Site icon The Bangladesh Chronicle

অবলোকন – করোনা-উত্তর মহামন্দা ও বাংলাদেশ

কোভিড-১৯ উত্তর বিশ্ব আর কোনো দিন আগের অবস্থায় ফিরে আসবে না বলে মার্কিন করোনাভাইরাস বিজ্ঞানী ড. অ্যান্টনি ফৌসি যে মন্তব্য করেছেন তাকে অনেকে সত্য হিসাবে ধরে নিতে শুরু করেছেন। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ কর্মকর্তারাও। অতীতেও মহামারী আর অর্থনৈতিক মহামন্দা পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু জ্ঞাত ইতিহাসে এবারের মহামারীতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক, সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির আভাস দেখা যাচ্ছে, তাতে বিশ্ববাসীকে বিরল কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে লক্ষাধিক ব্যক্তি করোনায় মারা গেছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র এর ক্ষয়ক্ষতির যেভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রকাশ করেছে, তাতে ধারণা করা হয় যে, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা এর দ্বিগুণ হতে পারে।

সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুÑ উভয় ক্ষেত্রে তালিকার শীর্ষে উঠে আসছে বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞান প্রযুক্তি ও সমর শক্তিতে শীর্র্ষ দেশ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকানদের মৃত্যুর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়ানোর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

সমাজকাঠামোর প্রতিটি ক্ষেত্রে আঘাত
এবারের মহামারীর আঘাতটি এক দিকে দ্রুত সংক্রমণশীল আর বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত, অন্য দিকে সমাজকাঠামোর প্রতিটি ক্ষেত্রকে এটি আঘাত করছে, তছনছ করে দিচ্ছে। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয়টি হলোÑ এ পর্যন্ত হওয়া গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে, ভাইরাসটি ধরন ও প্রকারে পরিবর্তিত হয়ে বিধ্বংসী হয়ে উঠছে ক্রমাগতভাবে। বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক স্কলার মুফতি ইসমাইল মেন্ক বলেছেন, করোনাভাইরাসের এখন যে বিধ্বংসী অবস্থা তা মহাপ্রলয় প্রক্রিয়ার সূত্রপাত বলে মনে হচ্ছে। তিনি পবিত্র কুরআনের মহাপ্রলয়সংশ্লিষ্ট আয়াত এবং মহানবী সা:-এর বাণীগুলো তুলে এনে তার আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। থিওলজির বিষয়গুলোকে অনুমানসর্বস্ব ও অতিলৌকিক বিষয় হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করতে চান। কিন্তু এবারের করোনাভাইরাসের পর বিজ্ঞানীদের আসমানের দিকে আর ধর্মবেত্তাদের বিজ্ঞানের দিকে হাত বাড়ানোর যে কথা বিখ্যাত ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায় বলেছেন, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। করোনাভাইরাসের তাৎক্ষণিক পরিবর্তনটি সম্ভবত এই যে প্রচলিত বৈশ্বিক ব্যবস্থা বা ধারণা ভেঙেচুরে হয়তো এক নতুন পৃথিবীর সৃষ্টি হচ্ছে অথবা মহাবিলুপ্তি-উত্তর নতুন মহাজাগরণের সময়ের দিকে মানবজাতি এগিয়ে যাচ্ছে।
মহামারী মহামন্দা মহাপ্রলয় মহাজাগরণের ধর্মতাত্ত্বিক বা দর্শনগত বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা আমাদের নেই। এ বিষয়ে যারা প্রভূত জ্ঞান ও ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন এই আলোচনা তাদের জন্য নির্ধারিত। আমি এই লেখায় বৈশ্বিক মহামন্দার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ অর্থনীতি এবং সমাজকাঠামো যে মহাপ্রতিকূল এক সময়ের মুখোমুখি হতে পারে সে অবস্থার ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করব। এই চেষ্টা কোনোভাবেই ভীতি ছড়ানোর জন্য নয়, বরং এটি যে বৈরী অবস্থার মুখোমুখি আমরা হতে পারি তার আগাম ধারণা নিয়ে এ ব্যাপারে প্রস্তুতি যতটা সম্ভব নেয়ার জন্য, অন্তত মানসিকভাবে হলেও।

