ভারতে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান সব নাগরিকের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, যাকে ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা ইউসিসি বলা হয়– তা চালু করার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত টেনে আনলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সারা দেশে এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউসিসি চালু করা ভারতের বর্তমান শাসক দল বিজেপির একটি খুব পুরোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা। বস্তুত এই রাজনৈতিক দলটির তিনটি প্রধান কর্মসূচিই ছিল– অযোধ্যাতে রামমন্দির নির্মাণ, কাশ্মিরের বিশেষ স্বীকৃতি বিলোপ এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রবর্তন। এরমধ্যে প্রথম দুটির বাস্তবায়ন হয়ে গেলেও তৃতীয়টি এখনও বাকি– এবং খুব সম্প্রতি বিজেপি সরকার সেই ইউসিসি চালু করার লক্ষ্যেও জোর কদমে এগোচ্ছে, আর প্রধানমন্ত্রীর এই কথাতেও তা স্পষ্ট হয়ে গেছে।
পালের ওদিকে ভারতের মুসলিম সংগঠনগুলো সারা দেশে ইউসিসি চালুর বিরোধী, কারণ তারা মনে করে এতে ভারতের মুসলিমদের স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণের অধিকার লঙ্ঘিত হবে। ভারতের মুসলিম পার্সোনাল ল (ব্যক্তিগত আইন) মুসলিমদের বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার বা এই জাতীয় বিষয়গুলোতে তাদের যে বিশেষ অধিকার দেয়, ইউসিসি চালু হলে তা আর থাকবে না– এটাও আপত্তির একটা বড় কারণ।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদি আজ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তার সরকার মনে করে এক দেশে দুরকম আইন চলতে পারে না– ব্যক্তিগত আইন বা দেওয়ানি বিধিও সব ধর্মের লোকেদের জন্য একই রকম হওয়া দরকার।
মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভূপালে একটি দলীয় কর্মিসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি এদিন বলেন, ‘তিন তালাকের কথাই ধরুন। তিন তালাক যদি ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গই হবে, তাহলে কেন মিসর, ইন্দোনেশিয়া, কাতার, জর্ডান, সিরিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো মুসলিমগরিষ্ঠ দেশে এই প্রথা চালু নেই?’
ভারতে ইউসিসি চালু করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি আরও বলেন, ‘একটি পরিবারে সব সদস্যের জন্য যেমন একই ধরনের নিয়ম থাকা উচিত, তেমনি একটি দেশেও দুই ধরনের আইন থাকা সমীচীন নয়। মিসরকেই দেখুন, তারা একটি ৯০ শতাংশ সুন্নি মুসলিমের দেশ– অথচ সেই আশি বা নব্বই বছর আগেই তারা তিন তালাক প্রথা বিলুপ্ত করে দিয়েছে।’
‘তিন তালাক’ প্রথাকে আক্রমণ করে তিনি আরও বলেন, এর ফলে অনেক সময় গোটা পরিবার পর্যন্ত ভেঙে চুরমার হয়ে যেতো। অনেক আশা নিয়ে বাড়ির মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পাঠানোর পর সে যখন তালাক পেয়ে ফিরে আসতো– সেই পরিবারটির সব আশা-ভরসা খান খান হয়ে যেতো। ‘অথচ সেই তিন তালাক প্রথাকে কেউ কেউ জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, যাতে মুসলিম নারী-বোনদের তারা চিরকাল দাবিয়ে রাখতে পারেন’, বলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি।
তার সরকার তিন তালাক নিষিদ্ধ করে আইন চালু করেছে বলেই ‘আমি যেখানেই যাই, মুসলিম মেয়ে-বোনরা আমার ও বিজেপির পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসেন’– ভূপালের ওই সভায় জানান নরেন্দ্র মোদি।
বস্তুত তিন তালাক প্রথাকে ভারতের মুসলিম পার্সোনাল ল-র একটি অংশ বলেই গণ্য করা হতো, যা ইতোমধ্যে মোদি সরকার নিষিদ্ধ করেছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর কথা থেকেই স্পষ্ট, তারা সারা দেশে ইউসিসি চালু করে পুরো মুসলিম পার্সোনাল ল-কেই অপ্রাসঙ্গিক ও বাতিল করে দিতে চান। এই পদক্ষেপে দেশের সুপ্রিম কোর্টেরও সায় আছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
আর ভারতে ইউসিসি চালু করার পক্ষে কথা বলতে গিয়েই তিনি টেনে এনেছেন বাংলাদেশের কথা– যুক্তি দিয়েছেন মুসলিমগরিষ্ঠ বাংলাদেশে যদি তিন তালাকের রেওয়াজ না থাকে, তাহলে ভারতের মুসলিমদেরও তার কোনও দরকার নেই।