ডলার, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
৪. কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে আমদানিকারকরা এলসি খুলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক আমদানিকারক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ১১৫-১১৭ টাকায় ডলার কিনে এলসি খুলছেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। ৫. আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংক ঋণ বিদেশে পাচার– এই চারটি প্রধান অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতি বছর ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় এসব পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চ-বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাদের অবস্থান। আমি তাদের ‘জাতীয় দুশমন’ বলে অভিহিত করছি। তারা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের অপব্যবহার করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছে। তারা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তারা ৫২ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্থবিত্তের মালিক হয়ে তাদের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে কানাডার টরন্টোর ‘বেগমপাড়া’, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ফ্রেটারনিটি এবং মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে।
৬. আমাদের মূল্যস্ফীতির হার সরকারের দাবি অনুযায়ী এখনও ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়ে গেছে! সাধারণ ক্রেতাদের জীবনকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যস্ফীতির লাগামহীন পাগলা ঘোড়া যেভাবে অসহনীয় করে তুলেছে, তাদের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেবে যে প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির হার আরও অনেক বেশি!! ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে মূল্যস্ফীতি এখন নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। অথচ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি দক্ষ হাতে নিয়ন্ত্রণের কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না।
এসব সমস্যার প্রতিটাই যে কোনো দেশের অর্থমন্ত্রীর ঘুম হারাম করার জন্য বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের অর্থমন্ত্রীর কাছে এসব সমস্যা সত্ত্বেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ‘কুসুমাস্তীর্ণ’ মনে হচ্ছে! কারণ, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের ইতিহাসে অর্থনীতি সম্পর্কে এত স্বল্পজ্ঞানসম্পন্ন কোনো অর্থমন্ত্রী অতীতে কখনও আমরা পাইনি। এমন ধারণা করার কারণ রয়েছে যে, তাঁকে অর্থমন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়ে রেখে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব হয়তো অন্য কারও সহায়তায় এবং উচ্চতর পদের আমলাদের পরামর্শে অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণের দায়িত্বটি নিজে পালন করতেই বেশি পছন্দ করছেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রীকে দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান মনসুর বেশ কিছুদিন আগেই ‘অ্যাবসেন্ট ফিন্যান্স মিনিস্টার’ আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি দুই বছর ধরে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সভায় অংশগ্রহণ করেননি; বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
গত ৪ সেপ্টেম্বরের পত্রপত্রিকায় দেখলাম জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সংসদে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রীকে ‘বোবা অর্থমন্ত্রী’ বলে গালমন্দ করলেন প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কোনো প্রতিক্রিয়া শোনা গেল না! ১৯৯৬-২০০১ সালে এসএএমএস কিবরিয়ার মতো মেধাবী অর্থমন্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়ায় এবং ২০০৯-’১৮ পর্যায়ে মেধাবী ও দেশের অভিজ্ঞতম সাবেক আমলা আবুল মাল আবদুল মুহিতকে দেশের দীর্ঘতম সময়ের অর্থমন্ত্রী বানিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। বিপরীতে বর্তমান অর্থমন্ত্রী নিজেকে ও দেশকে সবার কাছে হাস্যাস্পদ করে চলেছেন এবং অর্থনীতিকে বিপদে ফেলেছেন। যদিও অর্থমন্ত্রী চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করেছিলেন, কিন্তু তিনি কখনও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে প্র্যাকটিস করেননি। মিডিয়ায় তিনি পারতপক্ষে বক্তব্য রাখেন না; সংসদে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকেন। তিন বছর ধরে অর্থনীতি যে একাধিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে চলেছে, তার জন্য শুধু করোনাভাইরাস মহামারি কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করে পার পাওয়া যাবে না। এ জন্য অর্থমন্ত্রীর যোগ্যতার ঘাটতিকেই প্রধানত দায়ী করা যায়।
এ জন্য আমি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে চাই, বর্তমান অর্থমন্ত্রীকে তাঁর পদে বহাল রাখলে এই বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করা যাবে না। আগামী নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, সেটা আমার কলামের বিষয়বস্তু নয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গত দেড় দশকে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে; সেটা বরবাদ হতে চলেছে অর্থমন্ত্রীর অযোগ্যতার কারণে। যে সংকটগুলোর বর্ণনা কলামে দেওয়া হলো, সেগুলো সমাধানের অযোগ্য কোনো সমস্যা নয়; ওগুলোর সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না অর্থমন্ত্রীর দক্ষতার অভাবে। অতএব যোগ্যতর কাউকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিলে কয়েক মাসের মধ্যেই সঠিক নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতিকে আবারও ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ
সমকাল