মহামন্দা অতীত ও বর্তমান
গত এক শতকের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক মহামন্দা ছিল ১৯৩০-এর দশকে বিশ্বব্যাপী সংঘটিত মন্দা। এই মন্দা শুরু হয় ১৯২৯ সালে আর শেষ হয় ১৯৩০ এর দশকের শেষের দিকে। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর দীর্ঘ সময়ব্যাপী ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী মন্দা। একবিংশ শতাব্দীতে এই মহামন্দাকে বিশ্ব অর্থনীতির পতনের উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
১৯২৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর স্টক বাজারে দরপতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই মন্দা শুরু হয়। পরে ১৯২৯ সালের ২৯ অক্টোবর এই খবর বিশ্বব্যাপী স্টক মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জিডিপি প্রায় ১৫ শতাংশ হ্রাস পায়। কিছু অর্থনীতি ১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝিতে আগের অবস্থায় এলেও অনেক দেশের অর্থনীতিতে মহামন্দার প্রভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু পর্যন্ত ছিল।

ধনী ও দরিদ্র সব দেশেই সেই মহামন্দার বিধ্বংসী প্রভাব ছিল। ব্যক্তিগত আয়, কর, মুনাফা ও মুদ্রা মূল্যমানের ব্যাপক পতন ঘটে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর ৫০ শতাংশ কমে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ২৫ শতাংশ বেড়ে যায় এবং কিছু কিছু দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশে। পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে মহামন্দার প্রভাব ছিল তীব্র, বিশেষ করে যেসব শহর ভারী শিল্পের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিল। অনেক দেশে নির্মাণকাজ একরকম বন্ধই ছিল। শস্যের মূল্য শতকরা ৬০ ভাগে নেমে এসেছিল। কৃষক ও গ্রামীণ এলাকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ব্যাপকভাবে।

মহামন্দার দু’টি ধ্রুপদী তত্ত্ব হলো কেইনেসীয় চাহিদা চালিত এবং অর্থকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা। চাহিদা চালিত তত্ত্বে বলা হয়, বাজারের ওপর আস্থা হারানোর ফলে ভোগের পরিমাণ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যয় কমে যায়। একবার মূল্যহ্রাস পাওয়ার ফলে অনেক মানুষ ধারণা করে নতুনভাবে বাজারে বিনিয়োগ না করে তারা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। টাকা বিনিয়োগ না করায় মূল্যহ্রাস পেলে তারা লাভবান হয় এবং চাহিদা কমায় স্বল্পমূল্যে অধিক পণ্য ক্রয় করতে পারে। অর্থকেন্দ্রিক ব্যাখ্যাকারীরা মনে করেন মহামন্দা সাধারণ দরপতন হিসেবে শুরু হয় কিন্তু অর্থ সরবরাহ সঙ্কুচিত হতে থাকলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে এবং এই সাধারণ দরপতন মহামন্দার রূপ ধারণ করে।
অতীতের মহামন্দার যেসব বৈশিষ্ট্য তার সবই এবারের করোনা-উত্তর মহামন্দায় দেখা যেতে পারে।

কিভাবে মন্দার মোকাবেলা?
সরকার বৃহদাকার অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ, টাকার জোগান বৃদ্ধি, সরকারি খরচ বৃদ্ধি এবং করের পরিমাণ কমিয়ে মন্দার মোকাবেলা করার চেষ্টা করে। বিনিয়োগ, ব্যবসায়িক সংস্থাগত লাভ ও চাকরির সুযোগ একই সাথে কমে যাওয়ার মতো মন্দার অনেক বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো একই সাথে দেখা দিতে পারে।
মূলধারার বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, অর্থনীতিতে অপর্যাপ্ত গড় চাহিদার কারণে মন্দা দেখা দেয় এবং তারা মন্দার সময় সম্প্রসারণমূলক বৃহদাকার অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের পক্ষপাতী। অর্থনীতিকে মন্দার কবল থেকে মুক্ত করার নানা কৌশল আছে। নীতিনির্ধারকরা অর্থনীতির কোন শাখা অনুসরণ করছেন তার ওপর নির্ভর করে কৌশলগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়। মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসীরা সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি ব্যবহারের পক্ষপাতী। আবার কেইনসের অনুসারী অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতির বৃদ্ধিতে গতি আনার জন্য সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করার কথা বলেন। জোগানের ওপর জোর দেন যেসব অর্থনীতিবিদ, তারা ব্যবসায় পুঁজির বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কর-ছাড়ের প্রস্তাব করেন। অবাধ বাণিজ্য নীতিতে বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদরা বাজারের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতার ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ না করার পরামর্শ দেন।

