Site icon The Bangladesh Chronicle

অর্থনীতি স্বাভাবিক হওয়ার পথে তিন বাধা

Vector illustration, economic recession, profit and loss, business and finance, crisis.

অর্থনীতি স্বাভাবিক হওয়ার পথে তিন বাধা

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অপর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং শিল্প এলাকায় শ্রম অসন্তোষ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হওয়ার পথে মূল তিনটি বাধা। অন্যদিকে, চলতি অর্থবছরের শুরুতে আন্দোলন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে বিনিয়োগ ও শিল্প খাতের কার্যক্রমে ধীরগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থায়ন সংকোচনসহ বিভিন্ন কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগের প্রভাব আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে।

গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিশ্বব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’-এ এমন পর্যবেক্ষণ রয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিস্ট ধ্রুব শর্মা। বক্তব্য রাখেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেক।

বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ দশমিক ২ থেকে ৫ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে। এর মধ্যবর্তী পয়েন্ট ৪ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তার কারণে প্রবৃদ্ধির অনুমানের মধ্যে এত পার্থক্য রাখা হয়েছে। অন্যান্য কারণের পাশাপাশি সাম্প্রতিক বন্যাও প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করবে। আর আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, খাদ্যের উচ্চ মূল্য এবং সরবরাহজনিত সমস্যার কারণে চলতি অর্থবছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকবে। তবে তা গত অর্থবছরের ৯ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে নামতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আগামীতে স্থানীয় ও বৈশ্বিক কিছু ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রথমত, পুলিশ বাহিনী পুরোপুরি কার্যক্রমে ফিরে না আসা পর্যন্ত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের সময় নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে ভিন্নমত ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি অন্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে– কিছু ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা, দুর্বল করপোরেট শাসন, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও বাণিজ্য অংশীদার দেশে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া।

বিশ্বব্যাংকের এবারের প্রতিবেদনের মূল ফোকাস হলো, ‘সুন্দর আগামীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি’। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, চাকরির মান এবং দক্ষতার ঘাটতি। ছাত্রদের নেতৃত্বে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে তার অন্যতম কারণ হলো, চাকরির সুযোগ সীমিত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি। প্রাথমিকভাবে সরকারি চাকিরতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলেও এর পেছনে গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ ছিল। গত কয়েক দশকে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও তা পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ হারে। অথচ এ খাতে এ সময়ে কর্মসংস্থান কমেছে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিক, প্রতিটি খাতে প্রকৃত মজুরি কমে গেছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য রয়েছে। ২০০০ সাল থেকে কৃষি থেকে শিল্প ও সেবা খাতের দিকে কর্মসংস্থানের যে কাঠামোগত পরিবর্তন শুরু হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা ধীর হয়ে গেছে। বাড়তি শ্রম কৃষিতে সংস্থান হচ্ছে। শহরে কর্মসংস্থান কমে গেছে। এ অবস্থায় নতুন ও শোভন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন। বিশেষ করে শহর এলাকায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রমবাজারে চাহিদা এবং সরবরাহ উভয় পর্যায়েই সমস্যা রয়েছে। কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টির করার মতো যথেষ্ট বড় নয় অনেক প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতায় ভুগছে প্রতিষ্ঠানগুলো। অন্যদিকে, খাতভিত্তিক দক্ষ মানবসম্পদেরও অভাব রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের বাইরে কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র তৈরির দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

এক প্রশ্নের জবাবে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিস্ট বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার বাড়ছে। গত দশকের শিক্ষিত বেকারের হার ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০ শতাংশ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে জিডিপি বৃদ্ধি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে খুব একটা ভূমিকা রাখেনি। বিপুলসংখ্যক তরুণ কর্মসংস্থানের বাইরে থাকছে। বিশেষ করে শিক্ষিত যুবক ও নারীদের অনেকেই তাদের কাঙ্ক্ষিত কাজ খুঁজে পান না। এ ছাড়া সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় শিল্প ও সেবা খাতের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে– যা কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি অবশ্য আশা প্রকাশ করে বলেন, বর্তমান সরকার দেশের আর্থিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও ব্যবসায়ের পরিবেশ উন্নত করতে জরুরি ও সাহসী সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে দেশ কর্মসংস্থান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথে ফিরে আসতে পারবে। সরকার বড় ধরনের যেসব সংস্কার হাতে নিয়েছে, তাতে বিশ্বব্যাংক সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে বলে জানান তিনি।

জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক সংঘাত সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু আন্দোলন নির্মমভাবে দমন করা হয়। এ কারণে তা দেশব্যাপী সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। যার ফলে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়। নির্যাতন, সহিংসতা এবং ব্যাপক হারে ধরপাকড়, কারফিউ ও ইন্টারেনট বন্ধ করে দেওয়া– এসব কারণে জুলাই-আগস্ট মাসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া জুনে ছাত্রদের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে রাজধানীতে পরিবহন এবং সেবা খাতের কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। ১৮ এবং ১৯ জুলাইয়ের সংঘাতের পর কারফিউ জারি এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার পর রাজধানীর বাইরেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হতে শুরু করে। শিল্পকারখানা এবং সেবা খাতে স্থবিরতা নেমে আসে। মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার-জট অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। রপ্তানিতে পণ্য জাহাজীকরণ স্পষ্টত কমে যায়। বিদেশি ক্রেতা প্রতিনিধিদের পক্ষে বাংলাদেশে আসা সম্ভব হয়নি; যা রপ্তানি আদেশের প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অবশ্য জুলাই মাসের শেষ সপ্তায় কারফিউ শিথিল এবং ইন্টারনেট সংযোগ ফের চালু হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা গতি ফেরে। তবে শেখ হাসিনার পদত্যাগের আগে পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে পরিস্থিতির অবনতি হয়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর অর্থনৈতিক কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিস্ট বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনও রয়ে গেছে। এ বিষয়ে আমরা কোনো পূর্বাভাস দিচ্ছি না। তবে এটা সত্য যে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে।’

প্রতিবদনে বলা হয়, রেমিট্যান্স প্রবাহেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক সংঘাতে। ইন্টারনেট সেবা এবং ব্যাংক বন্ধ থাকায় জুলাই মাসে জুনের চেয়ে রেমিট্যান্স কম আসে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। আগের বছরের একই মাসের চেয়ে যা ৩ শতাংশ কম। তবে আগস্টেই রেমিট্যান্সে প্রবাহ বাড়ে। আগের বছরের একই মাসের চেয়ে মাসটিতে রেমিট্যান্স বাড়ে ৩৯ শতাংশের বেশি। ডলারের বিনিময় হারও ১২০ টাকা এবং খোলাবাজারে ১২২ টাকার মধ্যে স্থিতিশীল আছে।

ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি

প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জিং সময়ে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। গত অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত তারল্য সংকোচনের মুখে পড়ে এবং ঋণ প্রবৃদ্ধি ধীর হয়ে যায়। খেলাপি ঋণ উচ্চ পর্যায়ে থাকে এবং সংজ্ঞা ও রিপোর্টিং মানের কারণে প্রকৃত অবস্থা আড়ালে থাকে। ব্যাংকিং খাতের ভঙ্গুরতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমার অন্যতম কারণ।

samakal

Exit mobile version