মন্দা এবং রাজনীতি
মহামন্দার পর অনেক দেশ রাজনৈতিক বিপ্লবের সম্মুখীন হয়। ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচারী শাসনের কাছে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে, বিশেষ করে ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত নাৎসি জার্মানি। লিউফাউন্ডল্যান্ডের কর্তৃত্বের ফলে স্বেচ্ছায় গণতন্ত্র ছেড়ে দিতে হয়।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য সাধারণত দেশের সমসাময়িক প্রশাসনকেই প্রশংসা অথবা দোষের ভাগী হতে হয়। এর ফলে একটি মন্দা ঠিক কখন শুরু হয়েছে, তা নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। কোনো অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ যদি এমন

একটি স্তরে পৌঁছায় যেখানে তার পক্ষে টিকে থাকা আর সম্ভব নয়, তা হলে তার ফলাফলই হয় অর্থনৈতিক চক্রের অধোগতি আর সংক্ষিপ্ত একটি পতনের দ্বারা সেই পরিস্থিতি সংশোধিত হয়। তাই এই আবর্তের কোনো নির্দিষ্ট পর্যায়ের কারণকে আলাদা করা খুব একটা সহজ কাজ নয়।
সাধারণভাবে মনে করা হয়, মন্দা এবং তার তীব্রতার ওপর সরকারের কাজকর্মের কিছু প্রভাব থাকে। অর্থনীতিবিদরাও বলেন যে, সাধারণত মন্দা সম্পূর্ণরূপে এড়ানো সম্ভব নয় এবং তার কারণগুলোও সঠিকভাবে বোঝা যায় না। ফলে, আধুনিক সরকার ও প্রশাসন মন্দা প্রশমিত করতে কিছু পদক্ষেপ নেয়, কিন্তু সেগুলো নিয়েও মতবিরোধ থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই পদক্ষেপগুলো মন্দা আটকানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় এবং এই পদক্ষেপগুলো নেয়ার কারণে মন্দা কম তীব্র অথবা দীর্ঘায়িত হয়েছে কি না, তা স্থির করাও কঠিন হয়।

করোনার প্রভাব ও পরিণতি
করোনাভাইরাসের প্রভাব এখন তার উত্থানপর্ব অতিক্রম করছে। গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে এটির সূচনা ঘটার পর এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ ১০০ দিন পূর্তিতে এটি ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের ব্যাপকসংখ্যক দেশে বিস্তারমান রয়েছে। আরো তিন থেকে ছয় মাস এর মহামারী প্রভাব অটুট থাকতে পারে। এর মধ্যে সূচনাকালের দেশগুলো তাদের করোনা প্রভাব কাটিয়ে আবার আগের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু বা বিস্তৃত করায় মনোযোগী হবে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ সময়টি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনরুদ্ধার কাজ শুরুতেই চলে যেতে পারে। ফলে নতুন কোনো ভাইরাসের সংক্রমণ না ঘটলেও চলমান সালটি বৈশ্বিক অবস্থার করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অধোগতির সময় হিসাবেই থাকবে। এই সময়ে বিশ্বে নির্মাণশিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে, ব্যক্তিগত সক্ষমতা হ্রাসের কারণে বাজারের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যাবে, রেমিট্যান্স আয়ে ধস নামবে, স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বাড়বে। সামগ্রিকভাবে সমাজের তথা জনগণের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে যাবে। আইএমএফ এখনো আশাবাদী থাকলেও ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হওয়ার ধারণা সঠিক হবে বলে মনে হয় না। এই বৈশ্বিক বাস্তবতা সামনে রেখে বাংলাদেশের অবস্থা বিশ্লেষণ করতে হবে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা
এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণশীল অবস্থা অতিক্রম করছে। মধ্য মার্চ থেকে লকডাউনের যে প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে সেটি চূড়ান্ত অবস্থার দিকে যাচ্ছে। করোনা আক্রান্তের এখন জ্যামিতিক বিস্তৃতি তথা কমিউনিটি সংক্রমণ বাড়ছে। রাজধানী ঢাকা, নিকটবর্তী শহর নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে এর দ্রুত বিস্তার ঘটছে। করোনা পরীক্ষার সুবিধা বিস্তৃত করার সাথে সাথে আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবে লাফিয়ে বাড়ছে, একই সাথে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। চলমান লকডাউন মে মাসের শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে মৃত্যু বা ক্ষয়ক্ষতি কোন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তা নিয়ে বেশ মতপার্থক্য রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেছেন, জাতিসঙ্ঘের ফাঁস হওয়া দলিলে বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা ২০ লাখে উঠে যেতে পারে বলে যে বক্তব্য তা ভুল ও অতিরঞ্জিত। আমারও ব্যক্তিগতভাবে সেটিই মনে হয়।

প্রভাব হবে অনেক গভীর
তবে করোনা শিকারের সংখ্যা বাংলাদেশে যাই হোক না কেন এর প্রভাব আগে থেকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতিশীল অর্থনীতিতে অনেক গভীর হতে পারে। বাংলাদেশে আগামী মাসে বাজেট ঘোষণা করা হবে। বাস্তবভিত্তিক করতে হলে এই বাজেটের আকার বা বরাদ্দ ডলারের হিসাবে হবে সঙ্কুচিত। কারণ ২০২০ অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের যে ৫০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছিল তার বিপরীতে ৬ মাসে অর্জিত হয়েছে মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। করোনা আক্রান্ত শেষার্ধে তা আরো ঋণাত্বক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে অথবা বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বাজেটের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বাস্তবতাও এখন নেই। বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের তহবিল অথবা চীন বা জাপানের সহায়তাÑ কোনোটাই আগের মাত্রায় থাকবে না। এর ফলে নতুন অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সঙ্কুচিত করতেই হবে, রাজস্ব ব্যয়ের রাশ টেনে ধরতে হবে। অথচ শিল্প কলকারখানা সচল রাখতে হলে প্রণোদনা সহায়তা দিতে হবে, মানুষকে ক্ষুধা অনাহার থেকে বাঁচাতে সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তৃত করতে হবে, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত আবার অর্থনীতির চাকা সচল করতে, কৃষি এবং ক্ষেতখামারে উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে সম্ভাব্য খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলা করতে হলে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে হবে। এক দিকে অর্থের অভাব অন্য দিকে অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন এই দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ জয় বাংলাদেশ কিভাবে করবে সেটিই হবে বড় বিষয়।

করোনাভাইরাসের প্রভাব সমাজে পড়েছে শ্রেণী নির্বিশেষে। ভাইরাস-উত্তর বাস্তবতা হলো নি¤œবিত্ত মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে বিত্তশালী পর্যন্ত সবারই অর্থনৈতিক সক্ষমতার অবনমন ঘটছে। নি¤œবিত্তরা সক্ষমতা হারালে রাষ্ট্রের সামাজিক নিরাপত্তা জাল এবং দান-খয়রাতের ওপর নির্ভরশীল হয়। সেটি না থাকলে আকালে বেঘোরে প্রাণ হারায়। মধ্যবিত্তরা অর্ধাহার-অনাহারে দুঃসময় কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। সমাজের অপেক্ষাকৃত সক্ষমরা তাদের ব্যবসা বা শিল্পোদ্যোগকে প্রাপ্য সহায়তা কাজে লাগিয়ে আবার সচল করার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি শ্রেণী পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াবে সবশ্রেণীর মানুষকে যার যার অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবেশ সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া।

প্রশ্ন হলো সেটি কিভাবে সম্ভব? করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়ে রাষ্ট্রকে জনগণের জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্যসেবা যতটা সম্ভব নিশ্চিত করতে এবং হতদরিদ্রদের কাছে খাবার পৌঁছাতে হবে। সরকার রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় এবং জরুরি অর্থ সম্প্রসারণ পদক্ষেপের মাধ্যমে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে দূরে রাখা হলে বাস্তবতার নিরিখে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ সরকার কার্যকর করতে পারবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তাও কাজে লাগাতে হবে। এরপর মহামারীর প্রকোপ কমে আসার সাথে সাথে ঘরবন্দী অবস্থা থেকে মানুষ বের হবে। তখনকার বাস্তবতা হবে ব্যাপক বেকারত্ব ও কর্মহীনতা। বিদেশ থেকেও লাখ লাখ প্রবাসী চাকরিহারা হয়ে দেশে ফিরে আসবে। বেসরকারি খাতের অনেক ব্যবসা ও শিল্পোদ্যোগ এর মধ্যে রুগ্ন হয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কৃষক ও খামারিদের উৎপাদন ক্ষতির কারণে আর্থিক সহায়তা না পেলে সেগুলোকে সচল করতে পারবে না।

বাংলাদেশে ছোট বড় উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা দানের দু’টি কাঠামোর একটি হলো আনুষ্ঠানিক ব্যাংক খাত, আরেকটি এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী খাত। গত এক দশকব্যাপী বৈরী পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এনজিওগুলোর সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখার সক্ষমতা অনেকখানি কমে গেছে। করোনা-উত্তর মহামন্দা পরিস্থিতিতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সক্ষমতা ফেরাতে হলে এনজিও কার্যক্রমে প্রাণ সঞ্চার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রামমুখী গ্রোথ সেন্টার তৈরির জন্য আনুষ্ঠানিক ব্যাংক খাতকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। এ ব্যাপারে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে যাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রামীণ শাখা রয়েছে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হবে ব্যাংক খাতে বিনিয়োগযোগ্য কার্যকর তহবিল সৃষ্টি।

ব্যাংকগুলোর বর্তমান যে তারল্য পরিস্থিতি তাতে জরুরি কোনো পদক্ষেপ না নিলে এটি নিশ্চিত করা যাবে না। এ ধরনের একটি মহামন্দা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য টাকার সরবরাহ বৃদ্ধি করতে ব্যাংকগুলোর বাধ্যতামূলক তহবিল সংরক্ষণ হার আরো নমনীয় করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মুদ্রানীতির সাধারণ ব্যাকরণের চেয়েও রাষ্ট্রের প্রয়োজন ও সঙ্কট উত্তরণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

ব্যাংক খাতই মূল
যেকোনো সামাজিক ও শিল্পোদ্যোগে জরুরি অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংক খাতের সক্ষমতা অতি জরুরি একটি বিষয়। আমরা যতই শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখার চেষ্টা করি না কেন, বাস্তবতা হলো ব্যাংকগুলোর হিসাবে যে টাকা আছে, সেই টাকা বাস্তবে নেই। আর এই টাকার বড় অংশ ব্যাংক মালিকরা পরস্পরের যোগসাজশে নামে-বেনামে বের করে নিয়ে গেছেন। এই অর্থ ব্যাংকের হিসাবে নিয়মিত ঋণ হিসাবে দেখানোর কারণে শরীরের ভেতরের ক্যান্সারটি বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না। আবার প্রদর্শিত কল্পিত আয় থেকে রাষ্ট্রকে কর পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংক-স্বাস্থ্যকে আরো সঙ্কটাপন্ন করা হচ্ছে। সংসদে অর্থমন্ত্রীর তথ্য অনুুসারে যে পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা ব্যাংক পরিচালকদের কাছে ঋণ রয়েছে তা আদায়ে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষত এর যে অংশ দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেভাবেই হোক সেটিকে আবার দেশের অর্থনীতিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। এটি সরকার অথবা রাষ্ট্রের ডিপ স্টেট চাইলে অসম্ভব নয়। এই প্রক্রিয়ায় লুটেরা মানসিকতার পরিচালকদের হাত থেকে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ পেশাদার ও সৎ উদ্যোক্তাদের হাতে স্থানান্তর করতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্প্রসারণশীল উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যাংকের তহবিল পুনরুদ্ধারের এই পদক্ষেপ সফল করা গেলে রাষ্ট্রের পক্ষে সীমিত সম্পদ দিয়েও গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত আবার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চাঙ্গা করা সম্ভব হবে।

মনে রাখতে হবে, এবারের চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় এবং বাঁচা-মরার ইস্যু। ১৯২৯ সালের মহামন্দা গোটা বিশ্বে এখনকার মতো এতটা সর্বব্যাপী ও গভীর ছিল না। ফলে এবার বিশ্বের জন্য চ্যালেঞ্জ উত্তরণ যেমন কঠিন তেমনিভাবে বাংলাদেশের জন্য তা আরো কঠিন। এ চ্যালেঞ্জ রাষ্ট্রক্ষমতায় কে থাকল না থাকল তার চেয়ে বড় হলো এটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সক্ষমভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ জয়ের কোনো বিকল্প নেই।
mrkmmb@gmail.com

Exit mobile version